সাভারের যুবলীগ নেতার মালিকানাধীন রানা প্লাজার মরণযজ্ঞে আমার কোনো রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় মারা যায়নি। ফলে যে কেউ সঙ্গত কারণে প্রশ্ন করতে পারে যে, কোথাকার ক’টা গরিব মানুষ একটি ভবন ধসের দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করল, তাতে তুমি এমন করুণ কাব্য রচনা করতে বসেছ। কিন্তু বাংলাদেশ ভূখণ্ড, ভূপ্রাকৃতিক কারণে এমন এক জনপদ যেখানে প্রতিটি মানুষই পরস্পরের আত্মীয়। এই আত্মার বন্ধন ছাড়া বাংলাদেশ বদ্বীপে কোনো মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকা সম্ভব ছিল না।
এই জনপদের মানুষ এবং প্রাণী প্রজাতি পরস্পরের সাথে এতই ঘনিষ্ঠভাবে সঙ্ঘবদ্ধ যে, এখানে টিকে থাকার সংগ্রাম সবাই মিলেই। এভাবেই আমরা হাজার হাজার বছর ধরে এই জনপদে টিকে আছি। এখানকার মানুষ কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এখানে পাহাড় আছে। বিশাল সমুদ্রসৈকত আছে। সমুদ্রের সাথে লড়াইয়ের ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। আমরা জলের ভেতর থেকে জীবনের ঐশ্বর্য কেড়ে আনব। সব মানুষ পদ্মায় মাছ ধরতে যায়নি। কিন্তু ইলিশ আমাদের রসনা তৃপ্তির খাদ্য। সব মানুষ বালাম কিংবা চিনিগুঁড়া চাল ফলাই না। কিন্তু উৎসবে আয়োজনে আমরা কিনি। যারা ইলিশ ধরে কিংবা বালাম-চিনিগুঁড়া ফলায়, তারা আমাদের নিকট আত্মীয়। তাদের কোনো দিন দেখিনি। কিন্তু তাদের ছাড়া যে আমাদের চলেও না।
যে শ্রমিক সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী গার্মেন্ট শিল্পে কাজ করে তাদের সবাইকে আমরা চিনি না। কিন্তু তারা কাজ করে বলেই বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। সেই অর্থে আমরা কেউ কেউ সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করে ভোগী জীবনযাপন করি। তাতে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আসে। ভিন্ন কারখানা স্থাপিত হয়। সেখানে আমাদের কর্মসংস্থান হয়। কিংবা এই যে আমি একজন তুচ্ছ সাংবাদিক হিসেবে বেঁচে আছি, তার পেছনেও আমার আত্মীয় গার্মেন্ট কর্মীদের কোনো-না-কোনো অবদান আছে।
কিন্তু আমাদের মধ্যে যারা শাসন ক্ষমতায় থাকি, তারা প্রায়ই এই চরম সত্যটি ভুলে যাই। কোথায়ও না কোথায়ও এই জনপদের মানুষ পরস্পর নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে ধারাবাহিকভাবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। বঙ্গোপসাগর তেমনি আর এক নিদর্শন। বে আর গালফ বাংলায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ইংরেজিতে এর ভিন্ন অর্থ। বে হলো সেটাই যেটা ত্রিভুজের কোণাকৃতির মতো। এটি এক জায়গায় গিয়ে থেমে যায়। কিন্তু গালফ এ রকম নয়। গালফ হলো, বহু দূর বিস্তৃত সম্ভাব্য জলধারা, যেখানে ঘূর্ণিবায়ু আঘাত করলে এর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে তার আর কোনো শক্তি থাকে না। কিন্তু বে-তে যখন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, তখন তা প্রচণ্ড বেগে উপকূল তছনছ করে দেয়। বিধ্বস্ত হয় সংশ্লিষ্ট গোটা জনপদ।
এটি তো সমুদ্রের কথা। কিন্তু নদীমাতৃক বাংলাদেশে আরো কাছের কথা আছে। সেটি হলো, পরস্পর নির্ভরশীলতা। বাংলাদেশের নদীতে অবিরাম ভাঙা-গড়ার খেলা চলে। আমাদের সঙ্গীত হলো, ‘নদীর এপার ভাঙে, ওপার গড়ে/এই তো নদীর খেলা।’ প্রতি বছর নদ-নদীগুলো শত শত জনপদ তছনছ করে দিয়ে যায়। সাজানো সংসার, গরু-বাছুর, শস্যক্ষেত্র সবকিছু গ্রাস করে নেয় নদী। যারা জীবিত থাকেন, তারা পরস্পরে সহযোগিতায় ওপারের নতুন চরে গড়ে তোলেন নতুন বসতি। সে ক্ষেত্রে এই বসতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিনা মজুরিতে এই জনপদের মানুষ একে অপরের জন্য শ্রম দেন। এ তো হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে।
কিন্তু আমি আমার কৈশোরে এ আশ্চর্য ঘটনা দেখেছি। তখন ফারাক্কা বাঁধ হয়নি। সব নদীর উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যায়নি। আষাঢ়ে শুকনো খালে কোথা থেকে যেন বন্যার পানি আসতে শুরু করত। সে পানির সাথে আসত তিতপুঁটি, ট্যাংরা, ছোট টাকি মাছ। আমরা গামছা দিয়ে কিংবা হাত বড়শি দিয়ে সেসব মাছ ধরে আনন্দে খলবল করতাম। কিন্তু এই পানির সাথে নতুন বিপদও আসত। তা হলো, পাকা, আধাপাকা কিংবা থোড় ধানের জমি ডুবে যাওয়া। এই পরিস্থিতি যখন হতো, তখন হিন্দু, মুসলমান, ব্রাক্ষ্মণ, শূদ্র, মুচি, চাড়াল তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখিনি। তারা সবাই একযোগে ওই ফসল কেটে জমির মালিকের ঘরে তুলে দিতো। বিনিময়ে সাধ্য থাকলে মালিক পাতলা ঝোলের গরু কিংবা মুরগির গোশত দিয়ে, সাধ্য না থাকলে ডাল-ভাত দিয়ে এবং আরো দরিদ্র হলে কিছুই না দিয়ে শুধু পরস্পরকে আলিঙ্গন করে অশ্রুসিক্ত হৃদয়ে বিদায় দিতো। ব্রাক্ষ্মণের শস্যক্ষেত্র ডুবলে যেমন শূদ্র হাত লাগাত, তেমনি শূদ্রের জমি ডুবলে ব্রাক্ষ্মণ হাত লাগাত। সম্ভবত এখনো লাগায়। এটাই আমার স্বদেশ। এটাই বাংলাদেশ।
আর সে কারণেই সাভারের রানা প্লাজায় যে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তারা সবাই আমাদের আত্মার আত্মীয়। তাদের শোকে আমাদেরও বুক ভারী হয়ে আসে। এরা আমার কেউ না হোক, আমার স্বজন স্বগোষ্ঠীর লোক। বাংলাদেশ একটি গোষ্ঠী। আমরা ভেদাভেদ জানি না। আমরা ভেদাভেদ শিখিনি।
কিন্তু ভেদাভেদ তৈরির এক আজব কল চালু করেছে সরকার। সেই ভেদরেখা সাভারের রানা প্লাজা থেকে গত ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সরকার এ দেশের মানুষকে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এ কথাও ভোলানোর চেষ্টা করছে যে, বাংলাদেশের মানুষ কেন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ভোট দিয়েছিল। আর কেনই বা তারা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করতে সশ্রস্ত্র যুদ্ধ করেছিল। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র, যেখানে মানুষ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কেন করেছে, কেন এই জনপদের মানুষ আলাদা জাতি হয়ে উঠল, সেটি কেউ ভাবার চেষ্টা করছে না। কিংবা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
এই জনপদের মানুষ যদি মুসলমান না হতো তাহলে তাদের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির কোনো প্রয়োজনও হতো না বা সে জন্য ভোটের আয়োজনও করতে হতো না। পূর্ববঙ্গ বর্তমানে যা বাংলাদেশ, তার বাসিন্দারা প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু জমিদারদের উপনিবেশ ছিল। কলকাতার বাবুদের ভোগ বিলাসের সব কিছু জোগান দিতো পূর্ব বাংলার মানুষ। তিরিশের দশকে যখন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ভোটের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী হলেন তখনই তিনি পূর্ব বাংলার মানুষদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিলেন। সেই ইতিহাস কেউ পড়ে না। পড়ানোরও প্রয়োজন বোধ করে না বর্তমান সরকার। অর্থাৎ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের যে ইসলামি ভিত্তি, তা ধ্বংস করায় তৎপর হয়ে উঠেছে তারা।
এখন দাবি উঠেছে, এই রাষ্ট্র থেকে ইসলামের ভিত্তিকে মুছে দিতে হবে। ইতঃপূর্বে যে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে সে কারণেই এখান থেকে ইসলামের ভিত্তি নির্মূল করা সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার মনে করছে, ইসলামই তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারুণভাবে ইসলামভক্ত। ভোরবেলা উঠে নামাজ পড়েন। তারপর কুরআন তেলাওয়াত করেন। তারপর দিনের কর্মসূচি শুরু করেন। আহাদিত হওয়ার মতো খবরই বটে। কিন্তু তার শাসন কিছুতেই প্রমাণ করে না যে, ইসলাম বিষয়ে তার ন্যূনতম শ্রদ্ধাভক্তি আছে। তারই নেই নাকি তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নেই, সেটা পরিমাপ করা কঠিন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, বর্তমানে যেসব সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে তিনি চলছেন, তাদের বেশির ভাগই ইসলামের নাম শুনলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন।
সে প্রক্রিয়ায় শাহবাগ চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচির বিরুদ্ধে এক নারকীয় অভিযান চালানো হলো। তাদের দাবি ছিল ১৩ দফা। কিন্তু সে দাবি এক নম্বরে ছিল সংবিধানের আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন। এর দাবিকে কোনো মতেই অসঙ্গত বলা যাবে না। ১৯৭৫-৭৬ সাল থেকেই এটি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার জন্য ১৯-২০ কিছুই হয়নি। সব কিছুই তো স্বাভাবিকভাবে চলছিল। তাহলে এই সরকারের এমন কী দায় পড়ল যে, আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস তাকে অস্বীকার করতে হবে। যদি আল্লাহর ওপর অস্বীকার করতে পারে, তাহলে এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করা হচ্ছে। হেফাজত সম্ভবত সে কথাই বলতে চেয়েছিল।
কিন্তু গত ৫ মে হেফাজত যখন শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিল এবং সারা দিনের কান্তি শ্রান্তিতে ১০ লাখ লোকের প্রায় অর্ধেকই ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন সরকারি বাহিনী সেই নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর একেবারেই যেন হামলে পড়ে। সে দৃশ্য ‘লাইভ’ দেখানো হচ্ছিল বলে, বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন। এ এক দারুণ গণতন্ত্র বটে। হেফাজতে ইসলামের সমর্থক কোটি কোটি মানুষ। এরা কওমি মাদরাসাভিত্তিক অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এদের উৎখাতের জন্য কত লোককে খুন করা হয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য রয়েছে। কেউ বলছেন, তিন হাজার, কেউ বলছেন, আড়াই হাজার। সরকার বলছে কিচ্ছু না।
তা যদি না-ই হবে, তাহলে ঢাকা থেকে কাচপুর যেতে-না-যেতেই আবার কেন সংঘর্ষ বাধল? এবং এই সংঘর্ষের ভয়াবহতা এতই প্রকট ছিল যে, সেখানে পুলিশ-বিজিবিসহ ১৯ জন মারা গেল। হাটহাজারীতে পুলিশ-বিজিবি-র্যাবের গুলিতে খুন হলো আরো ছয়জন। বাগেরহাটে আরো দুই। ৬ মে ভোরে কেন সিটি করপোরেশনের হোসপাইপ দিয়ে ইসলাম চেম্বার থেকে শাপলা চত্বর, শাপলা চত্বর থেকে ইত্তেফাক ভবন পর্যন্ত ধুয়ে ফেলা হলো, সে প্রশ্ন সাধারণ মানুষের।
কিন্তু এরা সবাই আমার আত্মার আত্মীয়। সাভার থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত যারা প্রাণ হারাল, তাদের শোকে নিথর হয়ে গেছি। স্তব্ধ হয়ে গেছে প্রাণ। যেন কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। এখন মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা, আমাকে এই শোক বইবার ক্ষমতা দাও।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন