ড. আবদুল হাই তালুকদার
০৯-১২-২০১২ তারিখে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকে বাংলাদেশে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হলো। বলতে গেলে এ কর্মসূচিটি ছিল অভিনব। শান্তিপূর্ণ অবরোধের ডাক ১৮ দলীয় জোটনেত্রী ঘোষণা করেছিলেন। দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির সরকার, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, লুটপাট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ ইত্যাদি। বাংলাদেশে অভাবনীয় কর্মকাণ্ড ঘটে চলেছে, যার প্রতিবাদ বিএনপি নেত্রী অহিংস কর্মসূচি দিয়ে করছেন। কিন্তু সরকার এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করা তো দূরে থাক, বরং উত্সাহ দিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা সরকারের তরফ থেকে উত্সাহ পেয়ে আরও দ্বিগুণ শক্তিতে বলীয়ান হয়ে একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে। সরকারি আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশের অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সর্বত্র নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি, কীভাবে পুলিশের সামনে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের পিটিয়ে তক্তা বানাচ্ছে। সকারের সমান্তরাল সরকার হিসেবে কাজ করছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারীরা। এতে পুলিশের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে, চেইন অব কমান্ড বিঘ্নিত হচ্ছে। মানুষ অবাক বিস্ময়ে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হচ্ছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে টকশোতে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। পত্রিকার পাতা ওল্টালে সরকারি ছাত্র ও যুব সংগঠনের মারামারি, হানাহানি ও কোন্দলের চিত্র ভেসে উঠছে। ০৭-১২-১২ তারিখের ইত্তেফাকে গত চার বছরে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ডের একটি ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩৭৪টি রাজনৈতিক সংঘাতে তারা জড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে ৩২২টি তাদের নিজেদের মধ্যে কোন্দল। এই যখন তাদের অবস্থা, তার ওপর সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উত্সাহব্যঞ্জক বাণী তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। ক’দিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছেলেদের উদ্দেশে ঘোষণা দিয়েছেন—যেখানেই জামায়াত-শিবির পাওয়া যাবে ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ কর। অবশ্য যুবলীগ সভাপতি পুলিশের কাজ যুবলীগের ছেলেরা করবে না বা করা উচিত হবে না বলে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এ কাজটি তারা অনেকদিন ধরে করে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাণীটি পেয়ে তাদের কর্মকাণ্ড যেন বেড়ে গেছে। অবরোধের দিন তারা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে জখম করেছে। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীদের পর্যন্ত বেধড়ক পিটিয়ে আহত করেছে। তাদের আক্রমণ থেকে মনে হয়েছিল তারা যেন নির্দেশিত হয়ে বিশেষ মিশন নিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের শায়েস্তা করতে নেমেছিল। তাদের হাতে লাঠিসোটা, রামদা, কিরিচ ও আগ্নেয়াস্ত্র দেখে মানুষ বিস্মিত ও হতবাক। অস্ত্রের ঝনঝনানি অবরোধের দিনটিকে অশান্ত ও সহিংস করে তুলেছিল।
গণতন্ত্রের শিক্ষানীতি বিসর্জন দিয়ে সরকার বিরোধী দলকে ফ্যাসিস্ট কায়দায় মোকাবিলা করছে বললে বোধ হয় বাড়িয়ে বলা হবে না। সরকার বার বার ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে বেগম জিয়া আন্দোলন করছেন। বিজয়ের মাসে অবরোধ দিয়ে বিজয়কে খাটো করা হচ্ছে। এসব সায়সত্তাহীন বক্তব্য দিতে গিয়ে সরকার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অবরোধের আগেই বিএনপি মহাসচিব দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আপনারা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনে নিন, আমরা অবরোধ কর্মসূচি বন্ধ করে দেব।’ এর চেয়ে আর পরিষ্কার করে কী বলা যায়? বিএনপি সেক্রেটারি জেনারেলের ঘোষণা অনুযায়ী সরকার তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে এ বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করলে বিএনপি তথা ১৮ দলকে আন্দোলন কর্মসূচি দিতে হয় না। আন্দোলন সংগ্রাম করে নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের অপচয় না করে বিরোধী দল নির্বাচন বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে। কিন্তু সরকার নির্বাচনকালীন সরকার
বিষয়ে উচ্চবাচ্য না করে দোষারোপের রাজনীতি চালু রেখেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
আমি বেশক’টি লেখায় বলেছি, বেগম জিয়া অত্যন্ত দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক রাজনীতিক। তিনি মনেপ্রাণে চান দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাক। জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধন না করে মানবকল্যাণমুখী রাজনীতি করে তিনি ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে চান। আর সে কারণে শত প্ররোচনা সত্ত্বেও তিনি ধৈর্যহারা না হয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন। আমি অনেক আগেই বলেছি, খাঁটি দেশপ্রেমিক ও মানবপ্রেমিক হিসেবে বেগম জিয়া কিছুতেই ১৭৩ দিন হরতাল বা কোনো সহিংস কর্মসূচি দেবেন না। বেগম জিয়ার নরম কর্মসূচিকে সরকার বিএনপির দুর্বলতা ভাবছে। বিএনপি একটি শান্তিপ্রিয় সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল। এ দলের রয়েছে লাখো-কোটি নেতা, কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী। গত সংসদ নির্বাচনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মধ্যেও বিএনপি ৩৪ ভাগ ভোট পেয়েছে। বিএনপি কোনো হঠকারী ফেলনা রাজনৈতিক দল নয়। তাছাড়া এ দলের সঙ্গে ১৮ দল জড়িত। মহাজোটের শরিক দলগুলোর অধিকাংশের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। ১৮ দল ও মহাজোটের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন—সবার দাবি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে আগামীতে কয়েকটি নির্বাচন হোক। টকশোর ৯৯ ভাগ বক্তা এই পদ্ধতির পক্ষে মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু সরকারি দলের অগণতান্ত্রিক, একগুঁয়েমি ও একদেশদর্শী মনোভাব ও নীতির কারণে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির সুরাহা হচ্ছে না। এভাবে একা চলার নীতি গণতন্ত্রে অচল ও বর্জনীয়। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সরকারের এরূপ কাজ কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। দেশের ও আন্তর্জাতিক সমাজের সবাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সমর্থন করছে না। সবাই চাচ্ছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তির সুবাতাস বয়ে যাক। আমার মনে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাজি হলে এ সমস্যা
নিমিষেই দূর হবে। তার কথা তার দলের নেতাকর্মী কেউ বিরোধিতা করবেন না।
বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দল রাজপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করবে—গত মাসের এ ঘোষণা বেগম জিয়া ঢাকায় মহাসমাবেশ থেকে দিয়েছিলেন। ৯ তারিখে সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ঢাকার ছয়টি প্রবেশপথসহ দেশের প্রধান প্রধান সড়ক অবরোধ করে। পুলিশ অবশ্য রাজপথ অবরোধ করতে দেবে না বলে জানায়। ভোর হওয়ার আগে তারা রাজধানীর প্রবেশপথগুলো দখল করার ঘোষণা দেয়। তাছাড়া রাজধানীতে ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করার ঘোষণা আসে। তবে জনগণ প্রত্যক্ষ করে, হাজার হাজার পুলিশ, র্যাব, আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর প্রতিরোধ উপেক্ষা করে সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হলো। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথ ছিল যানবাহনশূন্য। প্রতিরোধ কর্মসূচির মারাত্মক বিষময় ফল দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল। সংঘাত, সংঘর্ষ ও মিছিল-সমাবেশ দিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পিকেটাররা অবরোধ সফল করতে মাঠে নামে। সরকারি দলের বাধা পেয়ে আন্দোলন আর অহিংস থাকেনি। মুহূর্তেই দেখা গেল সহিংস ঘটনায় বহু এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ৩ জন নিহত ও আহতের সংখ্যা অনেক। অবরোধ বিরোধী কর্মকাণ্ড কর্মসূচিটিকে অশান্ত করে তোলে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় বিরোধীদলীয় কর্মী সন্দেহে বিশ্বজিত্ দাস নামে এক দোকান কর্মীকে কিরিচ ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। সিরাজগঞ্জে এক জামায়াত কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করে। জলজ্যান্ত দু’জন মানুষকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে মারা দেখে মানুষ স্তম্ভিত ও হতবাক। এ দুটো ঘটনা ২০০৭ সালে লগি-বৈঠা দিয়ে কয়েকজন মানুষকে হত্যা করা ও হত্যার পর লাশের ওপর উঠে নাচন-কুদনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই ঘটনায় যেমন দেশের ও বিদেশের বিবেকবান মানুষ নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়েছিল, এবার তেমনি নিন্দা ও ধিক্কারের সঙ্গে তারা কিছুটা বিস্মিতও।
সরকারি দলের নেতাকর্মী হিসেবে তাদের দায়িত্ব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান, অথচ তারা বিপরীতধর্মী কাজ করে মানুষের নিন্দা কুড়াচ্ছে। গাড়ি চাপায় একজন নিহত হওয়া দেখে চিন্তাশীল মানুষের বিবেক নাড়া দিচ্ছে। মানুষের জীবনকে এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। সরকারের ক্যাডার বাহিনী মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব নিয়ে রাজপথে নামে। বাস্তবে দেখা যায় তারা মানুষ খুন করেছে ও নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে জখম করছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ায় নির্যাতন-নিপীড়নের সচিত্র প্রতিবেদন দেখে দেশ-বিদেশের মানুষ হতবাক ও বিস্মিত। কী করে একজন মানুষ আর একজন জীবন্ত মানুষকে দিনে দুপুরে কুপিয়ে ও পিটিয়ে খুন করতে পারে—বিবেকবান মানুষের কাছে বিষয়টি অকল্পনীয় ও অভাবনীয়। এরূপ নৃশংস ও হৃদয়বিদারক ঘটনা দলের নেতাকর্মীদের বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক। এতে শাসক দলের ভাবমূর্তির সঙ্গে দলের নীতিনির্ধারকদের ভাবমূর্তি সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুলিশের চোখের সামনে এসব লোমহর্ষক ও নিষ্ঠুর অমানবিক কর্মকাণ্ড ঘটে গেল অথচ ছাত্রলীগ বা যুবলীগের কেউ গ্রেফতার হলো না। কর্তাব্যক্তিরা অহরহ বলে থাকেন, ‘আইন সবার জন্য সমান’। কিন্তু ভিডিও ফুটেজ বা পেপার কাটিং দেখে ছাত্রলীগের কোনো ক্যাডারকে ধরা হয়েছে বলে জানা যায়নি। অথচ এই পুলিশ হাওয়ায় পাওয়া ও অনুমানভিত্তিক সংশয় থেকে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা-হামলা চালাচ্ছে। সন্দেহ করে অসংখ্য নেতাকর্মী ধরে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। হাজার হাজার বেনামি আসামি করে বিএনপি নেতাকর্মীদের দৌড়ের ওপর রেখে হয়রানি করা হচ্ছে। অবরোধে নামীয়-বেনামীয় ২৫০০ নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে ও বিএনপি মহাসচিবসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
অবরোধ শান্তিপূর্ণ হতে পারত যার উদাহরণ নয়াপল্টন এলাকার কর্মসূচি। সকাল থেকে নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থক জড়ো হতে থাকে। হাজার হাজার নেতাকর্মী-সমর্থক নয়াপল্টনে সমবেত হলেও সেখানে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। কারণ হিসেবে সহজে অনুমান করা যায়, পুলিশের সংখ্যা খুব কম ছিল। আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী ওই এলাকায় দেখা যায়নি। ফলে বিএনপি নেতাকর্মীরা নির্বিঘ্নে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে কর্মসূচি পালন করেছে। তবে অবরোধ, হরতাল ইত্যাদি কর্মকাণ্ডকে কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। আমাদের কথা হলো, অবরোধ-হরতালের কারণগুলো অপসারণ করা জরুরি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি মেনে নিলে বিরোধী দল হরতালের কারণ খুঁজে পাবে না। হরতালের কারণ দূর না করে দোষারোপ করে বিরোধী দলের আন্দোলন থামানো যাবে না। কারণ ১৯৯৬ সালে একই দাবিতে বর্তমান সরকারি দলের নেতৃত্বে অনেক জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ দেখেছি। দাবি না মানা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন থামেনি। ১৭৩ দিন হরতাল করে মানুষের জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করেছে।
সরকারের একা চলা নীতি বর্জনীয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ ডিসেম্বর সমাবর্তন হয়ে গেল। প্রশাসন একলা চলার নীতিতে অবিচল থেকে কাজ করেছে। শিক্ষকদের একটি অংশ প্রশাসনের দলীয়করণ, অনিয়ম, অবিচার, ’৭৩ এর অধ্যাদেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি অভিযোগ এনে সমাবর্তন বয়কটের ঘোষণা দেয়। প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে একটি দলকে নিয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর থাকে। স্বাধীনতার পর ৪০ বছরে মাত্র একবার সমাবর্তন হয়েছে। সে কারণে এবারের সমাবর্তন অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছিত। আমি কলা অনুষদের ডিন হিসেবে বিষয়টি প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের দৃষ্টিতে আনি ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানাই। কিন্তু প্রশাসন কোনোরূপ আলোচনার উদ্যোগ না নিয়ে একলা চলার নীতি অবলম্বন করে। এতে বাঞ্ছিত অনুষ্ঠানটিতে অনেক ত্রুটি ধরা পড়ে। ’৭৩-এর অধ্যাদেশের স্পিরিটকে অগ্রাহ্য করে একদলীয়ভাবে সমাবর্তন অনুষ্ঠান সমর্থনযোগ্য নয়। সবাইকে নিয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান করতে পারলে সব গ্রাজুয়েট, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার ও দেশবাসী খুশি হতো। ভিসি সাহেব সমাবর্তন বর্জনকারী শিক্ষকদের অংশকে ডেকে সমঝোতার উদ্যোগ নিলে তার মর্যাদা বাড়ত বৈ কমত না। একাডেমিক অনুষ্ঠানকে দলীয়করণ করায় অনুষ্ঠানটির মর্যাদাহানি হয়েছে। চ্যান্সেলরের বদলে শিক্ষামন্ত্রী, ডিনের বদলে ভিসি ইত্যাদি কর্মকাণ্ড অধ্যাদেশ স্পিরিটকে সংরক্ষণ করে না। এটি অধ্যাদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অনুষ্ঠানটি অব্যবস্থাপনার একটি খারাপ দৃষ্টান্ত। রেজিস্ট্রেশন করে চার-পাঁচশ’ গ্রাজুয়েট লাঞ্চের প্যাকেট না পাওয়া একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে এরূপ নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিরোধী দলের যৌক্তিক দাবি না মেনে মহাসচিবকে আটক করা হয়েছে ও তাকে রিমান্ডে নেয়ার পাঁয়তারা চলছে, যা নজিরবিহীন। ’৯৬ সালে এবারের অবরোধের দশগুণ তীব্র অবরোধ ও হরতালে বিরোধীদলীয় মহাসচিবকে কখনও আটক করা হয়নি। ময়লার গাড়িতে ঢিল ছোড়ার অপরাধে মহাসচিবকে গ্রেফতার করে সরকার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছে, যা নিন্দনীয়। অথচ কিরিচ-চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে বিশ্বজিেক খুন করা হলো, সেই চিহ্নিত পাঁচছাত্রলীগ ক্যাডারকে ধরা হচ্ছে না। কী বিচিত্র সরকার ও সরকারি নীতিনির্ধারকদের মানসিকতা! এরা কেউ ছাত্রলীগ করে না—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এরূপ নির্লজ্জ উক্তিতে দেশবাসী লজ্জা পায়। এরূপ বর্বর, নিষ্ঠুর, অমানবিক কর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেশবাসী প্রত্যাশা করে। আমরা অবিলম্বে মহাসচিবকে ছেড়ে দিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করছি। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে গ্রেফতারের হুমকি দেয়া হচ্ছে যা অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক। সরকারের অগণতান্ত্রিক ও নজিরবিহীন ঘটনা ঔপনিবেশিক আমলকে স্মরণ করিয়ে দেয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ জননন্দিত রাজনীতিকদের পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার ও নির্যাতন করেছে যা সত্য। বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে এরূপ চিন্তা করাও অনুচিত ও অনভিপ্রেত। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যেভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, তা এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ। আমরা গণতন্ত্রের স্বার্থে গণতান্ত্রিক নর্মস ও গণতান্ত্রিক চেতনা সমুন্নত রেখে কাজ করার জন্য সরকার ও বিরোধী দলকে আহ্বান জানাচ্ছি।
আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি সরাসরি প্রত্যক্ষ করে উদ্বেগ প্রকাশ করে হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচিকে নিরুত্সাহিত করে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। যে জ্বলন্ত ইস্যুর কারণে বিরোধী দল অবরোধ-হরতাল করছে, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি কনসেপ্টটির সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছে। আমি সরকার ও বিরোধী দলকে বিষয়টিতে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। সরকারের পক্ষে সংলাপ আয়োজন জরুরি হয়ে পড়েছে। বিরোধী দল সংসদে যোগ দিয়ে দাবি জানাতে পারে। সরকার না চাইলেও দেশ-বিদেশের রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব বিবেচনা করছেন। আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যদি নতুন আইন তৈরির প্রয়োজন হয় তা করা উচিত। এজন্য বিএনপিকে সংসদে যেতে হবে।’ আমরাও বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দিয়ে নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বিষয়ে আলোচনা করার আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করা যায়, সংসদে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে একটি সুন্দর সমাধান বেরিয়ে আসবে। বিষয়টি সমাধানের সঙ্গে হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি অকেজো হয়ে পড়বে।
লেখক : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যাল
য়
গণতন্ত্রের শিক্ষানীতি বিসর্জন দিয়ে সরকার বিরোধী দলকে ফ্যাসিস্ট কায়দায় মোকাবিলা করছে বললে বোধ হয় বাড়িয়ে বলা হবে না। সরকার বার বার ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে বেগম জিয়া আন্দোলন করছেন। বিজয়ের মাসে অবরোধ দিয়ে বিজয়কে খাটো করা হচ্ছে। এসব সায়সত্তাহীন বক্তব্য দিতে গিয়ে সরকার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অবরোধের আগেই বিএনপি মহাসচিব দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আপনারা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনে নিন, আমরা অবরোধ কর্মসূচি বন্ধ করে দেব।’ এর চেয়ে আর পরিষ্কার করে কী বলা যায়? বিএনপি সেক্রেটারি জেনারেলের ঘোষণা অনুযায়ী সরকার তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে এ বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করলে বিএনপি তথা ১৮ দলকে আন্দোলন কর্মসূচি দিতে হয় না। আন্দোলন সংগ্রাম করে নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের অপচয় না করে বিরোধী দল নির্বাচন বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে। কিন্তু সরকার নির্বাচনকালীন সরকার
বিষয়ে উচ্চবাচ্য না করে দোষারোপের রাজনীতি চালু রেখেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
আমি বেশক’টি লেখায় বলেছি, বেগম জিয়া অত্যন্ত দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক রাজনীতিক। তিনি মনেপ্রাণে চান দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাক। জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধন না করে মানবকল্যাণমুখী রাজনীতি করে তিনি ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে চান। আর সে কারণে শত প্ররোচনা সত্ত্বেও তিনি ধৈর্যহারা না হয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন। আমি অনেক আগেই বলেছি, খাঁটি দেশপ্রেমিক ও মানবপ্রেমিক হিসেবে বেগম জিয়া কিছুতেই ১৭৩ দিন হরতাল বা কোনো সহিংস কর্মসূচি দেবেন না। বেগম জিয়ার নরম কর্মসূচিকে সরকার বিএনপির দুর্বলতা ভাবছে। বিএনপি একটি শান্তিপ্রিয় সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল। এ দলের রয়েছে লাখো-কোটি নেতা, কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী। গত সংসদ নির্বাচনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মধ্যেও বিএনপি ৩৪ ভাগ ভোট পেয়েছে। বিএনপি কোনো হঠকারী ফেলনা রাজনৈতিক দল নয়। তাছাড়া এ দলের সঙ্গে ১৮ দল জড়িত। মহাজোটের শরিক দলগুলোর অধিকাংশের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। ১৮ দল ও মহাজোটের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন—সবার দাবি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে আগামীতে কয়েকটি নির্বাচন হোক। টকশোর ৯৯ ভাগ বক্তা এই পদ্ধতির পক্ষে মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু সরকারি দলের অগণতান্ত্রিক, একগুঁয়েমি ও একদেশদর্শী মনোভাব ও নীতির কারণে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির সুরাহা হচ্ছে না। এভাবে একা চলার নীতি গণতন্ত্রে অচল ও বর্জনীয়। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সরকারের এরূপ কাজ কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। দেশের ও আন্তর্জাতিক সমাজের সবাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সমর্থন করছে না। সবাই চাচ্ছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তির সুবাতাস বয়ে যাক। আমার মনে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাজি হলে এ সমস্যা
নিমিষেই দূর হবে। তার কথা তার দলের নেতাকর্মী কেউ বিরোধিতা করবেন না।
বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দল রাজপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করবে—গত মাসের এ ঘোষণা বেগম জিয়া ঢাকায় মহাসমাবেশ থেকে দিয়েছিলেন। ৯ তারিখে সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ঢাকার ছয়টি প্রবেশপথসহ দেশের প্রধান প্রধান সড়ক অবরোধ করে। পুলিশ অবশ্য রাজপথ অবরোধ করতে দেবে না বলে জানায়। ভোর হওয়ার আগে তারা রাজধানীর প্রবেশপথগুলো দখল করার ঘোষণা দেয়। তাছাড়া রাজধানীতে ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করার ঘোষণা আসে। তবে জনগণ প্রত্যক্ষ করে, হাজার হাজার পুলিশ, র্যাব, আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর প্রতিরোধ উপেক্ষা করে সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হলো। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথ ছিল যানবাহনশূন্য। প্রতিরোধ কর্মসূচির মারাত্মক বিষময় ফল দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল। সংঘাত, সংঘর্ষ ও মিছিল-সমাবেশ দিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পিকেটাররা অবরোধ সফল করতে মাঠে নামে। সরকারি দলের বাধা পেয়ে আন্দোলন আর অহিংস থাকেনি। মুহূর্তেই দেখা গেল সহিংস ঘটনায় বহু এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ৩ জন নিহত ও আহতের সংখ্যা অনেক। অবরোধ বিরোধী কর্মকাণ্ড কর্মসূচিটিকে অশান্ত করে তোলে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় বিরোধীদলীয় কর্মী সন্দেহে বিশ্বজিত্ দাস নামে এক দোকান কর্মীকে কিরিচ ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। সিরাজগঞ্জে এক জামায়াত কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করে। জলজ্যান্ত দু’জন মানুষকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে মারা দেখে মানুষ স্তম্ভিত ও হতবাক। এ দুটো ঘটনা ২০০৭ সালে লগি-বৈঠা দিয়ে কয়েকজন মানুষকে হত্যা করা ও হত্যার পর লাশের ওপর উঠে নাচন-কুদনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই ঘটনায় যেমন দেশের ও বিদেশের বিবেকবান মানুষ নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়েছিল, এবার তেমনি নিন্দা ও ধিক্কারের সঙ্গে তারা কিছুটা বিস্মিতও।
সরকারি দলের নেতাকর্মী হিসেবে তাদের দায়িত্ব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান, অথচ তারা বিপরীতধর্মী কাজ করে মানুষের নিন্দা কুড়াচ্ছে। গাড়ি চাপায় একজন নিহত হওয়া দেখে চিন্তাশীল মানুষের বিবেক নাড়া দিচ্ছে। মানুষের জীবনকে এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। সরকারের ক্যাডার বাহিনী মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব নিয়ে রাজপথে নামে। বাস্তবে দেখা যায় তারা মানুষ খুন করেছে ও নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে জখম করছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ায় নির্যাতন-নিপীড়নের সচিত্র প্রতিবেদন দেখে দেশ-বিদেশের মানুষ হতবাক ও বিস্মিত। কী করে একজন মানুষ আর একজন জীবন্ত মানুষকে দিনে দুপুরে কুপিয়ে ও পিটিয়ে খুন করতে পারে—বিবেকবান মানুষের কাছে বিষয়টি অকল্পনীয় ও অভাবনীয়। এরূপ নৃশংস ও হৃদয়বিদারক ঘটনা দলের নেতাকর্মীদের বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক। এতে শাসক দলের ভাবমূর্তির সঙ্গে দলের নীতিনির্ধারকদের ভাবমূর্তি সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুলিশের চোখের সামনে এসব লোমহর্ষক ও নিষ্ঠুর অমানবিক কর্মকাণ্ড ঘটে গেল অথচ ছাত্রলীগ বা যুবলীগের কেউ গ্রেফতার হলো না। কর্তাব্যক্তিরা অহরহ বলে থাকেন, ‘আইন সবার জন্য সমান’। কিন্তু ভিডিও ফুটেজ বা পেপার কাটিং দেখে ছাত্রলীগের কোনো ক্যাডারকে ধরা হয়েছে বলে জানা যায়নি। অথচ এই পুলিশ হাওয়ায় পাওয়া ও অনুমানভিত্তিক সংশয় থেকে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা-হামলা চালাচ্ছে। সন্দেহ করে অসংখ্য নেতাকর্মী ধরে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। হাজার হাজার বেনামি আসামি করে বিএনপি নেতাকর্মীদের দৌড়ের ওপর রেখে হয়রানি করা হচ্ছে। অবরোধে নামীয়-বেনামীয় ২৫০০ নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে ও বিএনপি মহাসচিবসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
অবরোধ শান্তিপূর্ণ হতে পারত যার উদাহরণ নয়াপল্টন এলাকার কর্মসূচি। সকাল থেকে নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থক জড়ো হতে থাকে। হাজার হাজার নেতাকর্মী-সমর্থক নয়াপল্টনে সমবেত হলেও সেখানে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। কারণ হিসেবে সহজে অনুমান করা যায়, পুলিশের সংখ্যা খুব কম ছিল। আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী ওই এলাকায় দেখা যায়নি। ফলে বিএনপি নেতাকর্মীরা নির্বিঘ্নে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে কর্মসূচি পালন করেছে। তবে অবরোধ, হরতাল ইত্যাদি কর্মকাণ্ডকে কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। আমাদের কথা হলো, অবরোধ-হরতালের কারণগুলো অপসারণ করা জরুরি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি মেনে নিলে বিরোধী দল হরতালের কারণ খুঁজে পাবে না। হরতালের কারণ দূর না করে দোষারোপ করে বিরোধী দলের আন্দোলন থামানো যাবে না। কারণ ১৯৯৬ সালে একই দাবিতে বর্তমান সরকারি দলের নেতৃত্বে অনেক জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ দেখেছি। দাবি না মানা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন থামেনি। ১৭৩ দিন হরতাল করে মানুষের জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করেছে।
সরকারের একা চলা নীতি বর্জনীয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ ডিসেম্বর সমাবর্তন হয়ে গেল। প্রশাসন একলা চলার নীতিতে অবিচল থেকে কাজ করেছে। শিক্ষকদের একটি অংশ প্রশাসনের দলীয়করণ, অনিয়ম, অবিচার, ’৭৩ এর অধ্যাদেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি অভিযোগ এনে সমাবর্তন বয়কটের ঘোষণা দেয়। প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে একটি দলকে নিয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর থাকে। স্বাধীনতার পর ৪০ বছরে মাত্র একবার সমাবর্তন হয়েছে। সে কারণে এবারের সমাবর্তন অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছিত। আমি কলা অনুষদের ডিন হিসেবে বিষয়টি প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের দৃষ্টিতে আনি ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানাই। কিন্তু প্রশাসন কোনোরূপ আলোচনার উদ্যোগ না নিয়ে একলা চলার নীতি অবলম্বন করে। এতে বাঞ্ছিত অনুষ্ঠানটিতে অনেক ত্রুটি ধরা পড়ে। ’৭৩-এর অধ্যাদেশের স্পিরিটকে অগ্রাহ্য করে একদলীয়ভাবে সমাবর্তন অনুষ্ঠান সমর্থনযোগ্য নয়। সবাইকে নিয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান করতে পারলে সব গ্রাজুয়েট, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার ও দেশবাসী খুশি হতো। ভিসি সাহেব সমাবর্তন বর্জনকারী শিক্ষকদের অংশকে ডেকে সমঝোতার উদ্যোগ নিলে তার মর্যাদা বাড়ত বৈ কমত না। একাডেমিক অনুষ্ঠানকে দলীয়করণ করায় অনুষ্ঠানটির মর্যাদাহানি হয়েছে। চ্যান্সেলরের বদলে শিক্ষামন্ত্রী, ডিনের বদলে ভিসি ইত্যাদি কর্মকাণ্ড অধ্যাদেশ স্পিরিটকে সংরক্ষণ করে না। এটি অধ্যাদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অনুষ্ঠানটি অব্যবস্থাপনার একটি খারাপ দৃষ্টান্ত। রেজিস্ট্রেশন করে চার-পাঁচশ’ গ্রাজুয়েট লাঞ্চের প্যাকেট না পাওয়া একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে এরূপ নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিরোধী দলের যৌক্তিক দাবি না মেনে মহাসচিবকে আটক করা হয়েছে ও তাকে রিমান্ডে নেয়ার পাঁয়তারা চলছে, যা নজিরবিহীন। ’৯৬ সালে এবারের অবরোধের দশগুণ তীব্র অবরোধ ও হরতালে বিরোধীদলীয় মহাসচিবকে কখনও আটক করা হয়নি। ময়লার গাড়িতে ঢিল ছোড়ার অপরাধে মহাসচিবকে গ্রেফতার করে সরকার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছে, যা নিন্দনীয়। অথচ কিরিচ-চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে বিশ্বজিেক খুন করা হলো, সেই চিহ্নিত পাঁচছাত্রলীগ ক্যাডারকে ধরা হচ্ছে না। কী বিচিত্র সরকার ও সরকারি নীতিনির্ধারকদের মানসিকতা! এরা কেউ ছাত্রলীগ করে না—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এরূপ নির্লজ্জ উক্তিতে দেশবাসী লজ্জা পায়। এরূপ বর্বর, নিষ্ঠুর, অমানবিক কর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেশবাসী প্রত্যাশা করে। আমরা অবিলম্বে মহাসচিবকে ছেড়ে দিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করছি। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে গ্রেফতারের হুমকি দেয়া হচ্ছে যা অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক। সরকারের অগণতান্ত্রিক ও নজিরবিহীন ঘটনা ঔপনিবেশিক আমলকে স্মরণ করিয়ে দেয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ জননন্দিত রাজনীতিকদের পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার ও নির্যাতন করেছে যা সত্য। বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে এরূপ চিন্তা করাও অনুচিত ও অনভিপ্রেত। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যেভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, তা এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ। আমরা গণতন্ত্রের স্বার্থে গণতান্ত্রিক নর্মস ও গণতান্ত্রিক চেতনা সমুন্নত রেখে কাজ করার জন্য সরকার ও বিরোধী দলকে আহ্বান জানাচ্ছি।
আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি সরাসরি প্রত্যক্ষ করে উদ্বেগ প্রকাশ করে হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচিকে নিরুত্সাহিত করে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। যে জ্বলন্ত ইস্যুর কারণে বিরোধী দল অবরোধ-হরতাল করছে, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি কনসেপ্টটির সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছে। আমি সরকার ও বিরোধী দলকে বিষয়টিতে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। সরকারের পক্ষে সংলাপ আয়োজন জরুরি হয়ে পড়েছে। বিরোধী দল সংসদে যোগ দিয়ে দাবি জানাতে পারে। সরকার না চাইলেও দেশ-বিদেশের রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব বিবেচনা করছেন। আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যদি নতুন আইন তৈরির প্রয়োজন হয় তা করা উচিত। এজন্য বিএনপিকে সংসদে যেতে হবে।’ আমরাও বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দিয়ে নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বিষয়ে আলোচনা করার আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করা যায়, সংসদে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে একটি সুন্দর সমাধান বেরিয়ে আসবে। বিষয়টি সমাধানের সঙ্গে হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি অকেজো হয়ে পড়বে।
লেখক : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যাল
য়
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন