আমরা এক ইতিহাস-ঐতিহ্য-বিমুখ প্রজন্মের জন্ম দিয়েছি। তারা বাংলাদেশের প্রায় আড়াই সহস্র বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। এদের শিক্ষা-দীক্ষার মান এত নীচু যে তা নিয়ে আলোচনা চলে না। কিন্তু এর জন্য ওরা দায়ী নয়। এর জন্য দায়ী আমাদের অশিক্ষিত শাসকেরা। বাংলাদেশে গত ত্রিশ বছরে যে প্রজন্মের সৃষ্টি হয়েছে, তারা শেখেইনি বাংলাদেশের ইতিহাস। সহস্রাধিক বছর ধরে কেন এদেশের মানুষ এক নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিম-ল গড়ে তুলেছিল, কেন তারা আশরাফ-আতরাফভেদে, মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধভেদে একাকার হয়ে পরস্পরের বিপদে-আপদে সহযোগিতা করে এই জনপদ টিকিয়ে রেখেছে এবং সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে তুলেছে।
আমরা যারা তুলনামূলকভাবে প্রবীণ লোক, তারা সে ইতিহাস পড়ে বড় হয়েছি। আমি সম্ভবত আমার জাতির ইতিহাস জানি। কীভাবে একটি জনপদ একটি জাতি হয়ে উঠলো, সেটিও আমার জানার খুব একটা বাইরে নয়। তারপরও এই বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে বিস্তর গবেষণা করেছি। আমি ফেসবুক খুলি না। কিন্তু ইমেইল-এই বহু লোক আমাকে এই বলে গালি দেয়, তুই--বাচ্চা। কোথা থেকে পিএইচডি করেছিস যে, নিজের নামের আগে ডক্টর লিখিস? আমি ধারণা করি, এসব প্রশ্নকর্তা টগবগে তরুণ। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। এই জনপদ কীভাবে বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলে আলাদা জাতি হিসেবে গড়ে উঠলো, সে ধারণাও তাদের নেই। ফলে কাউকে কাউকে জবাব দেই, বাবা, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছি। আর তার বিষয় ছিল এই ‘পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ১৯৪৭-১৯৭১’।
ধারণা করি, এরা আমার সন্তানতুল্য অথবা ততোধিক কম বয়সী। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারত যখন মুক্ত হয়, তখন ভারতে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির চিন্তা কেন তৎকালীন মুসলিম নেতারা করেছিলেন, সেই ইতিহাসও এখন আর পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয় না কিংবা লেখাও হচ্ছে না। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হচ্ছে ১৯৫২ সাল থেকে যখন ভাষার দাবিতে চারজন লোক শহীদ হয়েছিলেন। তার আগের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানতে দেয়া হচ্ছে না। এই মোবাইলের যুগে তরুণ সমাজের পাঠ্য বিষয়ের প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি করা হয়েছে। একইভাবে পাঠ্য বিষয় থেকে ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে বাদ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের তো আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস আছে। মোহেনজোদারো-হরপ্পার ইতিহাসের পর এই উপমহাদেশে সবচাইতে প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস বাংলাদেশের। সাম্প্রতিক খননে ওয়ারী-বটেশ্বরে যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তা আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। আমাদের পূর্বপুরুষেরা আড়াই হাজার বছর আগে নদী বন্দরের দিকে এক পাকা সড়ক নির্মাণ করেছিলেন। আমাদের র্প্বূপুরুষেরা ২২শ’ বছর আগে আমাদের লিপি তৈরি করেছেন। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ১৫শ’ বছর আগের চর্যাপদের কাব্য রচনা করেছিলেন।
গৌতম বুদ্ধ যখন ধর্ম প্রচার শুরু করেন, তার ধর্মের অহিংস নীতির কারণে শুধুমাত্র বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়। অষ্টম শতকে বৌদ্ধ শাসকদের উৎখাত করে হিন্দু সেন রাজারা যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তারা এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সৌহার্দ্যবিরোধী নানা কার্যক্রম শুরু করে। তখন এই জনপদের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকরা আত্মরক্ষার্থে নেপালে পালিয়ে যান। সঙ্গে নিয়ে যান তাদের রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’। এই কাব্যগ্রন্থ বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে ছিল না। কিন্তু এতে জীবনের প্রতিফলন ছিল। দেড় হাজার বছর আগে আমার পূর্বপুরুষেরা এমন কাব্য রচনা করেছিলেন। গৌরব আমাদের সেখানে হওয়া উচিত।
কিন্তু এখন শিক্ষাবঞ্চিত নতুন প্রজন্ম কী যে বলছে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। যা বলছে, তা যে অজ্ঞতা-প্রসূত সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। সরকারগুলো নানাভাবে ধারাবাহিকভাবে তাদের ব্যবহার করছে। কেউ একজন শিক্ষিত লোক এটা চিন্তা করেনি যে, এর পরিণতি কী হতে পারে? এ জন্য আমি তরুণ সমাজকে দায়ী করি না। যারা বিচার-আচার মানে না, যুদ্ধাপরাধের অপরাধে অভিযুক্ত যে কোনো ব্যক্তির ফাঁসি চায়, তারা কোনো সুস্থ মানব সন্তান হতে পারে না। আমি একশ’ লোককে হত্যা করেছি। আমার একটা বিচার। আমি কারো বাড়িতে আগুন দিয়েছিলাম। আমার আর একটা বিচার। এভাবে বিচারের মূল্যায়ন সব সময় ভিন্ন ভিন্ন।
গত ত্রিশ বছর যাবৎ আমরা এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করেছি যে, বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস ১৯৫২ সাল থেকে শুরু, এই প্রচারণা চালাচ্ছে অধিকতর হারে শেখ হাসিনা সরকার। কিন্তু কেন যে এই সরকারের এমন সিদ্ধান্ত তা বুঝতে খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি তাতে এই সরকারের তেমন প্রকৃত শিক্ষিত লোকের দারুণ আকাল, যারা ইতিহাস-ঐতিহ্য জানে। প্রধানমন্ত্রীকে এটা জানতেই হবে এমন আশা আমি করি না। আমার করা উচিতও নয়। যেহেতু তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন অতএব তিনি সর্বজ্ঞানী, সর্বংসহা নন। ফলে ধারাবাহিকভাবে আমরা তার হিংস্র মন্তব্য শুনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এটা যে আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে সেটা কেউ জানে না।
কিন্তু ঐ যে প্রথমেই বলেছিলাম, এসব সরকার আমাদেরকে আমাদের সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত করে ফেলেছে। সেই সত্য আরও একবার বলতে হয়। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বিরাট সৈনিক ছিলেন। অল্প বয়সে তিনি এদেশের পুরোধা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও একে ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সে কথা লিপিবদ্ধ আছে। কেন পাকিস্তান দরকার? শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বার বার বলেছেন, মুসলমানদের রক্ষার জন্য। এ দেশ নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশ। মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার অর্থই হলো, সে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী।
কিন্তু কেউ এটা খতিয়ে দেখতে চাচ্ছে না যে, তাজউদ্দিন আহমদ টেপ রেকর্ডার নিয়ে ২৫শে মার্চ রাতে শেখ মুজিবকে হাজার বার অনুনয় করেছিলেন যে, তিনি যেন শুধু একটি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। দেশের পরিস্থিতি তখন তেমনই ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান সে ঘোষণা দেননি। এখন অনেক ফটকা কাহিনী প্রচার করা হচ্ছে। সেগুলো কোনো অর্থ বহন করে না। সেভাবে ইতিহাস পরিবর্তন করারও চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস পরিবর্তন সহজ কথা নয় বা সহজে করা যায় না, কিংবা কখনোই করা যায় না। ইতিহাস আপন গতিতে চলতে থাকে এবং সত্য শেষ পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়ই।
শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশকে আগের সময়ের মতো ভারতীয় এক লীলাকেন্দ্র চিন্তা করছে। তিনিও সম্ভবত ইতিহাস-অচেতন। তা না হলে পাঠ্যপুস্তকে আল্লাহ ও দেবদেবীকে একাকার করতে পারতেন না। তাহলে আমরা সাধারণ মানুষেরা কী করতে পারি? আমরা হয় বলতে পারি, শেখ হাসিনা চিরজীবী হোক। কিন্তু মানুষ কখনও চিরজীবী নয়। আমরা ১৯৭২-’৭৫ সালে তিন বছর ধরে অবিরাম সেøাগান দিয়েছে, ‘এক নেতা এক দেশ, শেখ মুজিবের বাংলাদেশ।’ কিন্তু কখনও ভেবে দেখার চেষ্টা করিনি যে, বাংলাদেশ শেখ মুজিবের নয়। বাংলাদেশ দেশের (তৎকালে সাড়ে সাত কোটি বর্তমানে ষোল কোটি) জনগণের। দেশ স্বাধীন করেছে এদেশের মানুষই। শ্রমিক, মজুর, ছাত্র, শিক্ষক, জনতা, সবাই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশকে হানাদারমুক্ত করেছে।
ভারত এখন আমাদের মুক্তিদাতার দাবিদার। শেখ হাসিনার সরকার তার থৈলত্দার। এই সরকার দেশে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, মনে হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে এদেশের জনগণের বিন্দুমাত্র কোনো অবদান নেই। সকল অবদান ভারতীয় বাহিনীর। এদেশে এটাও বলা সম্ভব যে, জিয়াউর রহমান বীরউত্তম পাকিস্তানী এজেন্ট। কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম নব্য রাজাকার। আর এসব কথায় তামাশা দেখেন শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা।
প্রথমেই যে শুরু করেছিলাম, আমরা ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-চেতনা হারিয়ে ফেলেছি, এটি তারই প্রমাণ। শুনেছি শেখ হাসিনা নাকি পাঞ্জেগানা নামায পড়েন। কোরআন তেলাওয়াত করে দিনের কার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু যারা কোরআনের আইন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করলো, তাদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করলেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যদি ইতিহাস সচেতনতা থাকতো তাহলে ফকির লালন শাহের গান শুনে তিনি অভিভূত হতেন কিংবা নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করতেন। তার ভেতরে সে ধরনের সংশোধিত হবার আকাক্সক্ষা আছে, এটা মনে করার এ পর্যন্ত কোনো কারণই ঘটেনি।
কুষ্টিয়ার লালন ফকির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্ভবত ভাবগুরুই ছিলেন। এ কথা বলা হয়ে থাকে যে, লালন ফকিরের ভাবসম্পদ নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সঙ্গীত লিখেছিলেন। লালন ফকিরের একটি গান সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। সরকার নিজের খামখেয়ালির বাইরে এদেশের মানুষের মতের প্রতি, জনমতের প্রতি থোড়াই পরোয়া করতে শুরু করেছে। এর তো একটা প্রাকৃতিক পরিণতি আছেই।
একটা আধ্যাত্মিক বিপর্যয়ও আছে। সেক্ষেত্রে লালন শাহের একটি উদ্ধৃতি না দিলেই নয়। তার একটি গান হলো, “চিরদিন ইচ্ছা মনে, আল ডাঙায়ে ঘাস খাবা,/ মন সহজে কি সই হবা।/ ডাবার পরে মুগুড় প’লে,/ সেই দিনে গা টের পাবা/ মন সহজে কি সই হবা।/ বাহার তো গেছে চলে, পথে যাও ঠেলা পেড়ে/ কোন দিনে পাতাল ধাবা।/ তবু দেখি গেল না তোর ত্যাড়া চলন বদ লভা।/ সুখের আশ থাকলে মনে/ দুখের ঘোর নিদানে তুমি / অবশ্য মাথায় নিবা,/ মন সহজে কি সই হবা।/ সুখ চেয়ে সোয়াস্তি ভাল/ শেষ কালেতে পস্তাবা,/ মন সহজে কি সই হবা।/ ইল্লতে স্বভাব হলে/ পানিতে যায় রে ধুলে/ খাচলতি কিসে ধুবা।/ লালন বলে হিসাব কালে সকল ফিকির হারাবা তুমি সকল ফিকির হারাবা,/ মন সহজে কি সই হবা/।”
সরকারের বোধহয় এখন সই হবার সময় হয়ে এসেছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন