বাংলাদেশে রাজনৈতিক খুনোখুনি নতুন ঘটনা নয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বর্বরোচিত পন্থায় লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে কিংবা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। রাজনীতির হানাহানিতে যে শুধু প্রতিপক্ষই খুন হয় তা কিন্তু নয়; সাধারণ মানুষের খুন হওয়ার ঘটনাও ঘটে। রাজধানীর শাহবাগে বাসে আগুন ধরিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনাও আমরা দেখেছি। রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা যথাক্রমে শেখ মুুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানও খুন হয়েছেন। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালিয়েছিল মূলত ভুট্টোর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে। রাজনীতির কারণে শুধু যে রাস্তাঘাটে খুনখারাবি হয় তা নয়, সংসদের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়, পেপারওয়েট ছুড়ে স্পিকারকে মেরে ফেলার ঘটনাও অতীতে ঘটেছে। এভাবে পেছনে যেতে থাকলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডে রাজনৈতিক কারণে খুনের ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর যেভাবে প্রকাশ্যে রাজপথে পুরনো ঢাকায় মানুষ পিটিয়ে মারা হয়েছে কিংবা গত রোববার যেভাবে বিশ্বজিৎকে মারা হলো, এটি অপেক্ষাকৃত নতুন প্রবণতা। অগ্রহণযোগ্য এই প্রবণতাকে যদি শুরুতেই থামিয়ে দেয়া না হয়, তবে এ ধরনের পাশবিক খুনোখুনি সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে বৈ কমবে না। একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য মানুষ হত্যার এই ধারা শুধু অগ্রহণযোগ্য নয়, জঘন্য অসভ্যতাও বটে। বর্বর সমাজে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস চরম ছিল। অন্য দিকে সভ্যসমাজে ভিন্ন মতের মানুষেরা একত্র হয়ে বসবাস করে শান্তিপূর্ণভাবে। বাঙালিরা কখনোই অসভ্য ও বর্বর জাতি ছিল না। তাহলে প্রশ্ন হলো, প্রাচীন জাতি বাঙালি একুশ শতকে এসে কেন অসভ্যতা ও বর্বরতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে? বিদেশীরা আমাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়; জনহিতৈষী বলে আমাদের এই জাতির সুনাম আছে বিশ্বজোড়া। তাহলে সে জাতি কেন নির্মম নিষ্ঠুরতার দিকে আগাচ্ছে?
সে দিন টেলিভিশনের এক টকশোতে একজন বক্তা বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় রাজনীতি করে, এমন মানুষদের ‘নাই’ করে দেয়ার কথা বললেন। অন্য বক্তা জানতে চাইলেন সেটা কিভাবে সম্ভব? তখন ‘নাই’ করে দেয়ার পক্ষের বক্তা বললেন, জনগণই একসময় তাদেরকে আর ভোট দেবে না। তখন তারা ‘নাই’ হয়ে যাবে। আমার মনে হলো, আধুনিক হিটলারকেই দেখছি। উপস্থাপক কিছু বলছেন না। অন্য বক্তা বললেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম, বিধর্ম সব কিছুই থাকবে। গণতন্ত্র তো তাই বলে। উপস্থাপক ‘আর সময় নেই’ বলে তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানলেন। কিন্তু যে বার্তা ততক্ষণে ছড়িয়ে গেল ইথারে সেটি কিন্তু ভয়ানক। টকশোর বক্তারা সমাজের নেতৃস্থানীয় ও দায়িত্বশীল মানুষ। তারা কোথায় সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবেন তা না, নিয়ত সমাজে বিভক্তির বিষবাষ্প ছড়াচ্ছেন। আমি গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়ানো মানুষ। তাই সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাই, বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, পুরো দেশটাকে বিএনপি আর আওয়ামী লীগে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু যারা বিভক্ত করেছেন তারা নিজেরা বিভক্ত হননি। একই পরিবারে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সহাবস্থান। জামায়াত ও আওয়ামী লীগের নেতাদের আত্মীয়তার দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির প্রয়াস কেন? উত্তরটা সবার জানা। ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি ওদের খেদানোর ৬৫ বছর পরও বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট মানুষের কাছে দিনে দিনে তীব্র আসক্তির বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাজনীতিতে ভালো মানুষের সংখ্যা যেন ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ফলে মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করার দৃষ্টান্ত কমে যাচ্ছে। এখনকার রাজনীতিবিদ অনেক মানুষকে মানুষ হতে না শিখিয়ে লোভী অমানুষ হিসেবে গড়ে তুলছেন। নেতিবাচক যা কিছু, তার জয়জয়কার সব দিকে।
মিথ্যা বলাটা এখন পরিণত হয়েছে ফ্যাশনে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য দায়িত্বশীল মানুষেরাও দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে মিথ্যা বলছে। অবিশ্বাস আর সন্দেহের প্রকোপ বেড়েছে অনেক। তরুণসমাজকে বোঝানো হচ্ছে দেশের সম্পদ কম, ফলে দখল নিতে হবে। যুবসমাজ দলবাজি করে। রাজনীতি করে দখলের। তাদের কাছে রাজনীতি মানে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি, কয়েকটি প্লট, কয়েক কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স, অঢেল সম্পদ আর সীমাহীন ক্ষমতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যা খুশি তাই করা প্রয়োজন ও বৈধ মনে করা হয়। এমনকি, লাশের রাজনীতি করা। এখন তারা স্বপ্ন দেখে কখন তাদের দল ক্ষমতায় আসবে। আর ক্ষমতাসীনেরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। এটা এখন ভয়ানক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সেই ব্যাধির সর্বশেষ বলি নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎ দাস।
এই দেশের একজন ভোটার হিসেবে সুস্পষ্টভাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণ যখন আইন হাতে তুলে নেয়, তখন জনগণের জীবনই বিপন্ন হয় না রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিকট অতীতে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই ২০০৬ সালে পল্টনমোড়ে লাঠি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ মারা হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে সামরিক সরকার ক্ষমতা হাতে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। সে সময় বিরোধী দলগুলো দেশে নৈরাজ্য উচ্ছৃঙ্খলতার বিস্তার ঘটাতে তৎপর ছিল।
পথেঘাটে, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, রেস্টুরেন্ট, ফেসবুক আর ব্লগগুলোতে দেখতে পাই দেশের তিন কোটি তরুণ ভোটারের মনোবল ভেঙে গেছে। তারা মনে করছে দেশটা আর আগাবে না। কথাটি কিন্তু ঠিক নয়। এই দেশ মহান দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ, চোর-বাটপারের দেশ নয়। তরুণদের নিজেদেরই সেটা প্রমাণ করতে হবে। অন্যের অধিকার হরণ করে যে রাজনীতি, সেই কলুষিত রাজনীতিকে ‘না’ বলতে হবে। চাপাতি আর রামদা দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, ধ্বংসই সম্ভব, সে কথা তাদেরকে বুঝতে হবে। তাদেরকে আরো বুঝতে হবে, দেশের সম্পদ সীমিত নয়। বরং পরিশ্রম আর নেতৃত্ব দিয়ে এই সম্পদকে বহু গুণে বাড়িয়ে তোলা সম্ভব। তরুণদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে; হাতে হাত আর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের কল্যাণে জারিত সেবায় সহাবস্থান নিতে হবে। বিভক্তিরও হিংসার রাজনীতিকে কাগজের ঠোঙার মতো দুমড়ে-মুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে। বিশ্বজিতের লাশই হোক এ দেশের তরুণদের হাতে নিহত তরুণদের শেষ লাশ। তারা বুঝতে শিখুক ‘মানুষ’ বিশেষ করে কোনো দেশ, ধর্ম কিংবা দল নেতা ও সমাজের নয়। তারা আরো বুঝতে শিখুক, দেশের মালিক জনগণ হলেও আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কারো জন্য বৈধ নয়। কারণ উত্তেজিত জনতা যখন আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তখন বিচার হয় না, হয় অবিচার।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন