৫ মে শাপলা চত্বরে কী ঘটেছিল তা নিয়ে এখনও জল্পনা-কল্পনা অব্যাহত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে গত ১৬ মে দৈনিক ইত্তেফাকে একটি রিপোর্ট মুদ্রিত হয়। রিপোর্টে নিউজ চ্যানেল আল-জাজিরার বরাত দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে ৫ মে মধ্যরাতে হেফাজত বিরোধী অভিযানে মৃত্যুর বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ভুল তথ্য দিয়েছে। নিহতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ সরকার। আল-জাজিরার তদন্তে এবং প্রাপ্ত ভিডিও ফুটেজের ভিত্তিতে একথা জানিয়েছে নিউজ চ্যানেলটি। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, হত্যার পর টেনে টেনে গাড়িতে লাশ তোলা হচ্ছে। আল-জাজিরা এমন এক সময়ে খবরটি প্রকাশ করলো, যখন শাপলা চত্বরে ৫ মে মধ্যরাতে ঘুমন্ত হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে ঠিক কত মানুষ হতাহত হয়েছেন তা নিয়ে চলছে বিতর্ক।
বাংলাদেশ সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানাবধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে কতজন মারা গেছে তার সঠিক সংখ্যা পরিষ্কার নয়। স্বতন্ত্র সংবাদ সূত্রগুলো বলছে, এ ঘটনায় অন্তত ৫০ জন নিহত হয়েছে। আহত অনেকেই পরে মারা গেছে বলে গত শনিবার দেয়া বিবৃতিতে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস নিহতের সংখ্যা ২৫০০-এর বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে। এদিকে ঢাকার জুরাইনের আব্দুল জলিল নামে মুক ও বধির এক কবর খননকারী ইশারায় ইঙ্গিতের ভাষায় আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, হেফাজতের বিরুদ্ধে অভিযানের পর তিনি এক রাতে ১৪টি লাশ দাফন করেছেন। এসব লাশের দাড়ি ছিল এবং এদের দেহে বন্দুকের গুলীর চিহ্ন পাওয়া গেছে। এদিকে ৫ মে রাতে ঠিক কী ঘটেছিল তা জানার জন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। সব মিলিয়ে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা না করে সরকার ১১ জনের মৃত্যুর যে তথ্য দিয়েছে তা সঠিক বলে বিবেচনা করা যায় না। এ কারণেই হয়তো আল-জাজিরা বলেছে, ৫ মে মধ্যরাতে হেফাজত বিরোধী অভিযানে হতাহতের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ভুল তথ্য দিয়েছে। আমরা মনে করি, ৫ মে’র ঘটনার ভয়াবহতা ও হতাহতের বিষয় নিয়ে দেশে বিদেশে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করার লক্ষ্যে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সঠিক তথ্য মানুষের সামনে স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এতেই দেশের ও সরকারের মঙ্গল।
সবাই জানে যে, ইসলাম অবমাননাকারী নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে হেফাজতে ইসলাম গত ৫ মে ঢাকা অবরোধ করে। সরকারের অনুমোদনের ভিত্তিতে সংগঠনটি শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে। হেফাজতের লাখ লাখ কর্মী রাতে ঐ এলাকায় থেকে যায়। হেফাজতের নেতৃবৃন্দ বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা শাপলা চত্বর ত্যাগ করবেন না। প্রসঙ্গত এখানে ঢাকার আরেকটি ব্যস্ত চত্বর শাহবাগের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে একদল তরুণ সেখানে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেছিল। তারাও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগ চত্বর ত্যাগ না করার ঘোষণা দেয়। তবে অবাক ব্যাপার হলো, তখন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী দিনের পর দিন সেখানে সর্বাত্মক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে এবং শাহবাগ চত্বরে চারপাশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। অবস্থান ধর্মঘটকারী তরুণদের জন্য তিনবেলা খাবার, এমনকি ভ্রাম্যমাণ টয়লেটেরও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু শাপলা চত্বরের বেলায় তা হয়নি। সরকার হেফাজত কর্মীদের ২৪ ঘণ্টাও সহ্য করেননি। ‘ফ্লাশ আউট’ সাংকেতিক নামে নির্মম অপারেশন চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, গত ৫ মে গভীর রাতে বাতি নিভিয়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সাদা পোশাকের অস্ত্রধারীরা স্মরণকালের নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের নেতারা বলেছেন, ঘুমন্ত ও প্রার্থনারত কর্মীদের ওপর গুলী চালিয়ে কমপক্ষে ৩০০০ লোককে হত্যা করা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, শাহবাগ চত্বর এবং শাপলা চত্বরের ঘটনায় সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। একপক্ষের সাথে প্রশ্রয়ের আচরণ আর অপরপক্ষের সাথে নির্মম আচরণ। অন্যদিকে হেফাজতের সংবাদ প্রচারের দায়ে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয় সরকার। অথচ দিনের পর দিন শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনকারীদের সংবাদ প্রচারে বাড়াবাড়ি ও উস্কানিমূলক তৎপরতার পরেও কোনো টিভি চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করেনি সরকার। সরকারের এমন পক্ষপাতমূলক আচরণে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। অথচ অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী হয়ে দেশ শাসন না করার ব্যাপারে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শাহবাগ চত্বর ও শাপলা চত্বরের ঘটনায় সরকার যে শুধু প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছে তা নয় বরং শাপলা চত্বরকে রঞ্জিত করেছে রক্তে। তাই ৫ মের ঘটনা জনমনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, যা ভুলবার নয়। সরকার বিষয়টি কতখানি উপলব্ধি করে জানি না, তবে আগামী দিনে সরকারের আচরণ থেকে উপলব্ধি করা যাবে ৫ মে’র ঘটনা থেকে সরকার কোনো শিক্ষা নিয়েছে কিনা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন