শুক্রবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১২

তুরস্কে-বাংলাদেশে সম্পর্কে টানাপড়েন : বন্ধুহীন হওয়া সফল কূটনীতি নয়



বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্কে যে টানাপড়েন শুরু হয়েছে তা অনায়াসে এড়ানো যেত বলে আমরা মনে করি। ঢাকায় নিযুক্ত তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে ২৬ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠিয়ে মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুসারে একটি কড়া কূটনৈতিকপত্র দেয়ার পর বাংলাদেশ আশা করেছে, বিষয়টির এখানেই ইতি ঘটবে। কিন্তু ইতি যে ঘটেনি তার প্রমাণ হচ্ছে, পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বৃহস্পতিবার আঙ্কারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। যতদূর জানা গেছে, তাতে মনে হয় সেখানে তিনি খুব একটা মধুর আপ্যায়ন পাননি।
জটিলতার সূত্রপাত এ মাসেই। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের কাছে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, যাদের বিচার করা হচ্ছে তারা এতই বয়স্ক যে তাদের এ ধরনের বিচারের মুখোমুখি না করাই ভালো। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট চিঠিতে আরও লিখেছিলেন, এ বিচারের কারণে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়ে এমনকি গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সহযোগী দৈনিকের এক খবরে জানা গেছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট অনুরূপ চিঠি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও পাঠিয়েছেন। এই চিঠি নিয়ে সরকারি মহলে যখন তোলপাড় চলছে, সে সময় তুরস্কের একটি এনজিও’র ব্যানারে ১৪ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা সফর করে। সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবীদের নিয়ে গঠিত প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ঢাকায় অবস্থানকালে আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি, আসামী পক্ষের আইনজীবী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছেন। 
প্রতিনিধি দলটি যে যুদ্ধাপরাধবিষয়ক চলমান বিচার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতেই বাংলাদেশে এসেছিল তা তাদের কার্যকলাপ থেকে স্পষ্ট। এই প্রতিনিধি দলটি চলে যাওয়ার পর সরকারের মনে হয়েছে তাদের আগমনের উদ্দেশ্য এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠির লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা এবং যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিচার বিঘ্নিত করা। সরকারের এ ধরনের চিন্তার ফলে দুই বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রদূতকে তলব এবং পাল্টা তলবের ঘটনা ঘটেছে, যা সম্পর্কের টানাপড়েন বলে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ এবং তুরস্কের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে এ ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে সবার একমত হওয়ার কথা। তুরস্কে ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দারেসকে পদচ্যুত করে ফাঁসি দেয়া হয়। এর ফলে তুর্কি জাতির মধ্যে যে তিক্ত মানসিক বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছিল তার জের কাটিয়ে উঠতে তাদের অনেক বছর লেগেছিল। সে কারণে কোনো বন্ধু রাষ্ট্র যেন অনুরূপ ভুল না করে তার জন্য তুরস্কের জাতীয় নেতাদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ দেখা যায়। ১৯৭৭ সালে যখন গোটা বিশ্ব নিশ্চিত হয় যে, জিয়াউল হকের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক সরকার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলাবেই, তখনও তুরস্ক এ ভুল না করার জন্য পাকিস্তানকে সরকারিভাবে অনুরোধ করেছিল। এ ধরনের পরামর্শদান বা উদ্বেগ প্রকাশকে কূটনৈতিক ভব্যতার সঙ্গে মোকাবেলা না করে হুঙ্কারের পর হুঙ্কার ছাড়া হলে বন্ধুত্বের অদৃশ্য সুতাটি ছিঁড়ে যায়। তখন কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ ছাড়াই বন্ধুহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকট হয়ে ওঠে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads