বুধবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১২

যে গণতন্ত্রে জনগণ নেই...



একটি হলো দলীয় ভাবনা, অপরটি জাতীয় ভাবনা। জাতীয় ভাবনার অনুকূলে দলীয় ভাবনা নিরূপিত হলে দলীয় ভাবনাও জাতির কাছে হয়ে উঠতে পারে প্রিয় ভাবনা। এমন ভাবনা গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করার কারণে তা গণতান্ত্রিক ভাবনা হিসেবেও পরিগণিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের রাজনীতি যেন জাতীয় ভাবনার অনুকূলে যেতে চাইছে না, বরং নানা ছলাকলা, দমন-পীড়ন ও কলাকৌশলের মাধ্যমে পুরো জাতিকে সংকীর্ণ দলীয় ভাবনা ও দলীয় স্বার্থের অনুগামী হতে বাধ্য করতে চায়। ব্যাপারটি আরো মারাত্মক হয়ে ওঠে তখন, যখন দেখা যায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরাও শপথের কথা ভুলে গিয়ে দলীয় উন্মাদনায় নেতা-কর্মীদের বিপদজনক পথে অগ্রসর হওয়ার আহবান জানান। সম্প্রতি এমন অনাকাঙ্ক্ষিত উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। এ কারণে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা বলেছেন, অবরোধের দিনে পুরনো ঢাকায় ছাত্রলীগ ক্যাডারদের চাপাতির কোপে নিহত বিশ্বজিতের ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর দায়ী বলে মনে করে বিএনপি। ভবিষ্যতে তাকে প্রধান আসামী করে হত্যা মামলা করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত সাদেক হোসেন খোকা বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পরই জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করতে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে রাজপথে নামতে বলেছিলেন। তাদের ধরে পুলিশে দিতে বলেছিলেন। তখনই সশস্ত্র ছাত্রলীগ-যুবলীগ রাজপথে নামে। তখন আমরা বলেছিলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগুন নিয়ে খেলছেন। বিশ্বজিৎসহ কয়েকটি তাজা প্রাণ কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহবান বাস্তবায়ন করেছেন সরকারি দলের ক্যাডাররা। ভাবতে অবাক লাগে, একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেমন করে দলীয় নেতা-কর্মীদের আইন হাতে তুলে নেয়ার আহবান জানান! ফলে এখন বিরোধদলীয় এক নেতা বলছেন, ‘বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন প্রধান আসামী।' রাজনৈতিক অঙ্গনের এমন চিত্র কখনো দেশের জনগণকে আশাবাদী করতে পারে না। কিন্তু অহরহ বক্তৃতা-বিবৃতিতে ব্যস্ত আমাদের রাজনীতিবিদরা বিষয়টি উপলব্ধি করেন বলে তো মনে হয় না।
গত রোববার নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্যে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো তা বর্ণনার ভাষা আমাদের অভিধানে নেই। তবে হত্যার যে নির্মম দৃশ্য প্রত্যক্ষদর্শীরা অবলোকন করেছেন এবং টিভি-পর্দায় যে দৃশ্য ফুটে উঠেছে তাতে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কোনো মানুষ এমন নৃশংস কাজ করতে পারে! কিন্তু টিভির পর্দায় এবং পত্রিকার পাতায় লক্ষ্য করা গেছে, কিছু মানুষই হত্যা করেছে পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে। তবে এরা শুধু মানুষ নয়, শিক্ষার আলোকিত ভুবনের সদস্যও! এবং তারা সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীও বটে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই। মূল হামলাকারী ৫ জনের পরিচয়ও নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছেন শাকিল। বাকিরা রড আর লাঠি দিয়ে পিটিয়েছেন বিশ্বজিৎকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বজিতের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগের ঐ নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে ছিনতাই, মাদক সেবন, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানায় মামলা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনও সাময়িক বহিষ্কার করেছিল দু'জনকে। ছাত্র নামধারী এসব দুর্বৃত্তরা জজ কোর্ট এলাকার সামনে যখন বিশ্বজিৎকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল, তখন ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ১০-১৫ গজ দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিলেন লালবাগ অঞ্চলের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন-উর-রশীদসহ অন্তত ৩০ জন পুলিশ সদস্য। হামলাকারীদের প্রতিহত করতে কিংবা বিশ্বজিৎকে রক্ষায় এগিয়ে আসেননি তাদের কেউই। এই হলো আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারের সেবক পুলিশ সদস্যদের আচরণ। এ কারণেই পর্যবেক্ষণ মহল মনে করছেন, দলীয় ক্যাডারদের পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দিয়ে কখনো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান সম্ভব নয়।
বিশ্বজিৎ দাসের খুনিরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোতোয়ালী-সূত্রাপুর এলাকার পরিচিত মুখ। পুলিশও তাদের চেনেন। অথচ পুলিশের করা হত্যা মামলায় আসামী করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের। অভিযোগ উঠেছে, খুনিরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী হওয়ায় তাদের নাম এজহারভুক্ত করা হয়নি। এদিকে বিশ্বজিতের পরিবারও অভিযোগ করেছে, ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নাম ও ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পুলিশ। এমন অবস্থায় বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা বলছেন, পুলিশই পরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। ফলে বিশ্বজিতের পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
জনগণ দিন বদলের প্রত্যাশায় ভোট দিয়েছিল বর্তমান সরকারকে। কিন্তু এ কেমন দিন বদল? প্রকাশ্যে একজন নিরীহ পথচারীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে হত্যা করা হবে আর পুলিশ তা চেয়ে চেয়ে দেখবে- এরই নাম কি দিন বদল? এসব উদাহরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়, বর্তমান সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের প্রশ্রয় প্রদানে সক্ষম হলেও দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়নি। সরকারের এমন আচরণে আবারও প্রমাণিত হলো যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে পরমত-সহিষ্ণুতা, আদর্শ-নিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা প্রয়োজন তা থেকে আমাদের রাজনীতি অঙ্গন এখনও অনেক দূরে। এমন অবস্থায় দেশের জনগণ আশাবাদী হবে কেমন করে? অথচ আমাদের সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সব সময় জনগণকে আশাবাদী হওয়ার আহবান জানান। কিন্তু জনগণ যে আশাবাদী হবে তার অনুকূলে তারা কতটা কাজ করছেন? এমন আত্মসমালোচনা তাদের মধ্যে থাকলে বিশ্বজিৎরা প্রকাশ্য রাজপথে পুলিশের সামনে এভাবে নিহত হতো না। আর পুলিশও হত্যাকারীদের মামলায় আসামী করতে কুণ্ঠিত হতো না। এমন অবস্থা কখনো একটি স্বাধীন জাতির কাম্য হতে পারে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী যদি অসঙ্গত কথাবার্তা বলেন, তাহলে তার পরিণতি যে ভাল হয় না তা এখন নানা ঘটনায় উপলব্ধি করা যাচ্ছে। রাজধানীর মগবাজারে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা একটি হাসপাতালেও ভাংচুর চালিয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর দুপুরে ইনসাফ বারাকাহ কিডনী ও জেনারেল হাসপাতালে এ ভাংচুর চালানো হয়। পুলিশের উস্কানিতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা এ হামলা চালায় বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এ সময় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা হাসপাতালে হামলা চালানোর সময় পুলিশের একটি গাড়ি তাদের পিছনে ছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের কোনো বাধা দেয়নি। বরং পুলিশের লাঠি ছাত্র লীগ ও যুবলীগের কর্মীরা হামলায় ব্যবহার করেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো হাসপাতালের মত একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা যে সন্ত্রাসী হামলা চালায় তাতে উস্কানি দিয়েছে আইন-শৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা হয়তো মনে করেছে, আওয়ামী ঘরানার বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করলে তাতে জাতির কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু বিকৃত ও বেআইনী এমন তৎপরতাকে পুলিশ প্রশ্রয় দেয় কেমন করে? তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অসঙ্গত বক্তব্যের আছর কি পুলিশের মধ্যেও পড়তে শুরু করেছে? পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, সরকারের দলবাজি দৃষ্টিভঙ্গি এবং দলীয় ক্যাডারদের পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ এই বাহিনীটির ইমেজ ক্ষুণ্ণ করে চলেছে- যা লক্ষ্য করা গেছে বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায়ও। বিশ্বজিৎকে যখন নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছিল তখন ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ১০-১৫ গজ দূর থেকে এ দৃশ্য দেখছিলেন লালবাগ অঞ্চলের উপ-কমিশনার হারুন-উর-রশিদসহ ৩০ পুলিশ সদস্য। তারা হয়তো ভেবেছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হয়তো বিরোধী দলের কোন কর্মীকে ক্ষত-বিক্ষত করছে। তাই তারা পালন করেন নীরব দর্শকের ভূমিকা। কিন্তু বিরোধী দলের নেতাকর্মীও যে দেশের নাগরিক এবং তাদের জানমাল রক্ষার দায়িত্বও যে পুলিশের ওপর বর্তায় তেমন উপলব্ধি থেকে তারা ছিলেন বহুদূরে। পুলিশের এমন আচরণে বিশ্বের যে কোন দেশের নাগরিক স্তম্ভিত হবেন। কিন্তু আমরা এখন এসব ঘটনায় তেমন অবাক হই না। কারণ হারুন-উর-রশিদের মত পুলিশ কর্মকর্তারা আগেও ছিলেন দলীয় ক্যাডার এবং এখনও পালন করছেন দলীয় ক্যাডারের ভূমিকাই। বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের সাথে সংসদ ভবন এলাকায় ঐ পুলিশ কর্মকর্তা যে ন্যক্কারজনক আচরণ করেছিলেন তার কোন বিচার হয়নি। বরং তাকে প্রমোশন দিয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। ফলে এ ধরনের পুলিশ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে যা হবার তাই হচ্ছে। দলীয় মানসিকতার এসব পুলিশ কর্মকর্তা দ্বারা ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন' সম্ভব নয় বলেই প্রাণ হারাতে হলো বিশ্বজিৎকে। লেখার শুরুতেই আমরা বলেছিলাম দলীয় ভাবনা ও জাতীয় ভাবনার কথা। দলীয় ভাবনা জাতীয় ভাবনার অনুকূলে না গেলে ঐ দল জাতির কল্যাণ করার মত সামর্থ্য হারায়। আমাদের রাজনীতিবিদরা, বিশেষ করে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এই সত্যটি কি জাতির এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায়ও উপলব্ধি করবেন না?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads