বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০১৩

আইয়ামে জাহিলিয়ার যুগে পদার্পণ?


স্কুলজীবনে পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি এবং বিভিন্ন সময় মুরব্বিদের মুখে শুনেছি জাহিলিয়া যুগের ভয়াবহ ঘটনাবলি। ওই যুগে মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা বা মৌলিক অধিকার বলে কিছুই ছিল না। কেউ কাউকে খুন করলে কোনো বিচার হতো না। নারীদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তাদের ব্যবহার করা হতো পণ্যের মতো। মানুষ ছিল মদ আর জুয়া নিয়ে ব্যস্ত। বর্তমান এ সভ্য যুগে যেখানে দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশ মানুষের জানমাল ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে যুগান্তকারী পদপে নিচ্ছে, সেখানে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে চলছে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ। শুধু মুষ্টিমেয় লোকদের হাতে দেশের ১৬ কোটি মানুষের অধিকার আজ বন্দী। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন আজ দুনিয়া স্বীকৃত। এক দিকে দেশের সর্বত্রই নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্য দিকে দেশের নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা ও দেশ চালাতে চরম ব্যর্থতা সাধারণ মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলেছে।

দেশের মানুষের মনে কোনো শান্তি নেই, নেই কোনো আশার আলো। এ আতঙ্ক এখন প্রবাসে অবস্থানরত দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীদেরও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। ব্যক্তিগতভাবে চিনি এমন অনেক পরিবারই আছেন, যারা বছর শেষে দেশে যাওয়ার পুরো প্রস্তুতি নিয়েও গভীর শঙ্কার মধ্যে আছেন, আদৌ দেশে যাবেন কি না। আবার কিছু পরিবার যারা ব্যক্তিগত কারণে প্রতি বছর দেশে যেতে পারেন না; ফলে বহু বছর পর মনস্থির করেছিলেন এবার দেশে যাবেনই। দেশের এ করুণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি এবং জীবনের নিরাপত্তার অভাবে দেশপ্রেমিক প্রবাসী বাংলাদেশীরা আজ নিজের দেশেও বৃদ্ধ বাবা-মা, ভাই-বোন এবং নিকটাত্মীয়-স্বজনদের সাথে কয়েকটা দিন কাটানো অনেকটাই আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতোই মনে করছেন। এমতাবস্থায় জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের কী মনে করতে পারি, সৌভাগ্যবান নাকি অভাগা?
একটি দেশের সরকার তখনই সফল, জনগণের আস্থাভাজন, জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী, যখন তারা দেশের বেশির ভাগ নাগরিকের মাইন্ড রিড (মন পড়া/বুঝা) করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের মন জয় করবেন এবং নিশ্চিত করবেন যাতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। ১০০% সন্দিহান, বাংলাদেশের সরকার আদৌ ১০% নাগরিকের মাইন্ড রিড করতে পারছেন কি না। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের কোনো বিবৃতি বা মন্তব্যই কেউ শ্রদ্ধা বা আস্থার সাথে গ্রহণ করছেন না।
বর্তমান পরিপ্রেেিত বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বিবৃতি দিয়েছেন, ‘রাষ্ট্রীয় মতা পাগলদের হাতে চলে গেছে!’ সরকারদলীয় এমপি গোলাম মাওলা রনি বর্তমানে শিকাগোতে ইন্টার্নশিপ করছেন। আলজাজিরা ও সিএনএন চ্যানেলে সাভারের ঘটনাটি দেখার পর রনির মেন্টর (রনি যার অধীনে গবেষণায় রত) বললেন, তার (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর) বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে তিনি ঠিক নেই। এই যদি হয় মন্ত্রীর বুদ্ধি, তাহলে আমরা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কাকে বলব! আমাদের দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা দেশের ভাবমর্যাদা আর কিভাবে ডুবাবেন! গত বছর অর্থমন্ত্রী হলমার্ক কেলেঙ্কারির ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঘুষ কোনো টাকাই নয়। এভাবে বিভিন্ন মন্ত্রী এমপির আরো অনেক হাস্যকর উক্তি আছে, যা লিখে শেষ করা যাবে না।
উক্তিগুলো দেড় বছর আগে দেশে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের পরপরই সৃষ্ট কিছু জোকের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। জোকে সরকারি দল বলছে, ‘এইডা বিরোধী দলের নেতার এক নতুন ষড়যন্ত্র! তিনি দেশে অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন।’ অন্য দিকে বিরোধী দলের মন্তব্য, ‘ভূমিকম্প হইল ইন্ডিয়ায় আর ঝাঁকুনি খাইলাম আমরা! এর থেকেই বোঝা যায় সরকার দেশ ইন্ডিয়াকে দিয়া দিছে।’
সাভারের ঘটনায় পুরো জাতি যখন শোকে মুহ্যমান, স্তম্ভিত, ঠিক তখনই কিশোরী মেয়েদের নিয়ে কেউ কেউ মেতে উঠেছিল তাদের চিরাচরিত বিনোদন অনুষ্ঠান নিয়ে। এ লজ্জা কিভাবে ঢাকি! তাদের উচিত ছিল যারা মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করা, যাতে সেখানে আল্লাহর রহমত নাজিল হয় এবং যারা শাহাদাত বরণ করেছেন আল্লাহ যেন তাদের জান্নাতবাসী করেন। একই সাথে, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারদলীয় প্রথমসারির মন্ত্রী এমপিরা মশগুল ছিলেন এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ নিয়ে। এমন একটি শোক দিবসে দুনিয়ার যেকোনো দেশই অনুষ্ঠানটি এক দিনের জন্য হলেও পিছিয়ে দিত। এ অনুষ্ঠানটি পূর্বনির্ধারিত হলেও, সাংবিধানিক কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না।
সরকার আট হাজার কোটি টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনতে পারে, অকারণে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করতে পারে, অথচ উদ্ধার কাজে ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় আজ শত শত লোক চোখের সামনে দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে অপমৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করছেন হাজার হাজার লোক। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অসংখ্য সংবাদ ও ভিডিও কিপ দেখে নিজেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছি। আটকে পড়া মানুষ জীবন-মরণের সন্ধিণে মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে একটু বাঁচার জন্য কিভাবে আকুতি করেছে, নিজেদেরই প্রাণ ভিা চাচ্ছে! এগুলোর ভয়াবহ বর্ণনা আমার মতো একজন আবেগপ্রবণ মানুষের পে লেখায় বা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রতিবারই গার্মেন্টে আগুন লাগার পর উদ্ধারকাজের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং উচ্চ প্রশিণপ্রাপ্ত উদ্ধারকর্মীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উঠে এলেও, এ ব্যাপারে কোনো সরকারকেই পদপে নিতে দেখিনি।
ইতোমধ্যে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সরকারের তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগের বিষয়টি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। পোশাক শিল্পের অনেক বিদেশী উদ্যোক্তা বিভিন্ন যুক্তিতে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে বিনিয়োগের ব্যাপারে ‘রেড সিগন্যাল’ দেখাচ্ছেন। যে দেশের অর্থনীতি অনেকাংশেই পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল, সে দেশের শ্রমিকদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের ব্যর্থতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। বিদেশীরা বাণিজ্য করে ব্যবসায়িক অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে। একের পর এক এ শিল্পের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের সাথে উন্নত বিশ্বের ব্যবসায়িক সম্পর্ক অনেকবারই হোঁচট খেয়েছে। সাভারের ঘটনায় শ্রমিকেরা ইতোমধ্যে ধর্মঘট, আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। ফলে উৎপাদন হবে বন্ধ। যেসব দেশ প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করে বিভিন্ন মওসুমে তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের কাছ থেকে তৈরী পোশাক পাওয়ার অপোয় আছে, তাদের কী হাল হবে? এ তি কিভাবে পূরণীয়?
আজ সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশের প্রায় সব পেশাজীবীর মানুষ তাদের মৌলিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। তন্মধ্যে বাবা-মা, স্ত্রী-কন্যা, ছাত্র, শিক, অভিভাবক, ডাক্তার, আইনজীবী, গার্মেন্টশ্রমিক, সাংবাদিক সমাজ অন্যতম। সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে এবং রাজনৈতিক রোষানলের শিকার হয়েছে সাংবাদিক গোষ্ঠী। গত ২ মার্চ দৈনিক আমার দেশের সম্পাদকীয়তে ‘আদর্শ সাংবাদিকতা বনাম পপাতদুষ্ট সাংবাদিকতা’ শিরোনামে আমার একটি বিশদ আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। লেখাটি প্রকাশের কয়েক দিনের মধ্যে অনলাইন এবং অফলাইনে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত পাঠকদের কাছ থেকে লেখাটির স্বপে যে পরিমাণ সাড়া বা মন্তব্য পেয়েছি, একেক করে গুনে শেষ করতে পারব না। পাঠকদের একটা বিশেষ অংশ ছিল সিডনিতে অবস্থানরত প্রবাসী পাঠকও, যাদের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন মতাদর্শের লোক। দলমত নির্বিশেষে আর্টিকেলটির গ্রহণযোগ্যতা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এক বিশাল অংশ আদর্শ সাংবাদিকতার পে এবং অসৎ সাংবাদিকতার বিপ।ে
কেউ কেউ মনে করেন, সাংবাদিক সমাজের অনৈক্যের ফলেই দুষ্টচক্র সুযোগ পায় এবং সাংবাদিকদের হুমকি, হয়রানি, মামলা, গ্রেফতার, অকারণে রিমান্ডের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করছে না। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা এবং দীর্ঘ এক বছরেরও অধিক সময়ে সরকারের দেয়া বিভিন্ন কঠোর ওয়াদা সত্ত্বেও সত্যিকার খুনিদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় না আনা এরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বশেষ আরেকটি কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে কলম সৈনিক এবং সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে আলোচিত, জনপ্রিয় এবং বিদ্রোহী সাংবাদিক ও লেখক মাহমুদুর রহমানকে শুধুই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গ্রেফতার করে জেলহাজত ও রিমান্ডের নামে নির্যাতন করে। ক্রমেই তার স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। মাহমুদুর রহমানের একটাই দোষ, তিনি যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ওপর স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করেছিলেন। অত্যন্ত মজার বিষয় হচ্ছেÑ স্কাইপ সংলাপের প্রথম অংশ প্রকাশের পরপরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম কোনোরূপ মন্তব্য না করেই পদত্যাগ করেন। আমার দেশে স্কাইপের সংলাপগুলোর প্রকাশ যদি ভুলই হতো তাহলে তিনি পদত্যাগ না করে নিজ পদে এখনো বহাল থাকতেন। ফলে আমার মতো কোটি কোটি মানুষের মাথায় ঢুকছে না মাহমুদুর রহমানের আসল অপরাধ কী?
গতকাল অস্ট্রেলিয়ার বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় চ্যানেলে সাভারের ঘটনাটির শিরোনাম দেখে হতাশ হলাম। একই দিনে অন্য একটি জাতীয় চ্যানেলেও দেখলাম ইউনিসেফের একটি বিজ্ঞাপনচিত্র। সেখানে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের ছোট ছোট শিশুদের দিয়ে বিল্ডিংয়ের কাজে ব্যবহারের জন্য কিভাবে ইট, পাথর ভাঙানোসহ আরো কিছু অমানবিক কাজ করানো হচ্ছে। যে শিশুদের আজ স্কুলে থাকার কথা তারা সেখানে কেন? অস্ট্রেলিয়ার শিশুদের দিয়ে যদি এ বয়সে এ ধরনের কাজ করানো জঘন্য অপরাধ ও অমানবিক হয়ে থাকে, বাংলাদেশের শিশুরা কী দোষ করেছে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads