দেখতে দেখতে একচল্লিশ বছর পেরিয়ে গেল। স্বাধীনতা অর্জন করেছি ৪১ বছর আগে। ১৯৭০ সালে আমি নিজে উপার্জন করে ঢাকায় থাকি। সে জীবনযুদ্ধ অবর্ণনীয়। আমার সন্তানদের পক্ষেও সেটি ধারণা করা অসম্ভব। দু’টি মোটা আটার রুটি, কিছুটা গুড় তেলাপোকাদের সাথে ভাগ করে খাই। কাজ করি পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার ফার্স্ট লেনে। পড়ি সদরঘাটের জগন্নাথ কলেজে। থাকি বুড়িগঙ্গার নদীর ওপারে চুনকুটিয়ায়। না, যুদ্ধ হবে এ রকম চিন্তার ভেতরেও ছিল না। চিন্তার ভেতর ছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। ১৯৭০ সালে আমার বয়স সতের ছিল। অতএব, ভোট দিইনি। কিন্তু জিন্দাবাদ, মুর্দাবাদের মিছিলে সব সময় শরিক হয়েছি। তখন আমার ইতিহাস ও রাজনীতিজ্ঞান অত্যন্ত সীমিত ছিল। থাকারই কথা। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তখন আর কতটুকুই বা পড়তে পেরেছি। পড়েছি ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি, মানুষ এলো কেমন করেÑ এসব বই। পাকিস্তান জন্মের ইতিহাস পাঠ্য বইয়ে পড়েছি। কিছু বাড়তি বই যে পড়িনি এমন নয়। পড়েছি আবুল মনসুর আহমদের ‘পাক-বাংলার কালচার’। আমার পিএইচডি করার প্রেরণাও সেই বইটি থেকে। আমি মনে করেছিলাম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অনেকেই তো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, যারা পাঞ্জাবি, সিন্ধি নন। তাহলে শেখ মুজিবুর রহমান কেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
কিন্তু পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান, পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, অদূরদর্শী রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টো বেঁকে বসলেন এই বলে যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কিছুতেই মেনে নেবেন না। এই কথা শুনে আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। এর আগেও যদি পাকিস্তানের নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের অনেক লোককে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়ে থাকেন, তাহলে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে তাদের বাধা কোথায়। এগুলো বোঝার আমার বয়স তখনো হয়নি। এ নিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে। সকালে মিছিলে চড়ে মোহাম্মদপুর যেতাম। দুপুরে সেখানে ছয় আনা-আট আনার হোটেলে খেয়ে আবার মিছিলে চড়ে সদরঘাট ফিরে আসতামÑ শেখ মুজিবকে অবশ্যই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করতে হবে।
আমি তখনো প্রারম্ভ-তারুণ্যে। আমার আকাক্সার মতো কি আর সব কিছু হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানকে সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে এই বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘জেনারেলস, মিট ইয়োর নেক্সট প্রাইম মিনিস্টার’। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো সব কিছু এলোমেলো করে দিলেন। তার সাথে যোগ দিলো পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র। ফলে ভুট্টোর পাল্লাই ভারী হলো। জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডেকেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান হুট করেই তা বন্ধ করে দিয়ে ঢাকা ছেড়ে রাওয়ালপিণ্ডি চলে গেলেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমি এ কথা ভাবিইনি, পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের চাপে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এ দেশে ব্যাপক গণহত্যার পরিকল্পনা করবে। না, এগুলো বুঝবার ক্ষমতাও আমার তখন ছিল না। আমার জ্ঞান সীমিত ছিল। রাজনীতি বিষয়ের কথা আগেই বলেছি। পাঠ্যতালিকায় আরো ছিল মাও সে তুংয়ের নানান ধরনের লাল বই। আর একটি গ্রন্থÑ যে গল্পের শেষ নেই। এর সবই মার্কসবাদী চেতনার প্রসূন। মার্কসবাদ সম্পর্কেও তখন আমার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। ওই সব সামান্য বই পড়ে আমি বিরাট পণ্ডিত হয়ে গিয়েছিলাম। এসব বিষয়ে যাদের সাথে আলোচনা করতে পারতাম, তারা ছিলেন জগন্নাথ কলেজে আমার শিক্ষক। কথাসাহিত্যিক শওকত আলী, কবি-গল্পকার শহীদুর রহমান, সুযোগ্য শিক্ষক আহমদ কবির, সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ বা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তাদের কেউ কেউ রাজনীতি বিষয়ে কথা বলতেন। কেউ কেউ নিরেট সাহিত্যের বাইরে আর কিছুই চিন্তা করতেন না। ফলে এক মিশ্র অনুভূতির ভেতরে পড়েছিলাম।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করলেন, তখনই হুট করে ধাক্কা খেলাম, নিশ্চয়ই একটা কিছু মারাত্মক ঘটেছে কোথায়ও। আমি তত দিন পর্যন্ত যতটুকু জানতাম যে, জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে, সেখানে ভোটাভুটিতে শেখ মুজিবুর রহমান অবশ্যই জিতবেন এবং তিনিই হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ভুট্টো যখন শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মেনে নিতে অস্বীকার করে বসলেন, তখনই পাকিস্তানে ভাঙনের সুর বেজে উঠেছিল। ভুট্টো যদি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে যা দাঁড়াবে, তা হলো তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন আর শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের কী হবে? সেখানে তো কোনো নির্বাচিত কেউ থাকছে না। অর্থাৎ পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে।
তারপরের কাহিনীও খুব দীর্ঘ নয়। কয়েকটা দিন গেল রুদ্ধশ্বাস। পর্দার অন্তরালে কী হচ্ছিল, সেটি সংবাদপত্রে খুব একটা আসছিল না। জয়দেবপুর, ময়মনসিং, খুলনা থেকে উদ্বেগজনক সব খবর আসছিল। আসছিল দাঙ্গার খবরও। সেই বয়সে সেসবের গুরুত্ব খুব একটা উপলব্ধি করতে পারিনি। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনাই মনে হচ্ছিল। তারপর ২৫ মার্চ রাতে ঘটল সেই ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা।
সব কিছু এলোমেলো তছনছ হয়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হলেন। জাতি দিশেহারা। আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। শেখ মুজিব বন্দী, আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা পলাতক। তাহলে এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী? পাকিস্তানিরা সম্ভবত এমন একটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থাই পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তখন জনতার ভেতরে রোষের আগুন জ্বলছিল। তারা চাইছিল পথের দিশা। ঠিক এ রকম সময়েই ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিলেন জিয়াউর রহমান। এই ঘোষণা কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে অবিরাম বাজানো হচ্ছিল। মানুষ অন্তত এইটুকু দিশা পেল যে, যুদ্ধ করে হলেও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বপ্ন গণতন্ত্র, স্বপ্ন আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, স্বপ্ন নিপীড়নহীন স্বচ্ছন্দ জীবন। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমি।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতাসহ সাধারণ মানুষ হাজারে হাজারে সে যুদ্ধে শরিক হলেন। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করল। তারপরের কাহিনী কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সে শুধুই স্বপ্নভঙ্গের পালা। অতিদ্রুতই গণতান্ত্রিক চেতনা বিসর্জন দেয়া হলো। বরং তার জায়গায় জাঁকিয়ে বসল কঠোর নির্যাতন-নিপীড়ন আর স্বৈরতন্ত্র। লুণ্ঠনে ফোকলা হয়ে গেল দেশ। কেড়ে নেয়া হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই প্রক্রিয়ায় দেশে জারি হলো একদলীয় শাসনব্যবস্থা। নির্বাসনে গেল গণতন্ত্র। শাসকগোষ্ঠীর অপরিমেয় দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের ফলে ১৯৭৪ সালে এ দেশে নেমে এলো এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এতে স্বাধীন বাংলাদেশের বহু মানুষ না খেয়ে মারা গেল। সমাজের সর্বস্তরের শৃঙ্খলা ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। জাতি নিপতিত হলো এক গভীর অন্ধকারে। আবারো উত্তরণের পথ অনুসন্ধান করতে থাকল মানুষ।
ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটল সেই বিয়োগান্তক ঘটনা। শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন। ক্ষমতায় আসীন হলেন খন্দকার মুশতাক আহমাদের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগেরই একাংশ। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে মুশতাক মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার প্রায় সব মন্ত্রী। তাতে যে অনিশ্চয়তা কেটেছিল এমন নয়। সামরিক অভ্যুত্থান-পাল্টাঅভ্যুত্থান চলছিল। এরই প্রক্রিয়ায় পাদপ্রদীপের আলোয় জনগণ ও সেনাবাহিনী আবারো তুলে এনেছিল তাদের প্রিয় জিয়াউর রহমানকেই। এরপর কিছুকাল গণতন্ত্র। তারপর দীর্ঘ ৯ বছর জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন। এরপর ফের নড়বড়ে গণতন্ত্র। এই নিয়ে বাংলাদেশ ৪১ বছর পার করল।
এই ৪১ বছরে কি আমাদের কোনো অর্জনই নেই? এমন হয়তো বলা যাবে না। অভাব, দুর্ভিক্ষ, দীনতার এই দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষ বেড়ে ১৫ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। আমরা নিজেরাই এই ১৫ কোটি মানুষের খাদ্যের সংস্থান করতে পারছি। এ দেশের প্রতিটি মানুষের পায়ে জুতা আছে। সেটা রিকশাঅলাই বলি, আর মাটিকাটা মজুরই বলি। এ দেশের প্রতিটি মানুষের পরবার জন্য গায়ে কাপড় আছে। মানুষ অন্তত দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারছে।
কিন্তু এই ৪১ বছরেও যা হলো না, তা হলো একটি স্থায়ী টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরো শক্তিশালী হতো, তাহলে সন্দেহ নেই, এ দেশের কর্মনিষ্ঠ মানুষ দ্রুতই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারত। গণতন্ত্র এখনো অনিশ্চিত পথের অভিযাত্রী। হোঁচট খেতে খেতে চলছে। গণতন্ত্রে ছদ্মাবরণে স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিচ্ছে। মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নও সমানতালে চলছে। ১৯৭১ সালের তুলনায় এ দেশের শিক্ষার হার বেড়েছে প্রায় চার গুণ। মিডিয়ার বিস্তার ঘটেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে সাধারণ মানুষ গ্রামগঞ্জে বসে সারা পৃথিবীর খবর নিমিষেই জানতে পারছেন। জনগণকে খুব বেশি বোকা বানানো যাচ্ছে না। ভরসা সেটুকুই। যদি আমরা এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারি, গণতন্ত্রকে যদি আরো একটু দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাহলে সামনে সুদিনের অপেক্ষা করা যায়। সে আশাতেই বুক বেঁধে আছি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন