কোন এক সকালে প্রভাবশালী কোন এক ব্যক্তি পাড়ার সুঠাম দেহের অধিকারী যুবককে এই বলে আদেশ দিলেন, শোন্্, মাঝিপাড়ার হরিপদকে ধরে নিয়ে আয়। যেই আদেশ সেই কাজ। গলায় গামছা দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে হরিপদকে ধরে নিয়ে এল সেই যুবক। এই রকম কোন ঘটনার মধ্যে দিয়েই হয়তো পুলিশের আদি শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ। তারপর সমাজবদ্ধ সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে ক্রমে ক্রমে জমিদারী আমলে লাঠিয়াল, পেয়াদা, পাইক-বরকন্দাজ এবং রাষ্ট্রীয় আমলে গড়ে ওঠে পুলিশ। আর সেই যুবকের গামছাটি, দড়ি, শিকল, লাঠি ইত্যাদির ক্রম বিকাশের মাধ্যমে প্রকাশ পায় হ্যান্ডকাপ, লাঠি, টিয়ারগ্যাস ইত্যাদিতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, পুলিশের পোশাক আর ব্যবহৃত দ্রব্যাদির ক্রমবিকাশ ঘটলেও পোশাকের ভেতরের মানুষটির খুব বেশি বিকাশ ঘটেনি। এটা যেন পুরনো বোতলে নতুন মদ নয়, নতুন বোতলে পুরনো মদ। তারপর বৃটিশ আমলের পরাধীন সময়ে আমাদের আজকের আধুনিক পুলিশের সৃষ্টি হলেও বৃটিশরা পরদেশীদের জন্যই এই পুলিশ এবং তাদের আচরণ বিধি তৈরি করেছিল। তাদের প্রশিক্ষণও ছিল এই উপমহাদেশের মানুষজনদের প্যাদানোর জন্য। তারপর বিভিন্ন সময়ে আমাদের পুলিশকে জনমুখী ও কল্যাণকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক তাগিদ আসলেও তার খুব বেশি বাস্তবায়ন ঘটেনি। তবে মাঝে মাঝেই এই প্রশিক্ষণের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে অনেক পুলিশ গড়ে উঠেছে যাদের আচরণ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আর যারা প্রশিক্ষণের গৎবাঁধা নিয়ম প্রতিপালন করেছে তাদের কাছ থেকে আমরা কি আচরণ পেয়েছি তা বলার বা লেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কারণ, এই লেখার যারা পাঠক, এ ব্যাপারে তাদের সকলেরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা আছে বলে আমরা মনে করি। বিশেষ করে বর্তমানে যখন পুলিশের সীমা লঙ্ঘন সব সীমা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
পজেটিভ পুলিশ
পুলিশ কি শুধু ঘুষখোর? থানা মানেই কি অনিয়মের সূতিকাগার? অবশ্যই নয়। হরতালের দিনে খাঁ খাঁ রোদ্রে দাঁড়িয়ে পুলিশ অসীম ধৈর্যের সাথে বিক্ষোভকারীদের মোকাবিলা করে, সাতদিনের পচা লাশ নিয়ে যে পুলিশ রাতভর পাহারা দেয়, পরস্পর বিরোধী সন্ত্রাসীদের গোলাগুলী থামাতে যে পুলিশ রক্তাক্ত হয়, দিনের পর দিন যে পুলিশ পরের ধন পাহারা দেয়, মিছিল থেকে ছোড়া ইটের আঘাতে যে পুলিশকে রক্তাক্ত করার পরেও গুলী চালায় না বরং সহকর্মীদের ধৈর্য ধারণের অনুরোধ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনকারী অধূমপায়ী পুলিশ অফিসারদের সামনে যখন উঠতি বয়সী কথিত ছাত্রনেতারা একটার পর একটা সিগারেট ফুকে যায় তখন মার্জিত ভঙ্গীতে ধৈর্যের সাথে যে পুলিশ তা সহ্য করেন, তারা অবশ্যই আমাদের গর্ব। পুলিশের এত দুর্নামের মাঝেও কি আমরা মুক্তিযুদ্ধে তাদের দেশপ্রেম দেখিনি? পুলিশ সে সময় দেশপ্রেমের চরম প্রমাণ দিয়েছে লাশ হয়ে, পঙ্গু হয়ে। আজও আমরা কি দেখি না সৎ পুলিশ কর্মী কি করে রাতভর পাহারা দিয়ে যুবতী মেয়েকে ঘরে ফিরিয়ে দিয়ে যায়, বেওয়ারিশ লাশ বিনা মাশুলে বয়ে বেড়ায়, অপহৃত শিশুকে বেতনের টাকা হতে খাবার কিনে দেয়ার নজীর স্থাপন করেÑ সেতো আমাদেরই পুলিশ। আমাদের পুলিশই ছিনতাইকারীর হাতে সব খোয়ানো ব্যক্তিকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে যাতায়াতের টিকিট কিনে দেয়, রাস্তার পাশে দাঁড়ানো অন্ধ ভিখারীটিকে রাস্তা পারাপারে সহায়তা করে আমাদেরই পুলিশ, আমাদের পুলিশ মধ্য রাতে ছিনতাইকারীর উপদ্রব থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করে। এ সমস্ত সৎ পুলিশ তো আকাশ থেকে বা ভিন্ন গ্রহ থেকে নেমে আসে না। আমাদের মাঝ থেকে পুলিশ প্রশাসনে তাদের গমন। একই প্রশাসনে একই প্রশিক্ষণে তারাও কায়দা-কানুন শিখে কিšুÍ তারপরেও তারা পজেটিভ আচরণ করেন কিভাবে সে প্রশ্ন তোলা কি খুব বেশি অন্যায় হবে?
হাজত রেজিস্টার ও গ্রেফতার বাণিজ্য
থানার হাজতখানায় কোন নাগরিককে ঢোকালে সাধারণ ডাইরী বা হাজত রেজিস্টারে নাম উল্লেখ থাকলে আসামীকে পুলিশ ইচ্ছে করলেই আর থানা থেকে ছেড়ে দিতে পারতো না। কিšুÍ আমাদের থানা পুলিশের অনেকে এই নিয়মটি মানছে না। মন চাইলেই যাকে তাকে হাজতখানায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তারপর গভীর রাতে দালালদের মাধ্যমে কথাবার্তা বলে মুনাফা লুটে ছেড়ে দিচ্ছে। হাজত রেজিস্টার ঠিক মতো মেইন্টেইন করা হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থানায় সারপ্রাইজ ভিজিটে গিয়ে রেজিস্টার পরখ করলে দেখবেন থানার হাজতে ঢোকানো এবং বের করা থানা পুলিশের জন্য কত সহজ কাজ? অথচ নিয়ম যদি এভাবে প্রতিপালিত হতো যে, একবার হাজতে ঢোকানো হলে মাননীয় আদালতের নির্দেশ ছাড়া আসামী ছাড়া যাবে না, তাহলে থানায় ঘন ঘন হাজত বাসের বিড়ম্বনা থেকে জনগণ যেমন রক্ষা পেতো তেমনি থানায় কমতো দালালদের তৎপরতা। ধৃত আসামী ছাড়ার ব্যাপারে পুলিশের যখন কোন ভূমিকা নেই তখন পুলিশকে আর কেউ জ্বালাতনও করতো না, কেউ দিত না পুলিশকে ঘুষ। সংগতকারণেই পুলিশের কপাল থেকে ঘুষখোর উপাধিটি হয়তো মুছে যেতে পারতো। সুতরাং হাজত রেজিস্টার মেইন্টেইন করে পুলিশ অনেক বদনাম থেকে রক্ষা পেতে পারে। বিষয়টি পুলিশ কর্তারা ভেবে দেখবেন কি?
পুলিশের সাধারণ ডাইরী
হাজত রেজিস্টার ঠিক মতো ব্যবহার না করার কারণে আজকাল গ্রেফতার বাণিজ্য শুরু হয়েছে। পুলিশ সন্ধ্যা রাতে ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে নিরপরাধ লোককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারপর গভীর রাতে ঘুষ খেয়ে তাদের ছেড়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে বাণিজ্য করছে। ঘুষ না দিলে রাজনৈতিক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে এই রকম ঘটনা এখন অনেক ঘটছে।
পুলিশ, দুর্নীতি ও নির্যাতন
যেদিন পুলিশের প্রকাশ ঘটেছে সেদিনই পুলিশ প্রশাসনে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। পুলিশকে দিয়ে কোটি কোটি টাকার বোঝা টানিয়ে রাজনৈতিক প্রশাসন যখন একা তা ভোগ করেছে তখনই পুলিশের লোলুপ জিহ্বা প্রসারিত হয়েছে। তবে পুলিশের দুর্নীতি ও নির্যাতন প্রকট হয়ে ওঠে মূলত এরশাদ সরকারের আমল থেকে। তখন ছাত্রমিছিলে পুলিশ ট্রাক চালিয়ে দু’জনকে খুন করে। সে সময় চারুকলা ইনস্টিউিটের সামনে একজন ছাত্রীকে চুলের মুঠি ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকার, প্রশাসন, রাজনীতিক ও প্রভাবশালীদের সে সময় প্রশাসনে যথার্থ জবাবদিহিতা না থাকার কারণে নিজেই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। পরবর্তীতে বিএনপির বিগত আমলেও কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। সে আমলে মতিয়া চৌধুরীকে পুলিশ বেধড়ক মারধর করে। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও আব্দুর রাজ্জাককে করা হয় লাঠিপেটা। জাহানারা ইমামও সেসময় পুলিশের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এডভোকেট সাহারা খাতুনকে পুলিশের লাঠির আঘাতে পা ভেঙ্গে হাসপাতালে যেতে হয়। এ সময়ে প্রেস ক্লাবের মতো প্রতিষ্ঠান আক্রমণ করা হয়। পরবর্তীতে হাসিনা সরকারের আমলেও এ নির্যাতনের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। সে সময় পুুলিশের জিম্মায় থাকা অবস্থায় সীমা চৌধুরী ধর্ষিত ও নিহত হয়। নির্যাতন করে, পিটিয়ে পুলিশ হত্যা করে রুবেলকে। পুলিশের সোর্স জালাল খুন হয় স্বয়ং ডিবি অফিসের ভেতরে যার সঙ্গে পুলিশ প্রতক্ষ্যভাবে জড়িত রয়েছে। এরকম আরও কয়েকটি হত্যাকা- ঘটিয়েছে পুলিশ। সরকারের পক্ষ নিয়ে হরতালে জনতার ওপর পুলিশ চালাচ্ছে অকথ্য নির্যাতন। শেখ হাসিনার আমলে পুলিশ সাদেক হোসেন খোকা, আব্দুল্লাহ আল নোমান, আমানুল্ল¬াহ আমানের ওপর লাঠি তুলে রক্তাক্ত জখম করে, ফিরোজ কবিরের শার্টের কলার ধরে টানা-হিঁচড়া করে পুলিশ। এতে তার শার্ট ছিঁড়ে যায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ
’৯০ পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনামলে যারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন তারা সবাই পরবর্তীতে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কারো হাতে পুলিশ অন্যায়ভাবে হ্যান্ডকাপ পড়িয়েছে আবার কেউ কেউ রক্তাক্ত হয়েছেন পুলিশী নির্যাতনে। দুষ্ট লোকেরা একে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন। পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করে সুশৃঙ্খল বাহিনীতে রূপান্তরিত করার পরিবর্তে রাজনৈতিক অপব্যবহারের মাধ্যমে যে বিশৃঙ্খলা তারা সৃষ্টি করেছেন ওগুলো তারই যথোচিত পুরস্কার। এই পুরস্কারের আওতায় এসেছেন প্রায় সকল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ভবিষ্যতে সাহারা খাতুন আর মহিউদ্দিন খান আলমগীরও এই পুরস্কার পাবেন বলে দুর্মুখেরা বলে থাকেন।
জাতির বস্ত্রহরণ ও পুলিশ
ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে মনি বেগমের বস্ত্র হরণের টানা-হিঁচড়ার মধ্যদিয়ে। সমস্ত পৃথিবীর সভ্য মানুষের মাথা হেট হয়েছে এ দৃশ্য পত্রিকায় দেখে। বিচারপতি কে, এম সোবহান এটিকে একজন নারীর নয়, জাতির বস্ত্র হরণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা নারী সেদেশে এরকম মানবাধিকারের ঘটনা মেনে নেয়া কি যায়? সম্প্রতি চলতি সংসদের এমপি শাম্মী আখতারও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলার সময় তিনি পড়ে যান। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান তিনি। এ রকম ঘটনা প্রায়শই ঘটছে।
চোরাচালান, ঘুষ ও পুলিশ
আমাদের দেশে সব রকম চোরাচালান, অন্যায়, অপরাধ আর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুলিশের দুর্নীতি। পুলিশের দুর্নীতির কারণে সারা বাংলাদেশ এখন ভারতের অবৈধ পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। এরা রাস্তায় ট্রাক থামিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে চোখের সামনে অর্থ আদায় করে। চোরাই মালের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বনিবনা না হওয়াতেই পুলিশের ডিবি অফিসে সোর্স জালালকে হত্যা করা হয়। ঘুষ, দুর্নীতি তাদের কাছে এখন এতোটাই বৈধ হয়ে উঠেছে যে, তারা পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নেয়। থানায় মামলা করতে গেলে এদের টাকা দিতে হয়। ইনকোয়ারিতে পাঠাতে হলে লাগে টাকা। আসামী ধরাতে টাকা, চার্জশীট তৈরিতে টাকা, চার্জশীটে মিথ্যা লিখতে দিতে হয় টাকা। আসামীকে পেটানোর জন্য গুঁজে দিতে হয় টাকা। পেটানো থেকে রক্ষা করতেও টাকা। মামলায় ওরা এমন একটা অবস্থা তৈরি করে যার মাধ্যমে আসামী বাদী দু’পক্ষ থেকেই টাকা পাওয়া যায়।
দায়ী কে?
পুলিশ ঘুষ খাচ্ছে, দুর্নীতি করছে, নির্যাতন, হত্যা-ধর্ষণের মতো জঘন্য অন্যায়ে তারা লিপ্ত-তার জন্য প্রকৃত অর্থে দায়ী কে? সোজা কথায়, পুলিশ হলো সরকারের দারোয়ান বা প্রহরী। একটা কথা আমরা জানি, তা হলো যেখানেই ঘুষ সেখানেই দুর্নীতি। সরকার তার দুর্নীতিকে লালন করছে পুলিশকে প্রশ্রয় দিয়ে এবং নিজেদের স্বার্থে তাদেরকে ব্যবহার করে। সরকার ও প্রশাসনে যথার্থ জবাবদিহিতা নেই বলেই পুলিশ অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। সরকারের লোক ও তার অভ্যন্তরের নেতারা জড়িত রয়েছে চোরাচালান, ঋণখেলাপী, খুন, দখল, বোমাবাজি, সন্ত্রাস এবং ডাকাতির সঙ্গে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারাই হলো পুলিশের হর্তাকর্তা। পুলিশকে নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করে তারা স্বার্থ হাসিল করে। এসব গডফাদার নেতারা পাতি নেতা, ক্যাডারদের অপরাধ, খুন-রাহাজানিতে উস্কে দেয় এই বলে যে, ‘খুন কইরা তারপর আমার কাছে আইবি’। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্র নেতারাই মূলত ক্যাম্পাসে পুলিশদের নেতৃত্ব দেয় এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর আগে কথিত ছাত্র নেতা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল না করার কারণে জনৈক পুলিশ অফিসারকে চড় মেরেছিল। ক্যাম্পাসগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, বিরোধী দলের ছাত্রনেতাদের বিনা কারণে ধরপাকড় ও নির্যাতন চালানো হয়। অপরদিকে সরকারি দলের নেতারা সারা ক্যাম্পাসে তা-ব সৃষ্টি করলেও তাদের ধরা হয় না। এটা সব সরকারের আমলেই হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে উপরওয়ালাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকার পক্ষের ভিসি, প্রোভিসি ও প্রক্টর সাহেব কর্তৃক পুলিশের প্রতি থাকে অদৃশ্য আঙ্গুলের ইশারা। এদেশের সরকাগুলোর এই গতানুগতিক পক্ষপাতিত্ব ও প্রতিহিংসামূলক মানসিকতাকে পুলিশ বিভাগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আত্মস্থ করেছে। যেদিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা। ফাঁকে ওরা অন্যায় করার প্রশ্রয় পাচ্ছে। করে নিচ্ছে সুযোগের সদ্ব্যবহার। সরকার সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত অপরাধী পুলিশদের বিরুদ্ধে কোন রকম শাস্তির ব্যবস্থা করছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদেরকে শুধু অন্যত্র বদলি করে সরকার তার দায় শেষ করছে। চাকরি-বাকরিতে নিজেদের লোকদেরকে অবৈধ নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের কর্তারা মামু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাদের লোকদেরকে যদি অপরাধের কারণে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, টেলিফোন তদবিরের মাধ্যমে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দলীয়করণের আশ্রয় নেয়া হয়।
রাজনীতিক ও পুলিশ
পুলিশী নির্যাতন, দুর্নীতি ও অপরাধের জন্য দায়ী দ্বিতীয়পক্ষ হলো সরকার-বিরোধীদল নির্বিশেষে দেশের রাজনীতিক শ্রেণী। পুলিশকে দিয়ে বিভিন্ন অপরাধ, নির্যাতন ও দুর্নীতি সাধনের ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক সমঝোতা, সমন্বয় এবং ঐক্য। ক্ষমতা বাগানোর জন্য নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে মাঠ গরম করলেও সামাজিক পদ-মর্যাদায় তারা পরস্পরের ঘনিষ্ট মিত্র। রাজপথে একে অপরের দিকে কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি করলেও রাতে ওরা একই টেবিলে পানাহার করে, খোশ-গল্প করে। উভয় দলের নেতাদেরই ব্যবসায়িক স্বার্থ এক। ফলে পরস্পর পরস্পরের স্বার্থ রক্ষা করে চলে। উদাহরণস্বরূপ ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে এরা কেউ কথা বলে না। কারণ উভয়েই ঋণখেলাপী এবং উভয়ের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। পুলিশকে দিয়ে এরশাদও মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, অন্যরাও এ কর্মটি থেকে পিছিয়ে ছিলেন না বা পিছিয়ে নেই। অর্থাৎ পরস্পরের স্বার্থ ও লক্ষ্য এক। ওদের ক্যাডার, মাস্তানরা পুলিশের হাতে গেলে ছাড়িয়ে আনার জন্য ওরা পরস্পরের সহযোগী। ওদের একজনের ভারতীয় অবৈধ পণ্যের ট্রাক আটকা পড়লে অপরপক্ষ তার সহযোগী। হত্যা, খুন, গুম অন্যায় করলে ওদেরকে কখনো জেলে পচতে হয় না। নেতারা বেশ কিছু সুস্পষ্ট হত্যাকা- ঘটিয়েও আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারে জীবন। এক সময় রাজনীতি করতে আসতো সবচেয়ে মেধাবী, জ্ঞানী, ব্যক্তিত্ববান, দেশপ্রেমিক ছেলেটি। আর এখন রাজনীতিতে আসে ক্লাবের সবচেয়ে অজ্ঞ, ব্যক্তিত্বহীন গু-া ও অস্ত্রধারী ছেলেটি। দিনে দিনে রাজনীতিতে এতো বেশি সন্ত্রাসীর জায়গা পোক্ত হলে পুলিশ কোনভাবেই তার সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারে না।
প্রভাবশালী মহল ও পুলিশ
পুলিশের অপরাধের জন্য দায়ী অপরপক্ষ হলো সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। সরকার, প্রশাসন, রাজনীতি ও সন্ত্রাসের গভীরে এদের হাত রয়েছে। সামাজিক ও অর্থনেতিক দিক থেকে দেশে এদের প্রতিপত্তি রয়েছে। নির্বাচন এলে এরা নেতাদের কোটি কোটি টাকার চাঁদা দিয়ে সাহায্য করে থাকে। বিনিময়ে সময়মত তারা ওদের কাছ থেকে অন্যায় আবদারগুলো পূরণ করে নেয়। সামাজিকভাবে এলাকায় এদের প্রভাব থাকায় নির্বাচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরা নেতাদের ধুয়া তুলশী পাতা হিসেবে রাখতে পুলিশকেও তাদের অপকর্মের শরিক করে নেয়। এই প্রশ্রয় পরোক্ষভাবে পুলিশকে করে তোলে স্বেচ্ছাচারী ও দায়িত্বহীন।
মোদ্দা কথা
পুলিশ সদস্যরা আমাদের আত্মীয়-স্বজন। তারা অন্য কোন প্রজাতির প্রাণী নয়। তাদের দোষ-গুণ থাকবেই। সমাজে অন্যান্য অনিয়মের প্রতিফলন পুলিশের ওপর ছায়া হিসেবে পড়বেই। তাই বলে পুলিশকে ছোট করে দেখে তাদের সামাজিকতাকে পৃথক করা যাবে না। পুলিশের দোষ-ত্রুটির উৎস কোথায় তা চিহ্নিত করার পর সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। আর তারপরই পুলিশের দুর্নীতি রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। পুলিশের সমস্যা সমাধান না করে তাদের দুর্নীতিমুক্ত করার আর কোন বিকল্প রাস্তা খোঁজা এক ধরনের পাগলামী নয় কি?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন