শুক্রবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১২

যোগ্যতা প্রমাণের জন্য মানুষ খুন



বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের অন্যতম আসামী ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম শাকিল, জিএম রাশেদুজ্জামান শাওন এবং মাহফুজুর রহমান নাহিদ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানা গেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত  খবরানুযায়ী এদের তিনজনই স্বীকার করেছেন যে, এই হত্যাকান্ডে শুধু তারা নয়, আরো কমপক্ষে ১৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী অংশগ্রহণ করেছে। জবানবন্দি অনুযায়ী ছাত্রলীগ কমিটিতে ভাল পদ পেতে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য বেপরোয়া হয়েই তারা বিশ্বজিৎকে খুন করেছেন। বিশ্বজিতের খুনের পরও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ক্ষমতাধর নেতাদের সাথে তাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল এবং ঐ নেতারা তাদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছিল এবং তাদের সহায়তায়ই তারা ভারত যাবার চেষ্টা করছিল। গত ২৪ ডিসেম্বর আদালতে দেয়া ছাত্রলীগ নেতাদের  স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিসমূহ দেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এর আগেও একই অপরাধে গ্রেফতারকৃত আরো ৬ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী প্রায় একই ধরনের জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের জবানবন্দি প্রকাশিত হবার পর পুলিশ অথবা ছাত্রলীগ কারোর পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে কোনোও মন্তব্য করা হয়নি এবং তাদের এই নীরবতা থেকে সহজেই ধরে নেয়া যায় যে, অভিযুক্তদের বক্তব্য সঠিক এবং তারা দলীয় নির্দেশ এবং ছাত্রলীগ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবার যোগ্যতা প্রমাণের জন্যই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। তাদের এই জবানবন্দি সারা জাতিকে স্তম্ভিত করেছে বলে আমরা মনে করি। ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্র সংগঠনের সম্পৃক্ততার পেছনে যে উদ্দেশ্য আমরা এতদিন জেনে আসছিলাম তা হচ্ছে ছাত্ররা লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতি শিখবে, নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন ও অনুশীলন করবে এবং শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষাসামগ্রীর উন্নয়নে সহায়তা করবে। এছাড়াও তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ও আবাসিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহের সমাধানেও সচেষ্ট হবে, সরকার ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় রক্ষা করবে এবং এভাবে তাদের সাংগঠনিক যোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় দুনিয়ার বহু দেশে ছাত্র সংগঠন পরিচালিত হবার দৃষ্টান্ত রয়েছে; কিন্তু কোথাও এই সংগঠনের নেতা হবার জন্য অথবা তার কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য সাধারণ মানুষ কিংবা প্রতিদ্বনদ্বী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের খুন করতে হবে, এই ধরনের শর্ত পূরণের নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এ ব্যাপারে যে নজির স্থাপন করেছে তা জাতির  জন্য যেমন লজ্জার কারণ বয়ে এনেছে তেমনি দুশ্চিন্তারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে আমাদের ধারণা। সম্ভবত  মানবেতিহাসের এমন কোনো অপকর্ম নেই বর্তমানে ছাত্রলীগ যা করছে না। তারা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, রাহাজানি, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ভর্তি ও সীট বাণিজ্য, ছিনতাই, জবরদখল, শিক্ষক-শিক্ষিকা নির্যাতন সবকিছুতেই রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকার সামগ্রিকভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বজিৎ হত্যার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, পত্র-পত্রিকায় তাদের এ্যাকশনরত ছবি প্রকাশিত হবার পর পরই বিরোধী দলের কোনোও বক্তব্য প্রকাশের আগেই স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাফাই বক্তব্য দিয়ে ঘোষণা করেছেন যে, তাদের সাথে ছাত্রলীগের সম্পর্ক নেই। অথচ ঐ সময়ে ছাত্রলীগও এই দাবি করেনি। আবার অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও অভিযুক্তদের পারিবারিক পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে যে, তারা বিরোধী বিএনপি-জামায়াতের লোক। অথচ গণমাধ্যমের চাপে তারা গ্রেফতার হবার পর পুলিশ হেফাজতে নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে, তারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং ‘বড় ভাইদের নির্দেশেই' হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন। এই জবানবন্দির পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আর কোনোও মর্যাদা থাকে বলে আমরা মনে করি না। জাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাদের এখন জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া  অথবা পদত্যাগ করা উচিত। আজকে যারা ছাত্র কালকে তারা দেশ পরিচালনা করবেন। আওয়ামী লীগ একটি বড় সংগঠন। তাদের নেতৃত্ব আসে ছাত্রলীগ থেকে। ছাত্রলীগ নেতৃত্বে যদি এই অবস্থা হয়, নেতা হবার মানদন্ড খুন রাহাজানি হয় তাহলে এই দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার না হয়ে পারে না। এই অবস্থায় এই দলটি সম্পর্কে দেশবাসীর যেমন সতর্ক হওয়া প্রয়োজন তেমনি এই দলটির নেতৃত্বে যেসব বিবেকবান লোক রয়েছেন তাদেরও উচিত তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করা। অন্যথায় দেশ-জাতি এবং পার্টি সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমাদের ধারণা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads