সাভার দুর্ঘটনার রেশে রাজনীতি থমকে ছিল কিছুদিন। পুরো জাতি, এমন কি, বিশ্বও স্তম্ভিত হয়েছিল। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাভারের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আর যুবলীগ নেতা রানাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে আম-জনতা পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন। কার মন্তব্য কেমন হয়েছে, সেটা স্বব্যাখ্যাত। নতুন করে বলার কিছু নেই। সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কথা বলেছেন। এটাই স্বাভাবিক। তবে কথা আর সত্যের মধ্যে বিপুল ফারাক হলেই সমস্যা। কথা বলার আগে এ ব্যাপারে মনোযোগী হওয়াই ভালো। প্রধান বিরোধী জোট বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১৮ দল সাভারের উদ্ধার কার্যের স্বার্থে হরতাল প্রত্যাহার করে ইতিবাচক ও মানবিক নজির স্থাপন করেছেন। যদিও তারা নিজেরাই সরকারের অমানবিক আচরণ, মামলা, হামলায় পর্যুদস্তু বলে অভিযোগ করে থাকেন। তথাপি নিজেদের উপর নির্যাতন মেনে এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের পথে সাভারের ঘটনাকে তারা মূল্য দিয়ে যথার্থ মানবিকতা ও জনদরদের প্রমাণ রেখেছেন। এখন সরকার উদ্ধার, ত্রাণ ও আহত-নিহতদের পুনর্বাসনের কাজে যথেষ্ট মানবিকতা আর দরদের ছাপ রাখতে পারলেই ভালো। নচেৎ বিরোধী দলের পক্ষে দেয়া সুবিধার রাজনৈতিক স্বার্থটুকুই গ্রহণ করা হবে; মানবিক দায়িত্ব পালন হবে না।
এদিকে মে মাস শ্রমিক শ্রেণীর অধিকারের ডাক দিয়ে অতীতের মতো পালিত হতে পারেনি। এবার সেটা পালিত হয়েছে শোক, হতাশা ও বেদনায়। মে মাসের প্রথম দিন শ্রম দিবস যা-ই বলুক না কেন, শ্রমজীবী, দুর্বল ও অবহেলিতদের বঞ্চিত ও নিগৃহীত হওয়াই এখন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের মূল ভূখ-ে বার বার মৃত্যু ও বিপদের মুখে পতিত হচ্ছে পোশাক শিল্পের নিরীহ শ্রমিকগণ। তারা মরছে এবং এখন তাদের কারখানাগুলোও ভাঙচুর করা হচ্ছে। শাঁখের করাতে এদিক-ওদিক-সবদিক দিয়ে কাটছে পোশাক শিল্প আর পোশাক শ্রমিকের রুটি-রুজি-ভাগ্য। গরিব ও বিপন্নদের প্রতি এত অবহেলা সহ্যের সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ এই গরিবরাই দেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। তাদেরকে রক্ষা করার বদলে পোকা-মাকড়ের মতো মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। সরকার ও মালিক পক্ষ যত কথা বলেছে, শ্রমিক স্বার্থে কাজ করেছে ততই কম। এজন্যই সাভারের রানা, তাজরিন, স্পেক্ট্রাসহ বহু দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় হাজার-হাজার নারী-পুরুষ শ্রমজীবী মানুষ নিহত-আহত-নিখোঁজ হয়েছেন। বেঁচে থাকার আশায় গ্রাম থেকে শহরে আসার মানুষরা এভাবেই অকাতরে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে।
শোকের মধ্যেই রাজনৈতিক অঙ্গন আবার উত্তপ্ত হওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে। আগামী ৫মে হেফাজতে ইসলামের পূর্বঘোষিত ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি। গত ৬ এপ্রিল ঢাকায় লংমার্চ শেষে মহাসমাবেশে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবি মেনে নেয়ার জন্য এক মাসের সময় নির্ধারণ করে দেয়। ১৩ দফা মানার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বরং এর বিরোধিতাকারীরা প্রবলবেগে বিঘœ সৃষ্টি করছে। হেফাজত দেশব্যাপী সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তাদের ঘোষিত ১৩ দফার পক্ষে সুস্পষ্ট জনমত গঠন করলেও সরকার পক্ষে এসব নিয়ে কোনও আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের আভাস দেয়া হচ্ছে না। ফলে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন তাদের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী এগিয়ে চলেছে।
সরকার হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রতি কোনও সাড়া বা মনোযোগ না দিলেও সরকারকে সমর্থন করে, এমন কিছু কিছু গোষ্ঠী হেফাজতের দাবির বিরোধিতায় সদা ব্যস্ত। যেমন বেদায়াতপন্থী-জনবিচ্ছিন্ন-ধর্ম ও মাজার ব্যবসায়ী আলেম (?) সমাজ এবং বিদেশি টাকায় পুষ্ট এনজিও। একদল মুখে ইসলামের কথা বললেও অন্যদল নাস্তিক্যবাদ ও সেক্যুলারিজমের পূজারী। এমন বিপরীত মেরুর পক্ষগুলোও এখন একাট্টা। এমন মজার ও মধুর মিলন বাংলাদেশে আগে আর কখনও হয়েছে বলে জানা যায়নি। বিরোধিতাকারীদের মধ্যে নিজস্ব পার্থক্য থাকলেও হেফাজতের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার। এদের মতলব পরিষ্কার। ইসলামের মূল আদর্শ ঠেকানোই এদের এজেন্ডা। দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিজেদের ধর্মের স্বাধীনতা ও বিকাশ লাভ করুক, এটা এই গোষ্ঠীগুলো চায় না। অতএব এরাও ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের বিরোধিতাকারী অপশক্তির তালিকায় স্থান পাবে।
গত মাসে হেফাজতের লংমার্চ ও মহাসমাবেশের সময় যে নজিরবিহীন বাধা দেয়া হয়, ছুটির দিনে হরতাল ডাকা হয়, সকল যানবাহন বন্ধ করে ঢাকাকে অবরুদ্ধ করা হয় এবং তারপরেও ঢাকায় লাখ লাখ মানুষের স্রোত তৈরি হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এবার হেফাজতকে আটকানোর জন্য কি করা হবে? কত বারই বা মানুষকে আটকানো যাবে? রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন এসব কথাই বহুলভাবে আলোচিত হচ্ছে। পাশাপাশি সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন অনেকেই।
জনতার মূলধারাকে বাধা দেয়া কখনওই সম্ভব হয় নাÑএটাই ইতিহাসের শিক্ষা। সাম্প্রতিক সময়ে শাহবাগ নাটক সাজিয়ে তৌহিদী জনতাকে আটকানো তো যায়-ই নি; বরং শাহবাগের অস্তিত্বই ধুলায় মিশে গেছে। এটা যে গণজাগরণের নামে কত বড় ভ-ামি ও ষড়যন্ত্র ছিল, সেটা আজ আর কারওই জানতে বাকী নেই। সামনের দিনগুলোতেও হটকারী বা অবিমৃশ্যকারিতার মাধ্যমে জনজোয়ারকে থামানো যাবে না এবং সে রকমের কোনও চেষ্টা করা হলে সেটা ব্যর্থ হবে। বরং বুমেরাং হয়ে উদ্যোক্তাদের জন্যই বিপদ-আপদ ডেকে আনবে। যেমন শাহবাগ বিপদ (একে ফেতনা নাম দেয়াই ভালো)। যাকে ফেলাও যাচ্ছে না, গেলাও যাচ্ছে না।
বস্তুতপক্ষে, বাংলাদেশের রাজনীতি সাম্প্রতিক সময়ে একটি স্পষ্ট সিগন্যাল জানিয়ে দিয়েছে। আর সেটা হচ্ছে, এদেশে ইসলাম রাজনৈতিকভাবে একটি অন্যতম প্রধান শক্তি। ইউরোপের খ্রিস্টান দেশগুলোতে যেমন ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেট বা লিবারেলরা ক্ষমতার প্রধান কা-ারীÑবাংলাদেশেও ইসলামই রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। গণতন্ত্রের পরীক্ষা বা ভোটের অঙ্কেও এ কথা প্রমাণিত সত্য। তবে অতীতে সামরিক স্বৈরাচারী বা অসৎ ক্ষমতাসীনরা ইসলামকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছে বটে; কিন্তু প্রয়োগ করেনি। এবার ইসলামী শক্তি নিজেই জাগ্রত হয়ে ইসলামকে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতিসহ সর্বস্তরে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। যথার্থ গণজাগরণ বলতে বাংলাদেশের এই ইসলামী গণজাগরণকেই বলতে হবে।
বাংলাদেশে ইসলামের রাজনৈতিক বিকাশের পিছনে কাজ করেছে ঐতিহাসিক বাস্তবতা। দিল্লির দাসত্ব ভাঙা আর পি-ির শোষণ মোচনের ঐতিহ্য থেকেই এমনটি হয়েছে। অতীতে সমাজতন্ত্র বা উগ্র জাতীয়তাবাদ দাসত্ব ও শোষণের প্রতিকার করতে পারেনি। মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাসকে রক্ষা করতে পারেনি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের দালালি করে উদাম সেক্যুলারিজমের মাধ্যমে নারী-পুরুষের বারোটা বাজিয়েছে। কিংবা ভারতীয় পৌত্তলিক শক্তির তাবেদারী করে বহুশ্বরবাদী আচার-আচরণ-প্রতীক-অনুষ্ঠান চাপিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সংস্কৃতি শোষণ ও দাসত্বের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা এবং চলমান আন্দোলন বাংলাদেশের মানব মুক্তির এক মহান আওয়াজ। হেফাজতে ইসলাম ধর্ম, সমাজ, রাজনীতির মূলস্রোতকে বিশুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক করতে চাচ্ছে। ইসলামের জন্য ছাত্র-যুব-গণ আন্দোলন দিনের পর দিন যে লড়াই-সংগ্রাম-ত্যাগ-তিতীক্ষা-নির্যাতন সহ্য করেছে, তার সঙ্গে আলেম সমাজের সম্মিলন আন্তর্জাতিক মিডিয়াসহ সর্বস্তরে নতুন শক্তির উত্থানরূপেই চিহ্নিত হয়েছে। এই গণশক্তির পেছনে দেশের সিংহভাগ মানুষের শ্রদ্ধা, সমর্থন ও ভালোবাসা পরিপূর্ণভাবে বিরাজমান।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্রিস্টবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চেষ্টা করে ইসলামকে ঠেকাতে। বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামের বিরুদ্ধে চলছে নানা আঘাত, ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যে ইসলামী গণশক্তি এতো প্রবলভাবে উত্থিত হবে, সেটা তাদের হিসাব-নিকাশ ও কল্পনার বাইরে ছিল। এ কারণেই তারা সাইনবোর্ডধারী আলেম(?) এবং নগ্নতাবাদী-এনজিওপন্থীদের লেলিয়ে দিয়েছে। প্রভুদের দালালি করতে গিয়ে এরা লক্ষ্য করছে না যে, তারা জনতার প্রধান অংশের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। এই পদস্খলনের জন্য এরা গণশত্রু ও দালালরূপে চিহ্নিত হবে। এদের কার্যক্রম মাঠ-ময়দান থেকে হটতে হটতে প্রভুদের আঁচলের নিচে চলে যাবে। বাংলাদেশে জনতার বিজয় মানে ইসলামের বিজয়; আর ইসলামের বিজয় মানে জনতার বিজয়Ñগণতান্ত্রিক সূত্রের এই অতি সরল কথাটি যারা বুঝতে পারবে না, তারা অচিরেই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এটা ইতিহাসের বিধান। ইতিহাসের বিধান অনুযায়ী সামনের দিনগুলোতে কে কোথায় থাকে, সেটাই দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন