আমানুল্লাহ কবীর
এবারো গোল বাধল ‘দেশপ্রেমিক’ আবুল হোসেনকে নিয়ে। দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, তদন্ত রিপোর্টের তালিকা থেকে আবুল হোসেনের নাম বাদ দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে, কিন্তু বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দল তাতে নারাজÑ আবুল হোসেনসহই সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। গত ৫ ডিসেম্বর দুদক ও বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দুই দফা বৈঠকের পরও আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। সুতরাং আলোচনা ভেঙে গেছেÑ এটা বলাই ঠিক। যদিও অর্থমন্ত্রী মুহিত ও দুদকের কর্মকর্তারা তা মানতে রাজি নন। দুদকের সাথে প্রথম দফা বৈঠকে মতবিরোধ দেখা দিলে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দল বিকেলে অর্থমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সহজেই অনুমান করা যায়, তারা সেখান থেকেও নিরাশ হয়ে ফেরেন। এরপর দুদকের সাথে কয়েক মিনিট আলোচনা করে তারা দেশের পথে বিমানবন্দরে চলে যান। বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান লুই গ্যাব্রিয়েল মোরোনা ও কামেজা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘আমরা এখন এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। অপেক্ষা করুন, দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছ থেকেই জানতে পারবেন। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।’ দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে দুদক। বিশ্বব্যাংক কী বলল, প্যানেল কী বলল, তা আমরা শুনব, বিবেচনা করব; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বা আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে দেশের আইন অনুযায়ী।’
পরের দিন অর্থমন্ত্রী মুহিতও বললেন, পদ্মা সেতুর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাংক নয়, বরং সরকারই নেবে। ওই দিন দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘পদ্মা সেতু দুর্নীতি তদন্ত কমিটি খসড়া রিপোর্ট জমা দিয়েছে, এখনো চূড়ান্ত রিপোর্ট আমরা পাইনি। চূড়ান্ত রিপোর্ট পেলে তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে।’ অর্থাৎ এক দিনের মধ্যেই তিনি তার বক্তব্য পাল্টে ফেললেন। তিনি আগের দিন বলেছিলেন, তদন্ত রিপোর্টে দুর্নীতির সাথে জড়িত যাদের নাম পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি পরের দিন বললেন, ‘চূড়ান্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর তা আবার যাচাই-বাছাই করা হবে। তবে এ কাজে কিছুটা সময় লাগলে বা আরো কয়েক দিন দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’ বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের সাথে বৈঠকে আবুল হোসেনকে বাদ দিয়ে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা জানানো হয়। দুদকের বক্তব্য ছিল, আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা দুদকের এই বক্তব্য গ্রহণ করেননি। ফলে সিদ্ধান্ত ছাড়াই দুদক ও বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের বৈঠক ভেঙে যায়। এ বৈঠক আর জোড়া লাগবে কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা যাবে না। বরং বলা যায়, বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি আবার অনিশ্চিত হয়ে গেল। ঢাকার বৈঠকের ফলাফলের ওপর বিশেষজ্ঞ দল ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অফিসে যে রিপোর্ট দেবে, তাতে আশাবাদী হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি ইতোমধ্যেই এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলেছেন, ‘কেবল পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করলেই তার সংস্থা পদ্মা সেতুর অর্থায়নে অগ্রসর হবে। তার সংস্থা দুর্নীতির বিষয়ে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণও দিয়েছে।’ অনুসন্ধান পর্যালোচনা শেষ করে দুদক যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে, তখন বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি একটি নতুন বিবৃতি দেবে।
প্রবাদ আছে, নেড়া একবারই বেলতলায় যায়। কিন্তু এই সরকার এমনই নেড়া যে ঘুরেফিরে আবার সেই বেলতলাতে গিয়েই হাজির হয়েছে, যে কারণে এই বিপর্যয়। কিন্তু এই সরকার, সরকারের অর্থমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের কোনো লাজলজ্জা নেই। তাদের কাছে পদ্মা সেতুর চেয়ে বড় আবুল হোসেন। বিশ্বব্যাংক যখন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে, তখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাকে ‘দেশপ্রেমিক’ সার্টিফিকেট দিয়ে তার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ুব্ধ হয়ে একপর্যায়ে তিনি বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেই তদন্তের হুমকি দেন এবং বিশ্বব্যাংকের সংস্কার দাবি করেন। আবুল হোসেনকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক এখনো অর্থই দেয়নিÑ দুর্নীতি হলো কিভাবে? অর্থমন্ত্রী গোড়া থেকেই মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ তিনি কখনো অস্বীকার করেছেন, কখনো ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন, আবার কখনো আবুল হোসেনকে রক্ষার জন্য গলা শুকিয়েছেন। কৃষিমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককেই বিশ্বচোর বলে মনের ঝাল মিটিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তার অবস্থানে অনড় থেকে প্রতিশ্রুত ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। প্রধান ঋণদাতা সংস্তা বিশ্বব্যাংকের এই অবস্থানের ফলে অন্য দু’টি ঋণদাতা সংস্থা জাইকা (জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা) ও আইডিবির (ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক) ঋণ পাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তারা ঋণ বাতিল না করলেও বিশ্বব্যাংকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করে বাংলাদেশের অনুরোধে। যে জাতি রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছে, দুর্নীতির দায়ে তাকে বিশ্বের কাঠগড়ায় দাঁড় করাল এই সরকার। জনগণই নির্বাচিত করেছে এই সরকারকে। এখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসীকে তারা মুখ দেখাবে কী করে? বাঙালি রমণীরা নাকি ছলচাতুরীতে পটিয়সী। আমাদের প্রধানমন্ত্রী গেলেন জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের সভায়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশীদের সভা-সমাবেশে ড. ইউনূসের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বোঝালেন, ওই লোকই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করে পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করিয়েছে। এরপর তিনি ঘোষণা দিলেনÑ বিশ্বব্যাংককে লাগবে না, পদ্মা সেতু আমরা নিজস্ব অর্থেই করব। তিনি প্রবাসীদের প্রতি সহযোগিতা করারও আহ্বান জানালেন। তিনি তাদের স্পষ্টভাবে জানালেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নিÑ এটা ষড়যন্ত্র।
এ দিকে দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, নেতাকর্মীদের কণ্ঠে একই কথা প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। রাষ্ট্রীয় কোষের খবর জানেন অর্থমন্ত্রী। নিজস্ব অর্থ থেকে এমন একটা ব্যয়বহুল প্রকল্পের অর্থায়ন সম্ভব কি না, এটা অর্থমন্ত্রীর না জানার কথা নয়। কিন্তু তিনিও মিথ্যাচারের আশ্রয় নিলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বললেন, পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থেই করব। যারা এ বিষয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত, তারাও কেউ সরাসরি এই তুঘলকি চিন্তার বিরোধিতা করলেন না, বললেন, সম্ভবÑ তবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ওদিকে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল চার দিকেÑ কে কত টাকা দিতে পারে, কে কত চাঁদা তুলতে পারে। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের তহবিল সংগ্রহের জন্য দু’টি ব্যাংক হিসাব খোলা হবেÑ একটি প্রবাসীদের জন্য, অপরটি স্থানীয়দের জন্য। বরাবরের মতো এবারো সর্বাগ্রে এগিয়ে এলো আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। সুযোগের ব্যবহার করে চাঁদা তোলা শুরু করে দিলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। কিন্তু শুরুতেই চাঁদার ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ দেখা দিলো ছাত্রলীগের নেতাকর্মী নিজেদের মধ্যেই। সংঘর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র নিহত হলো। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মানের অলীক স্বপ্ন যখন বাস্তবতার আঘাতে চুরমার হয়ে গেল, তখন লোকদেখানোর জন্য নিয়ে আসা হলো মালয়েশিয়াকে। মালয়েশিয়া সেতু নির্মাণ করে দেবে। ধুমধাম করে ঢাকায় সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর করা হলো। কিন্তু কর্পূরের মতো যথানিয়মেই তা উবে গেল। সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়ার প্রস্তাবিত ব্যয় ও শর্ত নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিলো, কেননা বিশ্বব্যাংক যে সহজ শর্তে ঋণ দিতে রাজি হয়েছে, মালয়েশিয়ার শর্ত তার তুলনায় বলা যায় দেশের স্বার্থের পরিপন্থী।
যা হোক, উপায়ান্তর না দেখে নাকে খত দিয়ে সরকারকে আবার মুখ ফেরাতে হয় বিশ্বব্যাংকের দিকে। অর্থমন্ত্রী মুহিত জাপান সরকারের সাহায্য কামনার্থে গেলেন টোকিওতে। বাংলাদেশকে সবচেয়ে বড়ো ঋণদাতা দেশ জাপানও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলো। জাপান সরকারের মধ্যস্থতাতেই বিশ্বব্যাংক শর্তসাপেক্ষে পদ্মা সেতু অর্থায়নে রাজি হলো। ইতঃপূর্বেও বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বহাল রাখতে এসব শর্ত দিয়েছিল, কিন্তু আমাদের সরকার মুখ্যত তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে রক্ষা করতেই সেসব শর্ত মেনে নিতে রাজি হয়নি। এবার সরকারের ঘোলা পানি সরকারকেই খেতে হলো। গত ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত মেনে নিয়ে সম্মতিপত্র প্রেরণ করে। ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে বলে, বাংলাদেশ সরকার নিম্নোক্ত শর্ত মেনে নিয়েছে। এসব শর্ত হচ্ছেÑ ১. দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত সন্দেহভাজন সব সরকারি কর্মকর্তাকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছুটিতে পাঠাতে হবে; ২. তদন্ত পরিচালনার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন দ্বারা একটা বিশেষ অনুসন্ধান ও প্রসিকিউশন (inquiry and prosecution) দল গঠন করতে হবে এবং ৩. সব অনুসন্ধান তথ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত দলের দেখার সুযোগ থাকবে। এ দলটিই সরকারের তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক ও সহ-অর্থায়নকারীদের পরামর্শ দেবে। এসব শর্তের পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি ১৪ অক্টোবর প্রথম ঢাকার আসে। তারা দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। বিশ্বব্যাংক বারবার দাবি করে আসছে যে, তারা দু’টি তদন্ত থেকে পাওয়া দুর্নীতির সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদকের চেয়ারম্যানকে দিয়েছে। ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসেস নামক একটি অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান এক বছর ধরে তদন্ত করে দুর্নীতির এসব অভিযোগ পায় কানাডার এসএনসি-লাভালিন ও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এই তদন্তের ভিত্তিতেই কানাডার পুলিশ লাভালিনের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় এবং একই তদন্তের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সম্পৃক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়। এ তদন্ত রিপোর্টে আবুল হোসেনকে দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের এক নম্বর ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার বিশ্বব্যাংকের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করলে তারা গত জুন মাসের শেষের দিকে পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করে দেয়। এর পরই প্রধানমন্ত্রী ুব্ধ হয়ে ও নিজেকে আপসহীন প্রমাণ করার জন্য জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করার ঘোষণা দেন। বললেন, পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থেই নির্মাণ করা হবে। ২০৯ বিলিয়ন ডলারের এমন একটি বিশাল প্রকল্প নিজস্ব অর্থে করা সম্ভব কি না, তা একবারও ভেবে দেখলেন না কিংবা এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণের প্রয়োজন বোধ করলেন না। সরকারের এই বালখিল্য পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎকে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত করে দিলো।
বিশ্বব্যাংক ফিরে আসার পর বিভিন্ন সময় সরকারকে স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে, সব শর্তের সন্তোষজনক বাস্তবায়ন ও বিশেষজ্ঞ দলের ইতিবাচক রিপোর্টের পরই কেবল পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করা হবে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, পদ্মা সেতুর চেয়ে এখন সরকারের কাছে আবুল হোসেন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পদ্মা সেতু গোল্লায় গেলে যাক, আবুল হোসেনকে বাঁচাতেই হবে। কেন? লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ সাহা তার ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন, সেতু তদারকির কাজের নির্ধারিত অর্থের যে ১০ শতাংশ ঘুষ দেয়া হবে তার ৪ শতাংশ পাবেন আবুল হোসেন। পদ্মা সেতুর কাজ পেতে লাভালিনের এই কর্মকর্তাই বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে ঘুষের দেনদরবার করেছিলেন। দুদক বলছে, রমেশ সাহার ডায়েরিতে উল্লেখ থাকলেও আবুল হোসেনকে ঘুষ দেয়া হয়েছে বা তিনি ঘুষ নিয়েছেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। কাজেই আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। শোনা যায়, বিষয়টি আসলে তা নয়, প্রধানমন্ত্রীর একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় চান না আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হোক। তবে কি যারা ওই ১০ শতাংশের ভাগীদার তারাই আবুল হোসেনকে বাঁচাতে উঠেপড়ে লেগেছেন? অথবা ঘটনাটি কি এমন যে, আবুল হোসেন হুমকি দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হলে তিনি সব ফাঁস করে দেবেন?
বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে প্রধানমন্ত্রীর পরিবার জড়িত। পদ্মা সেতুতে যে দুর্নীতি হয়েছে, সরকার বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে নিয়ে তা স্বীকার করেছে। এখন এটাও পরিষ্কার যে, দুর্নীতিতে যারাই জড়িত থাক না কেন, তারা অর্থের বিনিময়েই সরকারের সর্বোচ্চ মহলের আশীর্বাদ লাভ করেছে। আবুল হোসেন ও আবুল হাসান চৌধুরী ছাড়া যে বাকি সাতজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তারা সবাই সরকারি (অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের) কর্মচারী। সরকার (অর্থাৎ মন্ত্রিসভা) নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য দুর্নীতির দায় চাপাতে চাচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের ওপর। মেরুদণ্ডহীন দুদক সে কাজটাই করছে। নাটকের শেষ এখানেই নয়। যদি আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আইনি ব্যবস্থা নিতেই হয়, আইনের ফাঁক দিয়ে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করে বের করে আনার চেষ্টা বন্ধ থাকবে না। তখন বিশ্বব্যাংকের সাথে নতুন করে আরেক দফা জটিলতা সৃষ্টি হবে।
বিশ্বব্যাংকের শর্তসাপেক্ষেই আবুল হোসেনকে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। সরকারের মন্ত্রীরা যে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন, তার আরেকটা প্রমাণ হলো সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ। মন্ত্রিত্ব লাভের পর ছয় মাসও যায়নি, তিনি ঘুষের টাকা হজম করার আগেই ধরা পড়ে গেলেন। তার বাসায় গাড়িতে পৌনে এক কোটি টাকা নিয়ে যাওয়ার পথে রেলওয়ের কর্মকর্তাসহ তার এপিএস ধরা পড়লেন। গাড়ির ড্রাইভার বলেছেন, ঘুষের লেনদেন এবারই প্রথম নয়, এর আগেও হয়েছে। সুরঞ্জিত সেন সারাজীবন রাজনীতি করেছেন, শেষ বয়সে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। একজন ঝানু পলিটিশিয়ান হয়ে তিনি কেন যে এমন কাঁচা কাজ করলেন, তা ভেবে অনেকেই আফসোস করেছেন। কারণ এই মন্ত্রিত্ব লাভের জন্য বিবেকের বিরুদ্ধে তাকে জাতীয় সংসদে ও জাতীয় সংসদের বাইরে অনেক সত্য-মিথ্যা ও উল্টাপাল্টা বক্তৃতা দিতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পা পাওয়ার জন্য। সর্বশেষ, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ও উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাই দুর্নীতির জন্য জনসমক্ষে ধরা পড়লেও প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পা থেকে বঞ্চিত হননি। মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করলেও প্রধানমন্ত্রী তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী বা উজিরে খামাখা করে রেখেছেনÑ ফ্যাগটা কেড়ে নেননি। প্রধানমন্ত্রী উদার বটে!
বাংলাদেশে সরকারের নেতা-এমপি-মন্ত্রীরা যে এবারই প্রথম দুর্নীতি করেছে, তা নয়। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীদের দুর্নীতি নিয়ে দেশে-বিদেশে আর কখনো এমন হইচই পড়েনি কিংবা বিশ্বের দরবারে কোনো সরকারকে এভাবে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয়নি। পদ্মা সেতু ও রেলওয়ে দুর্নীতির খবর যখন মানুষের মুখে মুখে, তখনই ফাঁস হয়ে পড়ে সোনালী ব্যাংক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি। সরকারি প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় হলমার্ক ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এ কেলেঙ্কারির সাথে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর কাছে এই অর্থ আত্মসাৎ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই নয়। তিনি বললেন, ব্যাংকগুলো চল্লিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়, সেখানে এই চার হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই নয়। এ কথা বলে তিনি অর্থ আত্মসাৎকারী হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংকের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদেরই রক্ষার চেষ্টা করেন। এমন সাফাই তিনি আবুল হোসেনের ব্যাপারেও করেছেন। দুর্নীতির সাফাই যারা করেন, তাদের দুর্নীতিপরায়ণ বলা যাবে না কেন?
পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের দু’টি প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একটি। পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের মানুষের বহু দিনের দাবি ও স্বপ্ন। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণবঙ্গের সাথে কেবল যোগাযোগের উন্নতি হতো না, সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যেরও ব্যাপক অগ্রগতি হতো। কিন্তু সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন হাঙ্গরের পেটে। দিনের হিসাব-নিকাশ বলেÑ এই সরকারের আমলে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দীর্ঘ দিন লালিত এমন একটি স্বপ্ন কিভাবে সরকারের দুর্নীতির বেড়াজালে আটকে গেল, ইতিহাসে তা লজ্জাকর অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন