৩০ নভেম্বর একটি জনপ্রিয় ধর্মনিরপেতাবাদী খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছোট্ট খবর ছিল, ‘প্রকাশ্য কর্মসূচিতে ফিরছে জামায়াত। চোরাগোপ্তা মিছিল এবং পুলিশের ওপর আক্রমণের পথ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি এবার আগাম ঘোষণা দিয়ে ৩ ডিসেম্বর রাজধানীর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ ওই দিনেরই আরো টুকরো খবর : ‘জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২৯ নভেম্বর সিলেটে জনসভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।’ একই দিনে ১৮ দলীয় বিরোধী জোটের তরফে পত্রিকায় খবর : ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর আওয়ামী লীগের তৃতীয় শ্রেণীর মাস্তানের মতো কথাবার্তা বলছেন’। এই মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। ২৯ নভেম্বর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ১৮ দলের সমাবেশ-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা আগুন নিয়ে খেলছেন। দাড়ি-টুপি এবং সাধারণ মানুষকে জামায়াতের নামে হয়রানি, গ্রেফতার করছেন। এসব কিসের আলামত? (জামায়াতকে) তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে দিতে হবে। জামায়াতের ওপর আক্রমণ বন্ধ করুন। তারপরও যদি জামায়াত পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায় তাহলে আমরা সরকারের পে থাকব।’
জামায়াত-শিবির দমনের নামে দাড়ি-টুপির হয়রানি, পুলিশি নির্যাতন, সারা দেশে নির্বিচার ধরপাকড় থামাননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। উল্টো জামায়াতের আহূত জনসভা ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছেন। জামায়াতও পাল্টা ঝটিকা মিছিল আর পুলিশ তাড়া করার মওকা পেলেই রুখে দাঁড়ানোর কৌশল বজায় রেখেছে। জনসভা করতে না দেয়ায় হরতাল ডেকেছে। বিএনপি জামায়াতের ‘জঙ্গিপনা’র বিরুদ্ধে সরকারের প নেয়ার সুযোগ পায়নি। বরং হরতালকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে।
১ ডিসেম্বরের কাগজে টুকরো খবর ছিল, ‘বিজয়ের মাস শুরু। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর মুক্তিযোদ্ধাদের অপূর্ণ আকাক্সা পূরণের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন এই মাসের নানা কর্মসূচি শুরু করবে।’ একই দিনে প্রধান বিরোধী দল ও সহযোগীদের ‘সাংস্কৃতিক’ তৎপরতার খবর : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারকে মতাচ্যুত করা হবে।’ ৩০ নভেম্বর নয়াপল্টনে জাসাস আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার উদ্বোধনকালে তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান সরকার দেশ-বিদেশের চক্রান্তকারীদের ওপর ভর করেই মতায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চক্রান্ত করে জিয়াউর রহমানের পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছেন। এর মধ্যে তারেক রহমান একজন। যতই মিথ্যাচার করুন, তিনি সত্যিকার গণমানুষের নেতা হিসেবেই দেশে ফিরে আসবেন।’ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৪৮তম জন্মবার্ষিকী উপলে ওই শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।
২ ডিসেম্বরের খবর : ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল’ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়তে খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করুন। জামায়াত-শিবির ছাড়ুন। তাহলে যদি বাংলার মানুষের মনে একটু জায়গা হতে পারে। যতই চেষ্টা করুন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে পারবেন না’। তারপর সরাসরি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেন : ‘জিয়াউর রহমান মতা দখল করে দেশের সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করেছিলেন। তারপর তার (জিয়ার) স্ত্রী খালেদা জিয়াও তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছেন। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি (খালেদা) কালো টাকা সাদা করেছেন। তার দুই ছেলে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতে জড়িত হয়ে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে। এখন তার (খালেদা) বড় ছেলে লন্ডনে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। তার আয়ের উৎস জানতে চাই’। তথা ‘সত্যিকার গণমানুষের নেতা হিসেবে’ তারেক জিয়ার দেশে ফেরার পথে দুর্নীতি দমন আইনের বাধার কথা মোটাদাগে স্মরণ করিয়ে দিলেন শেখ হাসিনা।
তারপর ৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ৪২তম বার্ষিকী উপলে আওয়ামী লীগের মাসব্যাপী কর্মসূচি ও বিজয়োৎসবের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা : ‘আমাদের বিরোধী দলের নেত্রী মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত, গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের রার জন্য বিজয়ের মাসে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছেন। এই স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসররা যাতে আর ছোবল মারতে না পারে সে জন্য সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে জাগ্রত হতে হবে। বিচার সম্পন্ন করে এদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা হবে।’
এই ‘নির্মূল’ করার ‘কিউ’টা সম্ভবত আগেভাগে জেনে নিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কে ২ ডিসেম্বর জাতীয় চোরাচালান প্রতিরোধ কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর জানালেন, ‘ঢাকা মহানগর পুলিশের অনুমতি না নেয়ায় সোমবার (৩ ডিসেম্বর) জামায়াতে ইসলামীকে সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। প্রচলিত আইনে রাজধানী ঢাকায় সভা-সমাবেশ করতে হলে যেকোনো দলকেই ঢাকা মহানগর পুলিশের অনুমতি নিতে হবে। আমার জানা মতে, এখন পর্যন্ত জামায়াত পুলিশ কমিশনারের অনুমতি নেয়নি বা অনুমতির জন্য কোনো আবেদন করেনি। তাই বিনা অনুমতিতে ঢাকা বা দেশের কোনো অঞ্চলে আমরা কোনো বেআইনি সমাবেশ করতে দেবো না’। অনুমতি ছাড়া ঢাকায় সভা করতে না দিলেও অন্যত্র কেন দেয়া হবে না, তা বলেননি তিনি। এর আগে এক বিবৃতিতে জামায়াতের ঢাকা মহানগর কমিটির আমির রফিকুল ইসলাম খান জানিয়েছিলেন, সমাবেশ ও তাতে মাইক ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে গত ২৯ নভেম্বর পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন করেছেন এরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে সৃষ্ট বিভ্রম দূর করতে সাংবাদিকেরা ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মো: মাসুদুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চান। ডিএমপি উপকমিশনার বলেন, ‘জামায়াত সমাবেশ করার জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের পর সভার অনুমতি চেয়ে জামায়াতের আবেদনপত্রে ডিএমপির প্রাপ্তি-সিলমোহরসহ পত্রটির সম্প্রচার হয় জামায়াতের ওয়েবসাইটে, ছাপানো হয় দু-একটি দৈনিকেও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অপ্রয়োজনে অকাতরে ডাহা মিথ্যা কথা বললেন। আর প্রধানমন্ত্রী বিজয়ের মাসে বিজয়োল্লাস খর্ব করতে বিরোধী জোটের বিােভ সমাবেশ ও ৯ ডিসেম্বর অবরোধ কর্মসূচির ‘ভ্রষ্টাচার’-এর কথা বললেন। বিরোধী দলের জবাব : ১৯৯৫ সালে বিজয়ের মাসেই আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকে অনেক জ্বালাও-পোড়াও করেছে। প্রধানমন্ত্রীকে অতীত স্মরণ করিয়ে দিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জবাবে তিনি আরো বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিএনপি রাজনীতি করে না।’
জামায়াতে ইসলামীর জবাব : পূর্বঘোষিত বিােভ সমাবেশ করার অনুমতি না দেয়ায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মঙ্গলবার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল পালন করবে। নিষিদ্ধ সভার দিন জারি করা ১৪৪ ধারার মধ্যেও জামায়াত হরতালের সমর্থনে দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিলে সমাবেশ করেছে। দিনাজপুরে বিােভে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হয়েছে।
তারপর দেরি করে হলেও বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে : ‘দেশের প্রচলিত আইনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে গতকাল শান্তিপূর্ণ জনসভা অনুষ্ঠানে সরকারি বাধা দেয়ার অন্যায়, বেআইনি ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে তাদের ডাকা আজকের হরতাল কর্মসূচি যৌক্তিক ও গণতান্ত্রিক। জামায়াতের কর্মসূচি বানচালের জন্য পুলিশ বাহিনীর সাথে ছাত্রলীগ, যুবলীগ কর্মীদের মাঠে নামানোর ন্যক্কারজনক ঘটনা দেশকে রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের পথে ঠেলে দিচ্ছে বলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী জনগণ দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে শঙ্কিত। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আহূত হরতাল কর্মসূচির প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নৈতিক সমর্থন ঘোষণা করছে।’ ৩ ডিসেম্বর রাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে এই সমর্থনের কথা জানান।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ৪ ডিসেম্বর হরতাল ঠেকাতে রণপ্রস্তুতি নিয়ে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অতীতের যেকোনো হরতালের চেয়ে অধিকসংখ্যক পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েন থাকবে রাজধানীতে। এই রণপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে থাকবে রায়ট কার, জলকামান ও দাঙ্গা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১০ হাজারের বেশি সদস্য, যাতে জামায়াত হরতালের সমর্থনে কোথাও মিছিল বা পিকেটিং করতে না পারে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবশ্য দিল্লিতে ছুটতে হলো সীমান্ত সহযোগিতা আর বন্দী প্রত্যর্পণ নিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল সিন্ধের সাথে কথা বলতে। আর যথারীতি দ্বিপীয় স্বরাষ্ট্র বৈঠকের আগেভাগে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বাড়িয়ে দিলো বিএসএফ। রোজই এখন কাগজে আসছে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা ও অপহরণের খবর।
যা হোক, পুলিশের রণপ্রস্তুতি হরতাল ঠেকাতে পারেনি। সারা দেশই অচল ছিল ৪ ডিসেম্বর। পুলিশ ও সরকার-সমর্থকদের সাথে হরতালকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ, গুলি, টিয়ার শেল, গ্রেনেড চার্জ এবং লাঠিপেটা ও ইটপাটকেল নিেেপর মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক হরতালে সাধারণ মানুষের নীরব সহানুভূতির বিলণ অভিব্যক্তি ঘটেছে।
সরকারের চাপে টেলিভিশন সংবাদদাতারা বলেছেন, হরতাল পালনের নামে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরসহ ‘সহিংসতা’ চালাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী আর ইসলামী ছাত্রশিবির। তারা ভোর থেকেই সহিংস তৎপরতা শুরু করেছে। বিভিন্ন সড়কে পুরনো টায়ারে আগুন ধরিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সারা দেশে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে, অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে, গাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। পুলিশের হিসাব, সারা দেশে দিনভর ১১১টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, অনেক গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ১৪টি গাড়ি ভাঙচুর বা পোড়ানো হয়েছে।
আবার টেলিভিশনে ভাঙা বাসে আগুন দেয়া আর রাস্তায় টায়ার জ্বলার পাশাপাশি নিরস্ত্র লোককে ধরে পুলিশের বেদম লাঠিপেটার ছবিও এসেছে। রাজধানীর মহাসড়কজুড়ে মতাসীন দলের ‘ছাত্রযুবক’দের হরতালবিরোধী মিছিলের নিñিদ্র চলন্ত ব্যারিকেড আর মোটরসাইকেলের বহর ছিল দৃশ্যমান। সরকারপরে এমন পাল্টা ‘সড়ক অবরোধ’ ভেদ করে কোনো লোকের সেদিন পথ চলা বা সাইকেলে চলারও জায়গা ছিল না। এভাবে হরতালটা সরকারপই পাকাপোক্ত করে তুলেছে। পুলিশ নিশ্চয়ই এমন অবরোধের লিখিত বা মৌখিক অনুমতি দিয়েছে। পুলিশ যেখানে পেরেছে হরতাল-সমর্থকদের মিছিল ও পিকেটিংয়ে বাধা দিয়েছে; পুলিশ জামায়াত-শিবিরের-নেতাকর্মীদের ওপর গুলি চালিয়েছে। পিকেটারদের ওপর হামলায় পুলিশকে মদদ দিয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষে পুলিশসহ তিন শতাধিক আহত হয়েছেন। গ্রেফতার হয়েছেন চার শতাধিক লোক। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অনেকে সাধারণ পথচারী বলে দাবি করেছে। জামায়াতে ইসলামী দাবি করেছে, মতিঝিল থানা আমিরসহ তাদের ৬০ নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন রাজধানীতে। পুলিশ বলেছে, গ্রেফতারের সংখ্যা ৬৯। এ দিকে হরতাল চলাকালে রাজপথ ছিল ফাঁকা। বেশির ভাগ রাস্তায় যানবাহন চলেনি। শিাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, বিপণিবিতান বন্ধ ছিল। অলিগলির দোকানপাটও বন্ধ দেখা গেছে। সরকারি অফিস-আদালত খোলা থাকলেও উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা। দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চ চলাচল করেনি। ট্রেন যাত্রী ছিল কম। পুলিশ পাহারা দিয়েও যানবাহন চালানো সম্ভব হয়নি। এমন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল সম্প্রতি দেখা যায়নি।
পুলিশ মিরপুরের কালসী ও খিলগাঁও এলাকায় হরতাল-সমর্থকদের ওপর গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড চার্জ করে। কালসী এলাকায় পুলিশের টিয়ার শেল ও গুলিতে আহত হরতাল-সমর্থকদের ধরে নির্মম পিটুনি দেয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারেরা। পুলিশের চোখের সামনে তারা জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের মারধর করে আধমরা করে রাস্তায় ফেলে যায়। পরে তাদের হাসপাতালে নেয়া হলেও চিকিৎসা না দিয়ে আবার থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
ঘোর জামায়াতবিরোধী কোনো কোনো পত্রিকার সংবাদভাষ্যকার আপে করেছেন, হরতাল মোকাবেলায় পুলিশ অনেকটা নিষ্ক্রিয় ছিল। রাজধানীর ফার্মগেট, মহাখালী, কারওয়ান বাজার, পল্টন, কাকরাইল, বাংলামোটরসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, হরতালের সময় রাস্তায় বা পাশে পুলিশ জড়ো হয়ে চুপচাপ বসে আছে। কারওয়ান বাজার বা বাংলামোটরে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা যখন গাড়িতে ভাঙচুর করেছে, তখন পুলিশ প্রতিরোধ করার কোনো চেষ্টা করেনি। হামলা করে চলে যাওয়ার পর সাধারণ পথচারী থেকে পুলিশ কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে গেছে। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার বলেছেন, পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ সঠিক নয়।
ইতোমধ্যে আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে মতৈক্যে পৌঁছাতে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আলোচনায় বসেছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাংলাদেশবিষয়ক সর্বদলীয় কমিটির আমন্ত্রণে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে হাউজ অব কমন্সের পোর্ট কিউস হাউজে। দুই পরে নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করা ছাড়া অগ্রগতি হয়নি। বলা চলে, জামায়াত দমনের যোশে হরতালের ফ্যাসাদ বাধিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লন্ডনের ওই সমঝোতা বৈঠক বাহ্যত ভণ্ডুল করেছেন।
একটা কথা সবাই বুঝেছে : জামায়াত ঢাকার রাস্তায় ২০০৬ সালের আওয়ামী লীগের মতো লগি-বৈঠা নিয়ে না নামলেও ‘হিট অ্যান্ড রান,’ পিকেটের এই কৌশল দিয়ে এ দেশে কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছে। তবে আতঙ্কে নয়, অনেক মানুষই স্বেচ্ছায় হরতাল পালন করছে। কার হরতাল, কেন হরতাল, সে কথা এখন কেউ জিজ্ঞাসা করছে না। বেশির ভাগ মানুষ দুরাচার দুর্নীতি দুর্মূল্যের কারণে সরকারের ওপর প্রচণ্ডভাবে বীতশ্রদ্ধ। তাদের নীরব প্রতিবাদই টেলিচিত্রে অচল দেশ আর পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদনের ভাষা পেয়েছিল এই হরতালকে উপল করে। স্থানীয়ভাবে হরতাল প্রলম্বিত হয়েছে দিনাজপুরে, যেখানে পুলিশের গুলিতে নেতা হত্যার প্রতিবাদে পরপর দুই দিন পুরো জেলা-উপজেলা শহরগুলো অচল ছিল। সারা দেশে পুলিশের নিবর্তনমূলক আটকাভিযান হরতালের পরও ছিল অব্যাহত। জামায়াত-শিবির কর্মীর পাশাপাশি বিএনপির কিছু নেতাকর্মীও গ্রেফতার হয়েছেন। জামায়াত-শিবিরের ১৪৭৩ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
ধর্মনিরপেতাবাদী খবরের কাগজে সংবাদভাষ্য এসেছে : ‘জামায়াতে ইসলামীর ডাকা দেশব্যাপী হরতালে নৈতিক সমর্থন নিয়ে বিএনপির অনেক নেতাই দলীয় হাইকমান্ডের ওপর নাখোশ হয়েছেন। তাদের মতে, বিএনপি শুরুতে জামায়াতের ডাকা হরতালে কৌশলী অবস্থানে থাকলেও পরে তাদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব:) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দলীয় সিদ্ধান্তেই এই হরতালে সমর্থন দেয়া হয়েছে; তবে বিজয়ের মাস হিসেবে অনেক কিছু চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) হান্নান শাহ বলেন, ‘ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। তাই বলে এ মাসে কোনো ঘটনা সংঘটিত হবে না? এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না।’
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অপর শরিক এলডিপি, জাতীয় পার্টিসহ (জেপি) অনেক দলই নীরব ভূমিকা পালন করেছে।’
অন্য দিকে জামায়াতের একক আহ্বানে দেশে সফল হরতাল অনুষ্ঠানের প্রতিক্রিয়ায় বিজয়ের মাস ডিসেম্বর থেকে স্বাধীনতার মাস মার্চ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। বলা হয়েছে, সরকারের প্রশাসনের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের প্রেতাত্মা রয়েছে। এরা চক্রান্ত করে বর্তমান সরকারের সফলতা নস্যাৎ করতে চায়।’ তবে ইতোমধ্যে বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের সমর্থক ও কর্মীদের মধ্যে এবং সাধারণভাবে বিুব্ধ জনসমাজে ৪ ডিসেম্বর হরতাল যে মনস্তাত্ত্বিক উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে, তার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়েছে বিরোধী জোটের পরবর্তী কর্মসূচিতে। সংসদীয় বিরোধী দলনেতা খালেদা জিয়া ইতঃপূর্বেই কোরবানির ঈদ-পরবর্তী ‘কঠোর’ কর্মসূচির যে এক মাসের ফিরিস্তির বিলম্বিত ঘোষণা দিয়েছিলেন ২৮ নভেম্বর, তার একমাত্র কঠোর দিক ছিল ৯ ডিসেম্বরের সারা দেশের মহানগর-জেলা-উপজেলা ও থানায় ‘সড়ক অবরোধ’। বলেছিলেন : ‘কোনো কর্মসূচিতে বাধা দিলে পরিণতি শুভ হবে না। প্রয়োজনে লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।’ জামায়াতের সফল হরতালের পর বিভিন্ন মহলে অনেক বিএনপি নেতাকর্মী সেই হুঁশিয়ারিরই পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, সড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে ‘বাধা দিলেই হরতাল।’ ১৮ দলীয় জোটের সিদ্ধান্ত হয়েছে, ৯ ডিসেম্বর সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ৮ ঘণ্টাব্যাপী এই কর্মসূচি পালিত হবে। রাজধানীসহ সব বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা ও পৌরসভায় কর্মসূচি পালিত হবে। অবরোধ হবে শান্তিপূর্ণ। আর তাতে বাধা দিলে পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী ও সরকার দায়ী থাকবে।
ধর্মনিরপেতাবাদী পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছে : নরমপন্থী বিএনপি নেতারা আশ্বাস দিয়েছেন, সরকার হাঙ্গামা না বাধালে আট ঘণ্টার অবরোধ, তাও সাপ্তাহিক ছুটির লাগোয়া, তাতে গোলযোগ হওয়ার কথা নয়। অবরোধ কর্মসূচিতে সারা দেশ অচল করে দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে একটি ‘চরম বার্তা’ দিতে চায় বিএনপি। এরপরও সরকার নমনীয় না হলে জানুয়ারি থেকে লাগাতার কর্মসূচি নিয়ে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
কিন্তু যা ঘটেছে, ওই সব পত্রপত্রিকাতেই তার বর্ণনা : রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, গুলি, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী ১৮ দলীয় জোটের ডাকা রাজপথ অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। রোববার ভোর ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ৮ ঘণ্টার এ অবরোধ চলাকালে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে তিনজন নিহত হয়। ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নাজিমউদ্দিন আলম, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও এক উপসচিবসহ সহস্রাধিক লোক আহত হয়েছেন। সারা দেশে ছয় শতাধিক যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিএনপি দাবি করেছে, নাটোর থেকে বিএনপির স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জোটের কমপে ৭০০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। সকাল থেকে শহর-গ্রাম প্রকম্পিত হয়েছে গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেল আর ককটেল বিস্ফোরণের শব্দে। দিনভর চলা সে তাণ্ডবে ৯ ডিসেম্বর কার্যত অচল ছিল সারা দেশ।
সংঘর্ষে নিহত তিনজন ছাড়াও অবরোধ ঠেকানোর ল্েয পুরান ঢাকায় অমানবিক এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। অবরোধকারীদের সহিংসতা ছাপিয়ে দিন শেষে সব ধিক্কার বর্তেছে ছাত্রলীগের মাথায়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট এরপর কড়া হরতাল পালন করেছে সকাল-সন্ধ্যা ১১ ডিসেম্বর। অন্য দিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আটক রাজনৈতিক নেতাদের দ্রুত বিচার শুধু নয়, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে ‘বিজয়ের মাস’-এর পবিত্রতা উপো করেই ১৮ ডিসেম্বর হরতাল ডেকেছে সিপিবি নেতৃত্বাধীন ‘বাম মোর্চা’। মূলধারার দুই শিবিরের দোষারোপের রাজনীতি আর মতার দ্বন্দ্ব এখন স্পষ্টত গণ-অসন্তোষের প্রাবল্যে সংঘর্ষের চোরাবালিতে পা ফেলেছে। ভূ-রাজনীতির হিসাবও বদলে দিয়েছে ডিসেম্বরের প্রথম হরতাল ও প্রথম অবরোধ।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন