কালের আবর্তে হারিয়ে গেল ২০১২ সাল। নতুন সূর্যোদয় আমাদের উপহার দিল নতুন বছর ২০১৩। বাস্তব কারণেই মানুষ বিদায় জানায় বিগত বছরকে এবং স্বাগত জানায় নতুন সময়কে। মানুষ নতুন বছরকে স্বাগত জানায় নতুন স্বপ্নে, আর পুরাতন বছরের দিকে তাকায় জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে। এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। স্বপ্নকে সফল করতে হলে বিগত বছরের ঘটনা প্রবাহকে বিশ্লেষণ করতে হয়। যথার্থ বিশ্লেষণ ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণে আমাদের সহযোগিতা করতে পারে। বিগত বছরে আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার পাশাপাশি ছিলাম আন্তর্জাতিক বিশ্বেরও নাগরিক। স্বদেশের ঘটনা প্রবাহের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহও আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে থাকে। তাই সচেতন মানুষ মাত্রই তাদের অভিযাত্রায় শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ঘটনা প্রবাহের দিকেও রাখে সতর্ক দৃষ্টি। এটাই স্বাভাবিক এবং সঙ্গতও বটে।
বিগত বছরে জাপান, মিসর, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কিছু দেশে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচনকে ঘিরে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, স্বপ্নের কথাও বলা হয়েছে। তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক বিশ্বে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে যে পরাশক্তি তাদের নীতিতে কিংবা আচরণে তেমন কোন পরিবর্তন সূচিত হয়নি। আর এই বিষয়টিও উপলব্ধি করা গেছে যে, পরাশক্তির ভাষাগত পরিবর্তনে বাস্তবে তেমন কোন পরিবর্তন সূচিত হয় না। ফলে বর্তমান বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সমাধান অনিবার্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও সেখানে ফলদায়ক তেমন কিছু ঘটেনি। ফিলিস্তিনিরা আজও তাদের অধিকার ফিরে পায়নি। উড়ে এসে জুড়ে বসে ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করে আগ্রাসনের উত্তাপ ছড়াতে থাকলেও ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনিরা এখনও স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেল না। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা পেলে গোস্যা বেড়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে তারা বলে ওঠে, জাতিসংঘ কি বললো সেটা বড় কথা নয়, ইসরাইল কি বললো সেটাই আসল কথা। এমন প্রশ্রয় পেয়েই ইসরাইল বলতে পারলো, জাতিসংঘের বক্তব্যকে আমরা তোয়াক্কা করি না। এই যদি হয় বিশ্ব পরিস্থিতি এবং বিশ্ব নেতাদের আচরণ তাহলে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার ব্যাপারে মানুষ আশান্বিত হবে কেমন করে? সভ্যতার অন্যায় দৃষ্টিভঙ্গি এবং অমানবিক আচরণের কারণে এখনও বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, কাশ্মির এবং মিয়ানমারের জনগণ। জানি না নির্যাতিত-নিপীড়িত এই সব মানুষ কখন মানবাধিকার ফিরে পাবে, কখন নিজেদের বিশ্বের নাগরিক হিসেবে ভাবতে পারবে? গত বছরের প্রহসনের বিশ্ব ব্যবস্থার বদলে নতুন বছর মুক্তির বার্তা বয়ে আনবে এটাই এখন মানবজাতির স্বপ্ন। তবে গত বছরের ‘আরব বসন্ত' মানব জাতির সামনে যেন এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। পাশ্চাত্যের সাহায্য-সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে স্বৈরশাসকরা চেপে বসেছিল। ‘আরব বসন্ত' স্বৈরাচারী শাসকদের মসনদ টলিয়ে দিয়েছে। জনগণ তাদের স্বাধীকার চেতনায় নতুন করে দেশকে গঠন করতে চেয়েছে। এর উজ্জ্বল উদাহরণ মিসর। মিসরের স্বৈরশাসকরা যে ‘ব্রাদারহুডের' নেতা-কর্মীদের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িকসহ না মন্দ ভাষায় চিহ্নিত করতে চেয়েছে তাদের হাতেই জনগণ তুলে দিয়েছে মিসরের শাসন ক্ষমতা। মিসরের মুরসি সরকার জনগণের আশা-আকাঙক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে রচিত সংবিধানকে জনগণের রেফারেন্ডার্মের মুখোমুখি করেছে। সে রেফারেন্ডামে জনগণের ভোটে পাস হয়েছে প্রস্তাবিত সংবিধান। এভাবে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে দেশ শাসন করার যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে মিসরের মুরসি সরকার তা গত বছরের আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একটি বড় ঘটনা। এ ঘটনা বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে সাহায্য করতে পারে। তবে এই বার্তাটি আন্তর্জাতিক বিশ্ব গ্রহণ করে কি না সেটাই ২০১৩ সালে লক্ষ্য করার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের চাইতেও স্বদেশের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু গত বছর বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার বর্ণনা দিতে গেলে যে কোনো সচেতন নাগরিকেরই মন ব্যথায় ভারী হয়ে আসতে পারে। স্বদেশে ব্যর্থতা ও গ্লানির কথা বর্ণনা করতে কারই বা ভালো লাগে। এ কারণেই হয়তো কবি বলে গেছেন, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জানাতে ভালবাসে'। গত বছরের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয়েছে ‘খুন-গুম-কেলেঙ্কারির বছর'। কোনো পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে, ‘দেশের মর্যাদাহানির বছর'। বছরজুড়ে দেশে আলোচিত বিষয় ছিল খুন-গুম ও নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা। পদ্মা সেতু, নিম্নমুখী শেয়ার বাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি ও রেল কেলেঙ্কারির ঘটনা সরকারের জন্য ছিল খুবই বিব্রতকর বিষয়। এছাড়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামসহ বেশ কয়েকটি গুম ও খুনের ঘটনায় দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের কোনো কূল কিনারা না হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা ও জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচিতে পুরান ঢাকার পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে সরকারের মুখে আরো কালিমা লেপন করে ছাত্রলীগ। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতির স্কাইপে কথোপকথন ব্যাপকভাবে জনমনে আলোড়নের সৃষ্টি করে। ফলে যুদ্ধাপরাধ বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনার মাত্রাও বেড়ে যায়। এছাড়া গত বছর কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ পল্লী ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, সিলেট এমসি কলেজের ঐতিহাসিক ছাত্রাসাবে অগ্নিসংযোগের ঘটনা, আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১২৪ জন গার্মেন্ট শ্রমিকরে মৃত্যু এবং চট্টগ্রামে ফ্লাই ওভার দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা দেশবাসীর কাছে দুঃখজনক স্মৃতি হয়ে রয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেও গত বছর কিছু পুরস্কার বিষয়ও আমরা লক্ষ্য করেছি। কৃষিতে আমরা ভাল করেছি, ক্রিকেটেও আমরা ভাল করেছি। শুধু পুরুষই নয় বাংলাদেশের নারীরাও এখন এভারেস্ট জয় করছে। গত বছরের মে মাসে নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরিন এভারেস্ট চূঁড়া জয় করেন। বিজ্ঞানী মাকসুদ আলমের নেতৃত্বে দেশের বিজ্ঞানীরা ছত্রাকের জীবন রহস্য উম্মোচন করেন। এসব ঘটনা আমাদের উপলব্ধি দেয় যে, আমরাও পারি। কিন্তু গত বছর যে গরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমরা করতে পারিনি তা হলো, সামনের জাতীয় নির্বাচনটি কোন পদ্ধতিতে কিভাবে হবে তা নির্ণয় করতে। গত বছর এই ব্যর্থতাটি নতুন বছরের জন্য একটি অশনি সংকেত হয়ে রয়েছে। আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি একটি অবাদ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণে সামর্থন না হয় তাহলে আমাদের আশা-আকাঙ্কা ও স্বপ্ন ভেঙ্গে খানখান হয়ে যেতে পারে। আমরা আশা করবো, গত বছরের মত নতুন বছরে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হবে না। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাটাই আসল। পরিশেষে নতুন আশায় সবাইকে জানাই শুভ নববর্ষ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন