মঙ্গলবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১২

অন্ধরাই এখন দেখছে বেশি


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
 বাংলাদেশে এক অদ্ভূত অাঁধার এসেছে। এখানকার শাসকশ্রেণী ক্রমেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছে এবং তাদের মনে হচ্ছে যে, পৃথিবীর আর কেউ কোনো কিছুই চোখে দেখছে না। অন্ধ শাসকরাই সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। রবিবারের অবরোধ, তার আগে হরতাল, বিরোধীদলের সেসব কর্মসূচি আমরা দেখেছি। এ কথা সত্য যে, সরকারের পুলিশ বাহিনীর সীমিত শক্তি। ফলে যতদূর মনে হয়, সরকার ছাত্রলীগ, যুবলীগের খুনীদের খুনের ওপেন জেনারেল লাইসেন্স (ওজিএল) দিয়ে দিয়েছেন এবং ধারাবাহিক বিস্ময়কর ঘটনা এই যে, সরকারদলীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ক্যাডাররা গুলী চালিয়ে কিংবা কিরিচ চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মানুষ হত্যা করছে। কিন্তু সরকার এমন এক নীতি গ্রহণ করেছে যে, সরকারদলীয় লোকদের হত্যাকান্ডে তারা চোখ বন্ধ করে থাকছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
আমরা তো অবিরাম বলে গেছি যে, নিবৃত্ত হোন। এই স্বেচ্ছা-অন্ধত্ব আপনাদের জন্য বিরাট বিপদ ডেকে আনবে। পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম এটাই। পৃথিবী কখনোই আমাদের আকাঙ্ক্ষার মতো সুন্দর নয়। আমরা অবিরাম পৃথিবীকে আমাদের আকাঙ্ক্ষার মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। সম্ভবত সেজন্যই পৃথিবীতে এত উন্নতি সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এর সবকিছুই ইতিবাচক অর্থে। আমরা যদি এর নেতিবাচক দিকটা দেখি, তাহলে দেখবো, বাংলাদেশে এখন ‘অদ্ভূত অাঁধার এক আসিয়াছে'। বর্তমানে  ক্ষমতাসীন সরকার সমাজকে নিজেদের অনুকূলে রাখার জন্য তাদের পেটোয়া সন্ত্রাসী বাহিনীকে খুনের লাইসেন্স পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। তারা প্রকাশ্যে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে খুন করে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার এই খুনীদের ধারাবাহিকভাবে কেবল প্রশ্রয়ই দিচ্ছে। এই সরকার বড় বেশি খুনীবান্ধব। সেভাবে কি রাষ্ট্র চলে?
শুধু খুনীবান্ধব বললে বিষয়টা খানিকটা অসম্পূর্ণ থাকবে। আসলে এই সরকার ভয়াবহ দুর্নীতিবান্ধব। ফলে তাদের অবস্থান যে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, সেটি তারা দেখতেও পায় না। শুনতেও চায় না। সেটি জনগণের জন্য যেমন সংকটের কারণ হয়েছে, তেমনি সংকটের কারণ হয়েছে সরকারের নিজের জন্যও। সরকার শুধু নিজের কথা ভাবছে। কিন্তু নির্বাচিত হবার পর যেকোনো সরকারদলীয় কোটারিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকার তেমনি ভয়াবহভাবে আবদ্ধ। এই সরকারের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বিশাল দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লো। কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য কানাডীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কাছ থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার নিয়ে নিলেন। এসএনসি-লাভালিনের অ্যাকাউন্ট থেকে এই ৩৫ মিলিয়ন ডলার ভিন্ন খাতে চলে গেলো কানাডায়। সেখান থেকে আবার আট মিলিয়ন ডলার গেলো যুক্তরাষ্ট্রে। এই দুর্নীতির কারণে এসএনসি-লাভালিনের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেন। কিছুকাল তিনি অবশ্য আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু কানাডার আইন অনুযায়ী তিনি এখন কারাগারে।
তিনি ঘুষ দিয়েছেন, সেটাই বিরাট অপরাধ। বাংলাদেশের সরকার এসব বিষয়ে দুই পয়সার ভ্রূক্ষেপ করতেও প্রস্তুত নয়। আবুল হোসেনকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা সেটি বিস্ময়ের উদ্রেক করতে বাধ্য। একেবারে প্রথম থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল হোসেনের পক্ষাবলম্বন করে এমন সব কথা বলেছেন, যা সত্যি সত্যি এদেশের মানুষকে বিস্মিত করেছে। বিশ্বব্যাংক কানাডীয় তদন্ত কমিটির উদ্ধৃতি দিয়ে সরকারকে বলল যে, আবুল হোসেন, মশিউরসহ পদ্মা সেতু ডিলে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বিশ্বব্যাংককে একহাত নিয়ে নিলেন। তারপর আবুল হোসেনের দুর্নীতির তদন্ত তো দূরের কথা, তাকে মহান দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেট পর্যন্ত তিনি দিয়ে দিলেন। আর এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলেন যে মনে হলো, বিশ্বব্যাংককে তিনি দেখে নেবেন। তাদের কত বড় সাহস যে, শেখ হাসিনার অতি প্রিয়ভাজন আবুলকে তারা দুর্নীতিবাজ বলে অ্যাখ্যায়িত করলো? এটি করে বিশ্বব্যাংক যেনো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে ফেলেছে। অথচ ভিক্ষাপাত্র হাতে বিশ্বব্যাংকের দুয়ারেই তাদের দাঁড়াতে হবে।
পদ্মাসেতু না করলে এই সরকারের কী আসে যায়? অথচ তারা এটাকে প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবে নিয়েছিল। এখন প্রেস্টিজ পাঙ্কচার হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক খুব সুনির্দিষ্টভাবে সরকারকে জানিয়েছিল যে, পদ্মাসেতু দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত। তাদের যদি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া না হয়, তবে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করবে এবং পদ্মাসেতুতে কোনোরকম অর্থায়ন করবে না। কিন্তু সরকার এই হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাত করেনি। বরং বিশ্বব্যাংক চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে। তারা বিশ্বব্যাংকে নানান ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলো। কিন্তু একসময় সরকারের এসব হম্বিতম্বি থেমে যায় এবং তারা বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেয়, তাদের আরোপিত সকল শর্ত মেনে নিতে সরকার প্রস্তুত আছে। বিশ্বব্যাংক যেনো ঋণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে। সেরকম অবস্থায় বিশ্বব্যাংক কঠিনতর শর্তে আবারও পদ্মাসেতুতে ফিরতে রাজি হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণে নানা ধরনের চালাকির আশ্রয় নিতে থাকে সরকার। শেষপর্যন্ত বিশ্বব্যাংক চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দেয় যে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনসহ অভিযুক্ত চারজনের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা না নিলে ঋণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে না। দুদক কিছুতেই  সে পথে যেতে চায়নি। এখন মূল অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে দুদক তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে পদ্মাসেতুর স্বপ্ন তিরোহিত হয়ে গেলো।
এসব অন্ধত্বের মাশুল সরকারকে নয়, জনগণকেই গুনতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের এই বিবাদের ফলে বিশ্বব্যাংকের অন্যান্য প্রকল্প যে টানাপোড়েনের মধ্যে পড়বে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এর সঙ্গে আছে এডিবি, আইএমএফ ও জাইকাও। এদের সকলকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন কল্পনা অসম্ভব ব্যাপার।
সরকারের অন্ধত্ব শুধু যে বিশ্বব্যাংক নিয়েই, তা নয়। সামাজিক অন্যান্য ক্ষেত্রেও তা এখন চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। শেয়ার মার্কেট থেকে কারসাজিকারদের ৪০ হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ার বিষয়টিও সরকার দেখতে পায়নি। ডেসটিনি-হলমার্ক কেলেঙ্কারিও সরকারের দৃষ্টিতে অনেক ঝাপসা। বেসামাল অর্থমন্ত্রী তো বলেই ফেলেছেন যে, সোনালী ব্যাংক থেকে যদি সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লুট হয়েও থাকে, সেটা সরকারের জন্য কোনো ব্যাপারই না। অর্থাৎ দুর্নীতি এমন এক ওজিএল লাভ করেছে। এদিকে আবার ভাড়া বিদ্যুতের নামে বিশ-ত্রিশ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। সরকার জনগণের পকেট কেটে সে লুটের পথ প্রশস্ত করেছে এবং আইন পাস করেছে যে, এসব লুট বিষয়ে কোনো আদালতেই কোনোরূপ প্রশ্ন করা যাবে না। অর্থাৎ সরকার দু'হাতে লুট করবে। জনগণ তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। এর বাইরে তাদের আর কিছুই করার নেই। কিন্তু এরকম অভিলাষ যে আখেরে পূর্ণ হয় না, তার নজির সারা পৃথিবীতে আছে। সেসব নজির সরকার মনে ও মগজে ধারণ করে না।
এদিকে বিরোধীদল দমনে সরকার যে ন্যক্কারজনক ফ্যাসিবাদী পথ অবলম্বন করেছে সেটাও ভয়াবহ। বিরোধীদলকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেবো না, সভা-সমাবেশ করতে দেবো না, বেধড়ক পিটুনি দিবো, যেভাবেই হোক বিরোধীমত দমন করবো-এই হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের প্রিয় নীতি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, পুলিশের সঙ্গে বিরোধীদল দমনে যোগ দিচ্ছে ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনী। তারা পিস্তল, চাপাতি, রড, লাঠি নিয়ে বিরোধীদলের উপর হামলা চালাচ্ছে। পুলিশ দেখেও দেখছে না। শাসকদল এই সংস্কৃতি যখন থেকে শুরু করে, তখনই আমরা সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছিলাম যে, এই ব্যবস্থা হবে চরম আত্মঘাতী। এই দানবরা একসময় সরকারেরই ঘাড় মটকাবে। সাধারণ মানুষও এদের হাত থেকে রেহাই পাবে না।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের পুলিশী প্রশ্রয় যে কী পর্যায়ে গেছে, তার সর্বশেষ উদাহরণ পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে-পিটিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হত্যা করে পুলিশের সামনে। পুলিশ সেদিকে ফিরেও তাকায়নি। যেনো এ ধরনের খুনের অধিকার ছাত্রলীগের রয়েছে।
এটা শুধু গত ৯ তারিখের ঘটনাই নয়। সারাদেশে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। এগুলো নিবৃত্ত করা তো দূরের কথা, পুলিশ সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করছে না এবং আশ্চর্য ঘটনা এই যে, সংবাদপত্রে এই খুনীদের পরিচয়সহ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই খুনের জন্য পুলিশ অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে দায়ী করে মামলা করেছে। অথচ খুনীরা কেউই অজ্ঞাত পরিচয় নয়। তারা ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় ক্যাডার। আরও আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, বিশ্বজিৎ দাসের পরিবারের মামলা গ্রহণ করেনি থানা। আইনের শাসন কোন পর্যায়ে নেমে গেছে এটি তার একটি উদাহরণ। কিন্তু সরকারের এই অন্ধত্ব দিনে দিনে যে তাদের জন্যই আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে সেটি উপলব্ধি করার মতো কান্ডজ্ঞানও সরকার এখন হারিয়ে ফেলেছে। এর পরিণতি কিছুতেই শুভ হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads