গত ১৮ ডিসেম্বর সারা দেশে দারুণ এক হরতাল হয়ে গেল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন আজব হরতাল কেউ কখনো দেখেনি। এই দীর্ঘ সময়ে আমরা ধারাবাহিকভাবে হরতাল দেখে আসছি। এমনকি বর্তমান মহাজোট আমলেও আমরা বেশ কিছু হরতাল দেখেছি। তাতে এমন বিরল চিত্র আর কখনো দেখতে পাওয়া যায়নি। গত মঙ্গলবারের হরতাল ডেকেছিল সিপিবিসহ বাম মোর্চা। তাদের দাবি ছিল দেশের সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করতে হবে। এও এক অদ্ভুত দাবি। নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নিজে রাজনীতি করতে পারবে, কিন্তু ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে অন্য কেউ রাজনীতি করলে তা নিষিদ্ধ করতে হবে। এমন স্ববিরোধী দাবির কথা সচরাচর শোনা যায় না। কিন্তু সিপিবির দাবি এমনই।
এই বাম মোর্চার জনসমর্থনের দৌড় এ দেশের মানুষের জানা আছে। এদের সমর্থকের সংখ্যা এখন হাতে গোনা সম্ভব। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পৃথিবীর দেশে দেশে কমিউনিস্টদের প্রভাব কমতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সে সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে অর্থবিত্ত দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে। সিপিবির ছাত্রফ্রন্টের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে নিয়ে গেছে। তরুণ কর্মীদের জন্য সেটাও কম আকর্ষণীয় ছিল না। ফলে তাদের বেশ প্রভাব প্রতিপত্তির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সে প্রভাব আস্তে আস্তে কমতে কমতে এখন শূন্যের কোঠায়। ফলে সমর্থক পাওয়া , কর্মী পাওয়া এখন নেতাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সেই বাম মোর্চা যখন সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকে বসল, তখনই অনেকে কপাল কুঁচকে ছিলেন কী করে এটা সম্ভব।
কিন্তু পর্দার অন্তরালে খেলা যে ভিন্ন ছিল, সেটি বোধ করি বহু মানুষই ধারণা করতে পারেননি। হরতালের দিন সকালে কিছু কর্মী নিয়ে সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতারা পুরানা পল্টন এলাকায় মিছিল করেছেন। সাধারণত হরতাল ডাকলে বিএনপি বা অন্যান্য দলও একইভাবে মিছিল করে। কিন্তু সরকারের পুলিশ বাহিনী ও আওয়ামী কর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে এসব মিছিলে হামলা চালায়। কিন্তু ১৮ তারিখের হরতালে ছাত্রলীগের সে ধরনের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। পুলিশও ছিল না মারমুখো। ফলে সে মিছিল শান্তিপূর্ণভাবেই পল্টন এলাকায় দুই-এক চক্কর দিয়ে শেষ হয়েছে। আর কোথায়ও কোথায়ও ছাত্র ইউনিয়নের চার-পাঁচজন করে কর্মী ঢোল-হারমোনিয়াম নিয়ে রাস্তায় বসে গান গেয়েছে। এ কথা সত্য দুই-এক জায়গায় তারা যান চলাচলে বাধা দিয়েছে। বাকি সবই ছিল সুমসাম। তাহলে দিনভর সারা দেশে হরতাল হলো কিভাবে?
কিভাবে যে হলো, সেটা আমরা দেখলাম, টিভি চ্যানেলগুলোর ফুটেজে। আর পরদিন পত্রপত্রিকার রিপোর্টে। এ হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে। সে ব্যাপারে সরকারেরও রয়েছে নীরব ও সরব সমর্থন। সরকার দেখাতে চায় যে, ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে প্রায় সবাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অবসান চায়। সে কারণে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ হরতাল পালন করেছে। কিন্তু সিপিবির তো এত লোকবল নেই যে, তারা দেশব্যাপী হরতাল কার্যকর করতে পারে। এ জন্য সরকার নিজেই সে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। না হলে সিপিবি এতটা পথ একা কেমন করে পাড়ি দেবে।
সিপিবির ডাকা হরতাল সকাল ৯টা সাড়ে ৯টার মধ্যেই শিথিল হয়ে পড়তে থাকে। এতে সরকারের মান যে যায়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষেধের জিগির যে একেবারেই পথে বসে। সুতরাং সরকার পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেয় যে, তারা যেন সিপিবির ডাকা এই হরতাল সফল করে দেয়। তখন পিকেটারের ভূমিকায় নেমে আসে সরকারের পুলিশ বাহিনী। সরকার হয়তো সিপিবির কর্মী হিসেবে ছাত্রলীগকেই রাস্তায় নামিয়ে দিত। কিন্তু মাত্র ১০ দিন আগেই বিএনপির অবরোধের দিন ছাত্রলীগ যেভাবে বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে-খুঁচিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করে সে স্মৃতি মানুষের মন থেকে মুছে না যাওয়ায় তাদের পক্ষে ছাত্রলীগ নামানো সম্ভব হয়নি।
তাহলে হরতালের কী হবে? সে দায়িত্ব দেয়া হলো পুলিশ বাহিনীকে। সর্বত্র তারা নিজেরাই রাস্তায় বাঁশ বেঁধে যানবাহন চলাচলের গতিরোধ করে দিলো। রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডারের বোল্ডার দিয়ে রাস্তা আটকে দিল। পিকেটার না দেখে এক বাস কন্ডাক্টর সে বোল্ডার সরিয়ে বাস চালাবার চেষ্টা করতেই পুলিশ তাকে ধরে ফেলল। তারপর কষে দিল ধমক। বোল্ডার সে সরাল কেন? সে কি জানে না যে, আজ হরতাল। বাসচালক বলার চেষ্টা করল যে, কোনো পিকেটার তো নেই। তার ওপর আপনারা আছেন, সে কারণেই সরিয়েছি। পুলিশ তাকে আঙ্গুল উঁচিয়ে কঠোরভাবে শাসিয়ে দিলেন। বাসচালক কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থেকে সামনে এগিয়ে গেল।
শাহবাগ মোড়ে দেখলাম আর এক চিত্র। সেও টিভির পর্দায়ই। পুুলিশের এক কনস্টেবল দুই রিকশা যাত্রীকে রিকশা থেকে নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। বলছে, আজ হরতাল, জানেন না। যাত্রী বললেন, তাতে কী আমি তো যাচ্ছি রিকশায়। পুলিশ বলার চেষ্টা করল যে, ওই যাত্রীর নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা রিকশা চলতে দিচ্ছে না। যাত্রী বললেন, কোন হরতালে আবার রিকশা চলে না। সব হরতালেই তো রিকশা চলেছে। এমনকি পিকেটাররা পর্যন্ত রিকশা চলাচলে বাধা দেয় না। আপনি কেন বাধা দিচ্ছেন? অপারগ হয়ে কনস্টেবল বললেন, ওপরের নির্দেশে। যাত্রীও নাছোড়বান্দা। তিনি বললেন, ওপরের মানে কার? এতক্ষণে বোধ করি, কনস্টেবল খেয়াল করলেন যে, টেলিভিশনের ক্যামেরা এসব কথোপকথনের ছবি ও বক্তব্য ধারণ করছে। তিনি সম্ভবত কোনো এএসআই বা সার্জেন্টকে দেখিয়ে বললেন, আমি বলতে পারব না, ওই যে অফিসার আছেন, তাকে জিজ্ঞেস করেন। একেবারেই যেন মুড়ির টিনের বায়স্কোপ।
টেলিভিশনের ক্যামেরায় দৃশ্যটি ওই পর্যন্ত দেখেছি। সকাল ১০টার দিকে আমাদের তরুণ রিপোর্টার হন্তদন্ত হয়ে ফোন করলেন। ভাই, রাস্তায় এক অবাক কাণ্ড। জিজ্ঞেস করলাম, কী? তিনি বললেন, বাস, সিএনজি, রিকশা থেকে পুলিশ যাত্রীদের নামিয়ে দিচ্ছে। জানতে চাইলাম, তাকেও নামিয়ে দিয়েছে কি না। জবাবে সে বলল, নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। সে তর্ক করেছে। তখন পুলিশ তাকে বলেছে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাদের যানবাহন থেকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ দিকে সরকার সারা দিন বন্ধ রেখেছিল বিআরটিসির বাস। সাধারণত সব হরতালেই প্রধান সড়কগুলোতে বিআরটিসির বাস চলাচল করে। কিন্তু সরকারের নির্দেশে ওই দিন একটি বাসও রাস্তায় বের হয়নি। তেমনিভাবে সরকারের নির্দেশেই দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
বাংলাদেশে সব সময়ই এমন অভিনব ঘটনা ঘটে। হরতাল নয়, যেন সরকার অঘোষিত কারফিউ জারি করেছিল। এরপর টেলিভিশনে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণা শুনলাম। তিনি বললেন, হরতাল, রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার। সিপিবি শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করেছে বলেই সরকার তাদের সব রকম সহযোগিতা দিয়েছে। তাহলে অন্যসব হরতালে বাধা দেন কেন? এর জবাবে তিনি বললেন, তারা নাশকতামূলক কাজ করে। ভাঙচুর করে। জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়ায়। সে কারণে বাধা দেয়া হয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মুখে এমন ললিত বাণী আর কখনো শুনিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও প্রায় একই সুরে কথা বললেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাম মোর্চার হরতালে সমর্থন দিয়ে বললেন, পূর্বে যারা হরতাল করেছেন, তাদের এই হরতাল থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। বাম দলের এ শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। রমনায় লেগুনার একটি কাচ ভাঙা ছাড়া ঢাকাসহ সারা দেশে কোথায়ও কোনো বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি। গোটা দেশে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তারা হরতাল পালন করেছে। এ জন্য তাদের কোথায়ও বাধা না দিয়ে পুলিশ বরং সহযোগিতা করেছে। তিনি শুধু বলেননি যে, পুলিশই হরতাল করে দিয়েছে।
হরতালে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ কেন বিঘিœত হয়? তার কারণ বিরোধী দল হরতাল ডাকলেই সরকার তার পুলিশ বাহিনী ও ঘাতক ছাত্রলীগ বাহিনী হরতালকারীদের ওপর লাঠিসোটা, বন্দুক, চাপাতি নিয়ে চড়াও হয়। বাধা দিলে তো লড়াই বাধবেই। বিরোধী দলকে বাধা না দিয়ে এমন সহযোগিতা করলে নিশ্চয়ই সেসব হরতালেও কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। আমরা দেখতে চাই ভবিষ্যতে বিরোধী দল যদি হরতাল ডাকে তাহলে একইভাবে পুলিশ নিজেই পিকেটারের ভূমিকায় নেমে যান চলাচলের পথ বন্ধ করবে। বিআরটিসির বাস চালাবে না। দূরপাল্লার বাস বন্ধ রাখবে। ছাত্রলীগের ঘাতকদের লেলিয়ে দেবে না। তাহলে সেসব হরতালও অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হবে। বিরোধী দলেরও শিক্ষা নেয়া হয়ে যাবে।
এরপর গত ২০ ডিসেম্বর ঢাকায় সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ইসলামি ও সমমনা ১২টি রাজনৈতিক দল। সে হরতালের প্রাক্কালেই মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চেহারা বদলে গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। তিনি বললেন, হরতাল অসাংবিধানিক এবং অসাংবিধানিক কার্যকলাপে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। একেবারেই উল্টো কথা। অবশ্য আওয়ামী লীগাররা চোখ-মুখ বন্ধ করে সকালের কথা বিকালে একেবারেই উল্টে দিতে সিদ্ধহস্ত। যা হোক, বিরোধী দল যদি ভবিষ্যতে কোনো হরতাল ডাকে তাহলে অমনি সহযোগিতার চিত্র দেখার আশায় রইলাম।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন