টিআই’র ধারণাসূচকে ২৪ ধাপ অবনতি
দুর্নীতিগ্রস্ততায় বাংলাদেশের অবস্থানের ২৪ ধাপ অবনতি হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রকাশিত জরিপ অনুসারে দুর্নীতিগ্রস্তদের তালিকায় এখন বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪তম। আগের বছর বাংলাদেশের চেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের সংখ্যা ছিল ১২০। এক বছরে ২৪ ধাপ অবনতির কারণ হিসেবে টিআই বলেছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, পদ্মা সেতু, রেলওয়ে, শেয়ারবাজার, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, দখলবাণিজ্য, ক্ষমতাসীনদের সম্পদের হিসাব না দেয়া, দুদকের স্বাধীনতা খর্ব ও বিতর্কিত অবস্থান আর ফৌজদারি ও দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহার বাংলাদেশকে দুর্নীতিগ্রস্ততার এই উদ্বেগজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে। বিশ্বের ১৭৬টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৩টি দেশ রয়েছে, যাদের দুর্নীতি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। সোমালিয়া, উত্তর কোরিয়া ও আফগানিস্তান দুর্নীতিগ্রস্ততায় সবার নিচে রয়েছে। বাংলাদেশের নিচে কয়েকটি দেশের অবস্থান হলেও কম দুর্নীতিগ্রস্ততার যে নম্বর সেটি কমে গেছে, যার অর্থ হলো বাংলাদেশে দুর্নীতির গভীরতা ও বিস্তৃতি বেড়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির যে ধারণাগত জরিপ করে, তাতে শত ভাগ দুর্নীতিগ্রস্ততার চিত্র ফুটে ওঠে, এমনটা নয়। প্রতিষ্ঠানটি ধারণাগত জরিপের জন্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করে তাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তাদের জরিপে বহুজাতিক করপোরেট কোম্পানিগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের মতামতের প্রতিফলন দেখা যায় বেশি। একই সাথে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর প্রত্যাশা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশ সংস্কারকার্যক্রমে কতটুকু সম্মত হচ্ছে এবং তা কার্যকর করার পদক্ষেপ নিচ্ছে তারও প্রভাব দেখা যায় এ ধরনের জরিপে। তবে টিআইবি সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব-নিকাশের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট ধারণাকে তথ্য-উপাত্তে রূপান্তর করে যে জরিপ প্রকাশ করে, তাতে বাস্তব পরিস্থিতির প্রতিফলন অনেকখানি দেখা যায়। বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প থেকে শুরু করে গ্রামের হাটবাজার, বালুমহাল ইজারা পর্যন্ত সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা যখন বড় বড় দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন, তখন তার জ্যামিতিক প্রভাব ক্রমাগতভাবে নিচে নেমে আসে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে সেটিই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধরা পড়ে।
প্রশাসনের রাজনৈতিক ব্যবহারও দুর্নীতিগ্রস্ততার বিস্তৃৃতি বাড়িয়ে তোলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য প্রতিষ্ঠা ও দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনে আত্মত্যাগের পুরস্কার হিসেবে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ বা কোরবানির পশুহাট ইজারার কাজ তুলে দেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন নিয়োগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, পুলিশের গ্রেফতারকে বাণিজ্যে পরিণত করে তা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের আর্থিক সুবিধা লাভের জন্য উপহার দেয়া হচ্ছে। এটি দুর্নীতিকে শুধু সমাজের গভীরে প্রোথিত করে না, একই সাথে দুর্নীতির এমন একটি চক্র তৈরি করে যার প্রভাব দশকের পর দশক থেকে যায়। পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা শাসকদলের নেতাকে ঘুষ দিয়ে যে লোকটি কোনো অফিসের করণিক অথবা পুলিশের কনস্টেবলের কাজ নিচ্ছে তাকে চাকরিতে গিয়ে সে টাকা তুলে নিতে হয়। এভাবে আজকের দুর্নীতি আগামী দিনে দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করে।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের দুর্নীতি যেভাবে বিস্তৃত হতে চলছে তাতে এর রাশ টেনে ধরতে না পারলে রাষ্ট্রের কাঠামো বড় রকমের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এ জন্য এক দিকে দুর্নীতিগ্রস্ততার বিস্তার ঠেকাতে দুদকসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে। অন্য দিকে রাজনৈতিক দুর্নীতি রোধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশাসনকে রাজনৈতিক স্বার্থে বেপরোয়াভাবে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। নিয়োগবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য, গ্রেফতারবাণিজ্য যেটিই হোক না কেন, এর দায় কোনোভাবেই সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এড়াতে পারে না। দেশ ও জাতির স্বার্থে ক্ষমতাসীনদের উচিত হবে রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের আমানত ভাবা, পাঁচ বছরের জন্য বৈধ-অবৈধভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্য করা অথবা নানা সুবিধা আদায়ের জন্য ক্ষমতাচর্চার ইজারা নয়। তা না হলে ব্যর্থ রাষ্ট্রের পথে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে যে আশঙ্কা রাজনৈতিক নেতারা উচ্চারণ করছেন, সেটিই বাস্তব রূপ পাবে। এই দুঃস্বপ্ন আমরা দেখতে চাই না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন