শাপলা চত্বরের ম্যাসাকার এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এটিকে গণহত্যা, হত্যাকা- বা যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, ৫ মে সারাদিনের ঘটনাবলী এবং মধ্যরাতের ক্র্যাকডাউন সম্পর্কে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের জনগণের মাঝে একটি পাবলিক পারসেপসন বা সাধারণ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এই ধারণার অপনোদনের জন্য সরকার, আধা সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের মাঠে নামিয়েছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বেনজির আহমেদ, বিজিবি মহা-পরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশের মহা-পরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার টেলিভিশনে এবং সংবাদ কর্মীদের কাছে এসে পুলিশ, বিজিবি এবং র্যাবের অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন। কিন্তু তাদের ব্যাখ্যা জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। তাই ঐসব ব্যাখ্যা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি থেকে কোন রূপ রাখঢাক না করে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে যে, তারা পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব প্রধানদের বক্তব্য বিশ্বাস করেন না। এ ব্যাপারে সুধী মহলের প্রশ্ন :
সমগ্র বিষয় ছিল রাজনৈতিক। মতিঝিলে মধ্যরাতের অপারেশন করাটাও ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সুতরাং যা কিছু ঘটেছে সেগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক নির্দেশের ফলেই ঘটেছে। সেক্ষেত্রে কোন বক্তব্য যদি দিতেই হয় তাহলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের ব্যাখ্যা দেবেন। কিন্তু তা না করে তারা বিজিবি বা বর্ডার গার্ড, র্যাব এবং পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তাগণকে মাঠে নামিয়েছেন কেন?
পুলিশের আইজি, বিজিবি প্রধান অথবা র্যাব প্রধান কি সরকারি হুকুম এবং সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে কোন কথা বলতে পারবেন? এই সরকারের আমলে শুধুমাত্র নিম্ন আদালত নয়, উচ্চ আদালতের দারুণ রকম রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। যেখানে গরীব মানুষ এবং সাধারণ মানুষের কাছে ন্যায় বিচার পাবার শেষ ভরসা হলো উচ্চ আদালত বা সুপ্রীম কোর্ট সেখানে সেই সুপ্রীম কোর্টে ঢালাওভাবে একের পর এক বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে দেয়া হচ্ছে যারা আওয়ামী লীগের ডাই হার্ড সমর্থক। এখনতো অনেক মানুষ টিটকারী করে বলছেন যে সুপ্রিম কোর্ট হয়ে গেছে আওয়ামী সুপ্রিম কোর্ট।
আইন শৃঙ্খলা
বাহিনীতে রাজনীতি
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে কোন অবস্থায়ই রাজনীতি বা দলীয় স্বার্থে অফিসারদের রিক্রুট করা উচিত নয়। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহে হাজার হাজার জওয়ান এবং অফিসারদের নিয়োগ দিয়েছে প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনায়। এগুলোর ফলে যা ঘটবার তাই ঘটছে। দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ হয়েছে এখন বিরোধী দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীদের দমন। এ দমনের তালিকায় অতি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম।
বিগত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে নির্বিচারে হত্যাকা- শুরু হয়েছে। ইতোপূর্বে জামায়াতে ইসলামের আন্দোলনকালে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির গুলী বর্ষণে অন্তত দেড় শতাধিক নেতা কর্মী এবং সমর্থকদের হত্যা করা হয়েছে। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ হলেন সাধারণ মানুষ। অথচ এতো মানুষকে হত্যা করার পরেও সরকার এখন পর্যন্ত একটিও প্রেসনোট জারি করেনি। অথচ ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের কালো রাতে যে সামরিক অভিযান চালানো হয়েছিল তারপর সেই অভিযান সম্পর্কে সরকার শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল। এই ধরনের শ্বেতপত্র জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতেও পারে নাও হতে পারে, সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। কিন্তু পরবর্তীতে সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষের আলোচনা সমালোচনা বা সমর্থনের ভিত্তি হতে পারে ঐ ধরনের শ্বেতপত্র।
৫ তারিখ দিবাগত গভীর রাতে শাপলা চত্বরে যে মিডনাইট অপারেশন চালানো হয়েছে সে ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে একটি প্রেসনোট জারি করা উচিৎ ছিল। প্রেসনোটের অনুপস্থিতিতে আজ গুজবে বাতাস ভরপুর । সেই গুজব আবার ডালপালা বিস্তার করা শুরু করেছে। ঐ অপারেশনের সূত্র ধরে আজ আহত এবং নিহত নিয়ে নানান পরিসংখ্যান শোনা যাচ্ছে। আমরা জানি না, ঐ অপারেশনে কত লোক নিহত হয়েছেন বা আহত হয়েছেন। কিন্তু ঐ পরিসংখ্যান ১১ থেকে শুরু করে ৩০০০ পর্যন্ত ওঠা নামা করছে। কোনটা সত্যি সেটি জানেন একমাত্র আল্লাহ মাবুদ। বাতাসে এ কথাটি ভেসে বেড়াচ্ছে যে, লাশ গুম করার জন্যই রাতের গভীর অন্ধকারকে বেছে নেয়া হয়েছিল। সেজন্যই শোনা যাচ্ছে যে সরকারি এবং আধাসরকারি সংস্থাসমূহের অনেক ট্রাক নাকি সেদিন গভীর রাতে শাপলা চত্বরে আনা হয়েছিল। ঐসব ট্রাকে করে নাকি লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আরো কতো কথা বাজারে ভেসে বেড়াচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, ঐ সব লাশ বিজিবি গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকানো হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর ক্যাম্পে যে সেনা অফিসার নিহত হয়েছেন সেই নিহত সেনা অফিসারদের অনেকের ঐ লাশ ম্যানহোল দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল ঐ সব লাশের অনেকগুলো ম্যানহোল দিয়ে ভাসতে ভাসতে বুড়িগঙ্গা নদীতে পাওয়া গিয়েছিল। এবারও শোনা যাচ্ছে যে হেফাজতের অনেক আলেম ওলামার লাশ এভাবে বিভিন্ন জায়গায় ডাম্প করা হয়েছে এবং ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে।
॥ দুই ॥
প্রিয় পাঠক এবং দেশবাসী, এই মুহূর্তে সঠিকভাবে বলা মুসকিল যে ৫ মে সকাল ১২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কত লোক নিহত হয়েছেন। আবার গভীর রাতের অপারেশনে কত লোক নিহত হয়েছেন। কিন্তু কেন ঐ অপারেশনের প্রয়োজন দেখা দিল, সে কথাটি সরকার ব্যাখ্যা করছে না । অথচ সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হয়েছে যে শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হেফাজতের লাখ লাখ লোকের সমাবেশ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। সমাবেশে একটিবারের জন্য বিন্দুমাত্র বিশৃঙ্খলা বা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে বলে কোন মহল থেকে বলা হয়নি। এ কথাও সকলে বলেছেন যে, পুরানা পল্টন থেকে বায়তুল মোকাররম হয়ে দৈনিক বাংলা মোড় পর্যন্ত যে সহিংসতা চলছিল, তাদের লাশ শাপলা চত্বরে আসে। সহকর্মীদের লাশ দেখে সমবেত আলেম ওলামারা শোকে দুঃখে ক্রন্দন করেন। তারপরেও কিন্তু হেফাজতের জনতারা উত্তেজিত হয়ে পুরানা পল্টন, দৈনিক বাংলা মোড় এবং বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ঘাতকদেরকে ধাওয়া করা বা শায়েস্তা করার জন্য ছুটে যাননি। কল্পনা করুন, যদি মঞ্চ থেকে সেই হুকুম দেয়া হতো তাহলে লাখ লাখ লোক সেখান থেকে ছুটে গিয়ে হামলাকারী এবং ঘাতকদেরকে মেরে তক্তা বানাতে পারতো। এতো বড় উত্তেজনার মুখেও যারা ধৈর্য্য এবং সংযমের পরিচয় দিল তাদের ওপর মধ্যরাতের সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করতে হলো কেন? আর সেই অভিযানে পুলিশের সাথে সাথে শুধুমাত্র র্যাব নয়, বিজিবিকেও নামাতে হলো কেন? এমন শান্তিপূর্ণ সমাবেশে এমন কি ঘটেছিলো যে ২০ হাজার সদস্যের সশস্ত্র যৌথবাহিনী দিয়ে ২৫ শে মার্চের পাকবাহিনী স্টাইলে একটি মারাত্মক ক্র্যাকডাউন করতে হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর যতদিন না মিলছে ততদিন গুজবের পাখায় ভর করে নানান ধরনের কথাবার্তা দশ দিগন্তে ছড়াতেই থাকবে।
॥ তিন ॥
আফসোস লাগে যখন দেখি যে আমাদের মিডিয়া এখন সরকারের খয়ের খাঁ হয়ে গেছে। আমেরিকা যখন আফগানিস্তান বা ইরাকের মত পররাজ্যে সামরিক অভিযান চালায় তখন তাদের সেই নাজায়েজ কাজকে জায়েজ করার জন্য একশ্রেণীর সাংবাদিককে মার্কিন হানাদাররা সাথে করে নিয়ে যায়। এদের কাজ হলো হানাদার বাহিনীর হামলার সাফাই গাওয়া। ইংরেজিতে এটিকে বলা হয় ঊসনবফফবফ লড়ঁৎহধষরংস .এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সর্বত্র ঊসনবফফবফ লড়ঁৎহধষরংস এর ছড়াছড়ি। এ ব্যাপারে গত শুক্রবার একটি বাংলা সহযোগী প্রথম পৃষ্ঠায় একটি রিপোর্ট করেছে। রিপোর্টটির শিরোনাম, সব চ্যানলেই বটিভিি ! ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের সব বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো এখন কার্যত বিটিভিকরণ হয়ে গেছে। সরকারের মালিকানাধীন বিটিভি যেমন সরকারের তোয়াজ এবং সরকারের পছন্দের খবর প্রচার করে থাকে বর্তমান প্রায় সব স্যাটেইলাইট টেলিভিশন সেটাই করছে। বিটিভির এক সময়ের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ‘বিবি গোলাম’ এবং ‘বাপ বেটির’ বক্সের দুর্নাম এখন বেসরকারি চ্যানেলগুলো নিয়ে করা হচ্ছে। সরকারকে খুশি করতে অতি ‘তোষামোদী’করণ নীতি গ্রহণ করছে বেসরকারি চ্যানেলগুলো। সরকারকে খুশি করতে অনেক সময় বিটিভিকে হার মানাচ্ছে এসব চ্যানেলের খবর। বাঁশের চেয়ে যেন কঞ্চি বড়। খবরের কারণে গত কয়েক বছর স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো যে জনপ্রিয় হয়ে উঠে তাতে এখন ভাটার টান ধরেছে। বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা অনেকেই বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেলগুলোর খবর দেখা কমিয়ে দিয়েছেন। বরং প্রকৃত তথ্য পেতে আল জাজিরা, সিএনএন, বিবিসির খবর বেশি দেখছেন ও শুনছেন। খবরের কারণে বেসরকারি চ্যানেলগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠায় বিগত দিনগুলোতে বিবিসির বাংলা শ্রোতার সংখ্যা কমে গিয়েছিল যার কারণে বিবিসির অনেক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এখন বেসরকারি চ্যানেলগুলোর বিটিভিকরণ হওয়ায় দর্শকদের কাছে খবরের গ্রহণযোগ্যতা হারাতে থাকে। বিশেষ করে মতিঝিলের বিজিবি-র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানের হত্যা নিয়ে। প্রকৃত তথ্য, তুলে ধরার বদলে চ্যানেলগুলো বিটিভির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারকে খুশি করতে মরিয়া হয়ে উঠে।
বাস্তবতার কারণেই সরকারি প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন সরকারের গুণকীর্তন করতে ব্যস্ত থাকে। দর্শক প্রত্যাশিত খবর না পাওয়ায় বিটিভির জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় চলে যায়। এরশাদের শাসনামলে বিটিভিকে ‘সাহেব বিবি গোলামের’ বাক্স বলা হতো। ‘৯০ পট পরিবর্তনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়। ‘বিবি-গোলামের’ বাক্স। অতঃপর ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সে নামও পরিবর্তন হয়। বিটিভিকে তখন বলা হতো ‘বাপ-বেটির’ বাক্স। সরকারের গুণ-কীর্তনের কারণে তিরস্কার করে বিটিভির এ নামকরণ করে মানুষ। দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো চালু হওয়ার পর বিটিভি দেখা মানুষ এক প্রকার ছেড়েই দেয়। নি¤œ আয়ের যারা ডিশের মাসিক ভাড়া দেয়ার সংগতি নেই তারাই বিটিভি দেখতেন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কৌশলে বিটিভির খবর স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারের কাছ থেকে কিছু সুবিধা নিয়ে কিছু চ্যানেল বিটিভির খবর সরাসরি প্রচার করে। কিন্তু ৬ মে মতিঝিলের প্রথম প্রহরের ভয়ঙ্কর ঘটনা চ্যানেলগুলো ধামাচাপা দেয়ায় ফেসবুক, টুইটার, অনলাইন মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চ্যানেলগুলোর কঠোর সমালোচনা করা হয়। বিভিন্নজন দেশের বেসরকারি চ্যানেলগুলোকে বিটিভির নতুন সংস্করণ হিসেবে অভিহিত করে খবর দেখার আগ্রহ হারিয়েছেন বলে জানান। এই পটভুমিতে সত্য খবর পাওয়া দেশের মানুষের জন্যে এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন