মানুষের মাথা খারাপ হলে তাকে পাগল বলা হয়। কিন্তু পাগলের মাথা খারাপ হলে তাকে কি বলা হয়? কেউ বলবেন বদ্ধপাগল, আর কেউ বলবেন উন্মাদ। আবার কারো কারোর মতে, দু'টা নেগেটিভ যেহেতু একটা পজেটিভ তৈরি করে, সেহেতু মাথা খারাপ পাগল সুস্থ মানুষেও পরিণত হতে পারেন। কিন্তু যুক্তির ধোপে তা টিকে না। কেননা এই পজেটিভ স্বাভাবিক পজেটিভ নয়, মাইনাস পজেটিভ। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান নিয়ে আমি প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি। মাঝে মধ্যে আমার মনে হয় অনুকূল ঠাকুর পাবনার হেমায়েতপুরকে তার মানসিক হাসপাতালের জন্য নির্বাচন করে একটা ভুল করেছেন। এর জন্য উপযুক্ত স্থান হয়তো আমাদের সরকার পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ঢাকায় হলেই ভাল হতো। কারণ এই রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের যারা দায়িত্বশীল তাদের অনেকের আচরণই সাম্প্রতিককালের মস্তিষ্ক বিকৃত উন্মাদের চেয়েও খারাপ বলে মনে হয়। এতে সাধারণ মানুষ বিব্রত বোধ করেন। বুদ্ধিজীবীরা হতাশ হন এবং বিশ্ববাসীরা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমার এ কথাগুলো কেন বললাম পাঠকরা একটু তলিয়ে দেখতে পারেন।
সম্প্রতি একজন বিশ্বজিৎ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে অত্যন্ত নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। গত ৯ ডিসেম্বর আঠার দলীয় জোটের অবরোধকালে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে অবরোধকারীদের মিছিলকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ধাওয়া করছিল। তাদের হাতে ছিল লোহার রড, কিরিচ, চাপাতি এবং লাঠিসোটা। বিশ্বজিৎ ঐ সময়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক ও বাহাদুরশাহ পার্কের মাঝামাঝি স্থানে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছিলেন। ছাত্রলীগ কর্মীরা ওদিকে মিছিলকারীদের ধাওয়া দিতে আসতে থাকলে বিশ্বজিৎ প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড়াতে থাকেন। সশস্ত্র ছাত্রলীগ কর্মীরা তাকে এলোপাতাড়ি রড দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এক পর্যায়ে তাকে ধারালো চাপাতি দিয়ে ডান হাতের গোড়ায় গুরুতর যখম করা হয়। বিশ্বজিৎ একটি ডেন্টাল ক্লিনিকের দোতলায় উঠে বাঁচতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও তাকে রড, চাপাতি, কিরিচ ও লাঠি দিয়ে ঘাতকরা আঘাত করা অব্যাহত রাখে। বিশ্বজিৎ প্রাণ বাঁচানোর জন্য পাকড়াও অবস্থা থেকে ছুটে নিচে নেমে আসে। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি। নিচে নামতেই আবার চারদিক থেকে তার উপর রড ও লাঠির বাড়ি পড়তে থাকে। তার সমস্ত শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় এবং রক্তে রাস্তা লাল হয়ে যায়। এ সময় পথচারীদের কেউ কেউ বিশ্বজিৎকে পাশের ন্যাশনাল হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগ কর্মীরা তাতেও বাধা দেয়। বিশ্বজিতের উপর হামলাকালে রাষ্ট্রের সেবক প্রায় অর্ধশত পুলিশ এই নির্মম ঘটনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছে। তাকে রক্ষার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। আহত অবস্থায় তাকে পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী কোন উদ্যোগ নেয়নি। বিশ্বজিৎ পরে দৌড়ে শাঁখারী বাজারের একটি গলিতে গিয়ে ঢলে পড়ে যান। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় একজন রিকশাচালক তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান এবং কিছুক্ষণ পর সেখানে তিনি মারা যান। বিশ্বজিতের উপর যেখানে হামলা হয়েছিল সেখান থেকে ন্যাশনাল হাসপাতালের দূরত্ব সর্বোচ্চ একশ' গজ ছিল এবং এই হাসপাতালে তাকে নিতে পারলে হয়তো তিনি বেঁচে যেতেন। কিন্তু এই হাসপাতালে যাওয়া তার ভাগ্যে জোটেনি। মিটফোর্ড হাসপাতালের দূরত্ব সেখান থেকে দুই-আড়াই কিলোমিটারের কম হবে না। মৃত্যু তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। এই নির্মম ঘটনাটি ঐদিন এবং তার পরের দিন সকল ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। পত্র-পত্রিকাগুলো এই ঘাতকদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদের নাম-পদবী উল্লেখ করে এ্যাকশানরত ছবিও প্রকাশ করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী তারা সকলেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং তারা হচ্ছেন মোঃ শাকিল, তাহসীন কাদের, শাওন, নুরে আলম লিমন, মাসুদ আলম নাহিদ ও ইমদাদুল। দেশের সকল পত্র-পত্রিকা গত এক সপ্তাহ ধরে এদের পরিচয় ও নৃশংসতার উপর ধারাবাহিকভাবে রিপোর্ট ও পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টকশোতে এটি ছিল মুখ্য বিষয়। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ এই রিপোর্ট প্রকাশের সাথে সাথেই তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ঘোষণা করেন যে, এই অপরাধীরা ছাত্রলীগের কেউ নন। বরং জামায়াত-শিবির ও বিএনপিরই কর্মী। এক্ষেত্রে বোমা ফাটানোর মতো বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হঠাৎ করেই প্রেস ব্রিফিং-এ নেমে আসেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাপ-দাদা ও পারিবারিক পরিচয় দিয়ে জানান যে, এরা ছাত্রলীগের কেউ নন, প্রকৃত পক্ষে জামায়াত-শিবির ও বিএনপিরই লোক। সরকারি দলের তরফ থেকে বলা হয় যে, এ হত্যাকান্ডের দায়-দায়িত্ব সরকার ও আওয়ামী লীগ নেবে না। কিন্তু দেশবাসী ও গণমাধ্যম তা বিশ্বাস করেনি। তারা অব্যাহতভাবে বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের গ্রেফতার এবং তাদের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরে শাস্তির দাবি জানাতে থাকে। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আচরণেও অনেক নাটকীয়তা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত এদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন, গ্রেফতারকারীদের সংখ্যা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের বক্তব্যে এখনো প্রচুর গরমিল পরিলক্ষিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ হত্যায় কেউ ছাত্রলীগের কর্মী নয় এই মর্মে প্রধানমন্ত্রীর যে বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন সে সম্পর্কে দৈনিক যুগান্তর পাঠকদের মতামত চেয়ে একটি জরিপ চালিয়েছিল। তারা বিজয় দিবসে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছেন। এই ফলাফল অনুযায়ী জরিপে অংশগ্রহণকারী পাঠকদের ১.৯০ শতাংশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছেন এবং ৯৬.৭০ শতাংশ বলেছেন যে, তারা এই মতের সাথে একমত নন। বিশ্বজিৎ ইস্যুটি দেশ-বিদেশে সরকারের অবস্থানকে নাড়া দিয়েছে। বিশ্বজিতের পরিবার এবং তার হত্যাকান্ডের বিচারপ্রার্থীরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গ্রেফতার ও রিমান্ড দাবি করেছেন। বিশ্বজিতের ধরা পড়া অপরাধী কেউ কেউ হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে বলেছেন যে, তারা জামায়াত-শিবির কর্মী মনে করেই তাকে রডের বাড়ি, কিল-ঘুষি ও চাপাতির কোপ দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন যে, জামায়াত-শিবিরের বিষয়টি আনায় হয়তো তারা বেঁচেও যেতে পারে। কেননা জামায়াত-শিবির বর্তমান সরকার এবং তাদের দৃষ্টিতে দেশের একমাত্র শত্রু। তাদের নির্মূল ও হত্যা করতে পারলে দেশ সকল সমস্যামুক্ত হয়ে যাবে। শেয়ারবাজার উঠে দাঁড়াবে, দ্রব্যমূল্য কমে যাবে, লোডশেডিং কমে যাবে, বাড়ি ভাড়া কমবে, হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপে টু ইউ প্রভৃতি সংস্থার প্রতারণা দুর্নীতি আর থাকবে না। পদ্মাসেতুর দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য, উড়াল সেতুর গার্ডার ধস, বস্তি ও গার্মেন্টস-এ অগ্নিকান্ড, সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা, সড়ক দুর্ঘটনা, অফিস-আদালতের ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলও বন্ধ হয়ে যাবে।
বস্তুত বিশ্বজিৎ মরলেও এখন জীবিত হয়ে উঠেছেন। এখন তিনি বিশ্বকে জয় করেছেন। তার ঘাতকদের একজন শাকিলের পিতা টেলিভিশন চ্যানেলে পুত্রের কুকীর্তি দেখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরে তার গ্রেফতারের কথা শুনে মারা গেছেন। ঘাতকদের পরিবারগুলোর সকলেই স্বীকার করেছেন যে, তারা ছাত্রলীগের কর্মী। এখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর আগাম সাফাই কোন কাজে আসেনি। দেশবাসীর এখন প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর এখন কি করবেন? তারা কি তাদের বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন না পূর্ববর্তী অবস্থানে অটল থাকবেন? ড. মহিউদ্দিন খানের অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে যশোরে জেলা প্রশাসক থাকাকালে স্বেচ্ছাশ্রমে উলসী যদুনাথপুরে একটি খাল কেটে ব্যাপক প্রপাগান্ডার জোরে জেনারেল জিয়ার নৈকট্য পেয়ে স্নেহভাজনে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তার স্বনির্ভর দর্শনেই জনগণকে উজ্জীবিত করে এই খাল তিনি খনন করিয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ স্ব-প্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে এই কাজটি করেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়া তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বৃত্তি দিয়ে তাকে বিদেশে পাঠান এবং তার পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনে সহায়তা করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর গবেষক ও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. গোলাম সাত্তারের একটি মূল্যায়ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মহিউদ্দিন খান আলমগীর স্বেচ্ছাশ্রমের নামে জেনারেল জিয়া এবং দেশবাসীর সাথে প্রতারণা করেছেন। উলসী যদুনাথপুরে খাল কাটায় তিনি ব্যাপক চাঁদাবাজির আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং ব্যবসায়ী, দোকানদার, পরিবহন মালিক, ঠিকাদার প্রমুখের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে তিনি খাল কাটার কাজে ব্যয় করেন। সেখানে স্বেচ্ছাশ্রমের যে অংশটুকু ছিল সেটা ছিল প্রকৃতপক্ষে সরকারি কর্মচারীদের শখ করে কোদাল দিয়ে মাটি কাটার অংশ। তার এই প্রতারণা এক সময় সরকারি মহলে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিলো। তার সুযোগসন্ধানী চরিত্রের আরেকটি অংশ ধরা পড়েছিল ১৯৯৬ সালে যখন তিনি আমলাতন্ত্রের শতাব্দী পুরাতন ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ অবলম্বন করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নৈতিক শৃক্মখলাকে ধ্বংস করেছিলেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের খাদেম। রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় আসেন এবং জনগণ নির্বাচিত না করলে ক্ষমতা থেকে সরে যান। সরকারি কর্মচারীরাই হচ্ছেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা রাজনীতি করতে পারেন না। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে তাদের আর নিরপেক্ষতা থাকে না এবং নিরপেক্ষতা না থাকলে মানুষ তাদের কাছ থেকে বস্তুনিষ্ঠ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। মখা আলমগীর এই ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে আমলাতন্ত্রে দলতন্ত্রের সূচনা করেন এবং বাংলাদেশের শুধু প্রশাসন নয় আইন-শৃক্মখলা বাহিনী, বিচার বিভাগসহ সর্বত্র অযোগ্য দলতন্ত্রের বিষবা ছড়িয়ে দেন। এই বিষবা থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি এবং আমাদের সমাজ-দেহের প্রতিটি অঙ্গ এই বিষক্রিয়ার প্রভাবে এখন দুষ্ট। মখা আলমগীরের আরেকটি অবদান আছে এবং এই অবদানটি অনেকে বলে থাকেন প্রধানমন্ত্রীকেই সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় শাসনামলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১১টি ডক্টরেট ডিগ্রি ও অন্যান্য সম্মানসূচক উপাধি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তার আয়ের উৎস নিয়েও বহু গল্প রয়েছে। কেয়ারটেকার সরকার আমলে তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির জন্য তিনি সপরিবারে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। রিমান্ডে তার ওপর অনেক নির্যাতনও হয়েছিল বলে শোনা যায়। যদিও এখন ঐ ধরনের নির্যাতন তিনি তার প্রতিপক্ষের ওপরে চালাচ্ছেন। অবশ্য পদ্ধতিগত কারণে কেয়ারটেকার আমলে প্রদত্ত তার দুর্নীতির সাজা বাতিল হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এটা বলা যাবে না যে, তিনি দুর্নীতি করেননি, মামলায় পদ্ধতিগত ত্রুটি না থাকলে তিনি অবশ্যই সাজা পেতেন বলে মানুষ মনে করে। তিনি এই সরকারের আমলে একটি ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি নিয়েছেন এবং পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী মন্ত্রী হবার পর এখনো অবৈধভাবে ঐ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে আসীন আছেন। একজন সরকারি কর্মচারী বিদ্রোহ করে রাজনৈতিক নেতায় রূপান্তরিত হয়ে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ব্যাংক করতে গেলে চারশ' কোটি টাকা প্রয়োজন হয়। তার এই অর্থের উৎস কোথায়? জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে প্রথমত জামায়াত-শিবির এবং পরে তার সাথে বিএনপির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি অবরোধকালে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা-কর্মীদের মাঠে-ময়দানে বিএনপি, জামায়াতকে প্রতিহত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। ছাত্রলীগ কর্মীরা তার এই নির্দেশই পালন করেছে। তারা বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে ঢাকায়। সিরাজগঞ্জের জামায়াত কর্মী ওয়ারেস আলীকে তারা একইভাবে একই দিন পিটিয়ে হত্যা করেছে। ওয়ারেস আলী যেহেতু জামায়াত কর্মী এবং মুসলমান, মানুষের পর্যায়ে পড়েন না সেহেতু ঐ খবরটি পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিদিন শিরোনাম হয়ে আসেনি। এটাকে দেশবাসী কিভাবে দেখবে আমি জানি না। হত্যা, হত্যাই। এটা রাজনৈতিক হত্যা, রাজনৈতিক হত্যা হত্যাই ডেকে আনে। শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন, ক্ষমতাসীন দলের বহু শীর্ষ নেতাই তাদের কর্মীদের বলেছেন তোমাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে তোমরা জামায়াত-শিবির, বিএনপি প্রতিহত কর। নিজের দলকে দিয়ে অন্য দলকে প্রতিহত করার নির্দেশ হিটলারই দিয়েছিলেন, এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লগি-বৈঠা নিয়ে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে প্রতিদ্বনদ্বী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তারা প্রায় ডজন খানেক মানুষকে হত্যা করেছিল এবং প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে নিহত এক ব্যক্তির লাশের ওপর নেচে নেচে উল্লাস প্রকাশ করেছিল। তার বিচার হয়নি। এবং এই সরকারই তা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার দল যে করে না, যে তার বিরোধিতা করে তাকে প্রতিহত করা ও প্রাণে মারা সুস্পষ্টভাবে ফ্যাসিবাদ। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশে এই ফ্যাসিবাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অন্যায়। ২৮ অক্টোবরের বিচার হয়নি। এতে ফ্যাসিবাদ উৎসাহিত হয়েছে। তার আগেও ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো ভিন্নমত দলনের নামে হাজার হাজার হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তারও বিচার হয়নি। পুলিশ রিমান্ড, ক্রসফায়ার, গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড এখনো ঘটছে। এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ, অতীত নয় ঘটমান বর্তমান। এগুলোর বিচার কি হবে? গণমাধ্যম এবং সিভিল সোসাইটি কি এগুলোর বিচার দাবি করবে? নাকি আওয়ামী লীগ বলে ছেড়ে দেবে?
আমি আগেই বলেছি বিশ্বজিৎ বিশ্বজয় করেছেন। তার হত্যাকারীদের অনেকেই ধরা পড়েছেন। পুলিশ ও আইন-শৃক্মখলা বাহিনী মিডিয়াকে সন্তুষ্ট করার জন্যে নাকি প্রকৃত অর্থে বিচারের জন্যে তাদের গ্রেফতার করেছে আমি জানি না। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতারা যে এতে খুশি হয়েছেন তা সম্ভবত বলা যাবে না। কেননা তাদের অবস্থান তারা আগেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তারাতো বিশ্বাসই করছেন যে এটা ছাত্রলীগের কাজ নয় এবং তাদের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্যে সংশ্লিষ্টদের পরিবারের ইতিহাসও তারা টেনে এনেছেন। যদিও এদেশের মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল একটি ধারণা আছে যে, পরিবারের নষ্ট ছেলেরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ করে এবং ছাত্রলীগ তাদের কর্মকান্ডের দ্বারা ইতোমধ্যে তা প্রমাণও করে দিয়েছে।
এখন বিচারের প্রশ্নে ফিরে আসি। বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা ধরা পড়ার অর্থ এই নয় যে, তাদের বিচার হবে। কেননা ইতোপূর্বে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের বিচারাধীন অপরাধীদের বিচার হতে বা শাস্তি পেতে আমরা খুব কমই দেখেছি। এমনও দেখা গেছে যে, বিচার প্রক্রিয়ায় খুনের দায়ে ফাঁসির দন্ডাদেশ প্রাপ্ত হয়েও তারা মুক্তি পেয়ে গেছেন। আমি মনে করি শুধু একজন বিশ্বজিৎই নয়, ছাত্রলীগ, যুবলীগের দ্বারা নিহত সকল ব্যক্তির পরিবারেরই ন্যায়বিচার পাবার অধিকার রয়েছে। বিশ্বজিৎ একটা ইস্যু। এই ইস্যু এখন ইথারে ভেসে বেড়াচ্ছে। এর বিচার পেতে হলে সরকার এবং পুলিশের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ইনসাফ পাবার আশা করা যাবে না। এ জন্যে সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী ও ক্ষতিগ্রস্ত সকল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নাগরিক কমিটি গঠন করা দরকার। এই কমিটি চার্জশিট থেকে শুরু করে বিচারের সকল প্রক্রিয়া মনিটর করবে, পাহারা দিবে। তদন্ত কাজ সঠিক পথে এগুচ্ছে কিনা তা দেখবে এবং শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীকে তা অবহিত করবে। এই নাগরিক কমিটি যদি পাহারা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে আওয়ামী লীগের হত্যাকান্ডের বিচার হবে না এবং এই হত্যাকান্ড ভবিষ্যতে আরো হত্যাকান্ডের জন্ম দেবে। এই হত্যাকান্ড আমরা আর দেখতে চাই না। এর নির্দেশ দাতাদেরও বিচার হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন