সরকার হামলা, মামলা ও গ্রেফতারের পথে এগোচ্ছে। বিরোধী দলের শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার এবং অসংখ্য মামলা ঠুকে দেয়ার পর ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম সমন্বয়কারী ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেফতারের মাধ্যমে সেই সত্যই তুলে ধরেছে। সমঝোতা ও সংলাপের পথ পরিহার করে সরকার রাজনীতিকে উত্তপ্ত করার উসকানির পথে পা বাড়িয়েছে। রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক জীবনে গ্রেফতার আন্দোলন-সংগ্রামেরই অংশ। সেই বিবেচনায় মির্জা ফখরুলের গ্রেফতার হয়তো সাধারণ রাজনীতিরই প্রতিক্রিয়া। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই গ্রেফতারটিকে এতটা সরলীকরণ করা যাচ্ছে না। এর কারণ সরকার আইনের শাসনের দোহাই দিলেও একচোখা নীতি অনুসরণ করছে। গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের কথা বললেও অগণতান্ত্রিক ভাষায় কথা বলছে, আচরণও করছে স্বৈরাচারের মতো।
বিশ্বজিতের খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, আইনের হাত সেখানে পড়ে না। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা মোটরসাইকেল থেকে পিস্তল উঁচিয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালনরত বিরোধীদলীয় কর্মীদের ধাওয়া করে গুলি করে, পুলিশ পদক্ষেপ নেয় না। পুলিশের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকারদলীয় বাহিনী বিরোধীদলীয় কর্মীদের আক্রমণ করে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো বাহিনী তা দেখে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে এমন দ্বৈতাচার ও বাড়াবাড়িকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক ভাবা সম্ভব নয়। অবরোধ কর্মসূচির আগের দিন সরকার টোকাই মিছিলের আয়োজন করে তাদের হাতে লাঠি তুলে দেয়Ñ তারা রাজপথে যে তাণ্ডব সৃষ্টি করে তারও কোনো প্রতিকার জনগণ প্রত্যক্ষ করেনি। সরকারের মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকেরা বিচারের আগে রায় দিয়ে দিচ্ছেন, আগাম শাস্তি ঘোষণা করছেন; উৎখাত আর নির্মূলের কথা বলে জাতিকে বিভক্ত করছেন; বিরোধী দলকে দমনের হুঙ্কার দিচ্ছেনÑ এর প্রতিবাদ করা যখন ন্যায়সঙ্গত তখন প্রতিবাদকারীদের গ্রেফতার শুধু নিন্দনীয়ই নয়, বিরোধী দলকে আরো বেশি কঠোর কর্মসূচির দিকে ঠেলা দেয়ার মতো ন্যক্কারজনক বিষয়ও।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সরকার সম্ভবত নিজের কঠোর অবস্থানের কথা জানান দিতে চেয়েছে। কারণ এ ধরনের গ্রেফতার হাইকমান্ডের নির্দেশ ছাড়া হয় না। দলীয় মেজাজে সাজানো পুলিশ এতটা বাড়াবাড়ি করার কথা নয়। ফলে জনগণ ধরে নিয়েছে সরকার আরো কঠোর দমন-পীড়নের পথে হাঁটবে। দেশের পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে দিয়ে কোনো-না-কোনো ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করবে। এ গ্রেফতারের তালিকায় ১৮ দলীয় সব সক্রিয় নেতা থাকার ইঙ্গিতও সরকারদলীয় নেতারা দিয়ে রেখেছেন।
বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতার পরিস্থিতিকে শুধু উত্তপ্ত ও সঙ্ঘাতময় করবে না, দেশকে আরো কঠোর কর্মসূচির দিকে ঠেলে দেবে। সরকার যদি আশা করে গ্রেফতার করে আন্দোলন ঠেকাবে কিংবা বিরোধী দল দমন করবে তাহলে শুধু ভুলই করবে না, নিজেদের পতন ও বিপর্যয় ত্বরান্বিত করবে মাত্র। আজকের বাস্তবতায় বিরোধী দলের হারানোর কিছুই নেই। নেতাদের গ্রেফতার কর্মীদের আরো বেশি চাঙ্গা করে। সংগ্রামমুখর হতে উদ্বুদ্ধ করে। এই অভিজ্ঞতা বর্তমান শাসকদলের ভাণ্ডারেও রয়েছে। সরকার হয়তো ভেবেছে মির্জা ফখরুলের মতো নেতাদের গ্রেফতার বিরোধী দলকে ভড়কে দেবে। কার্যত রাজনীতির ব্যাকরণ এমনটি ভাবায় না। বরং আন্দোলনকে আরো গণভিত্তি পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কখনো কখনো সরকার নেতাদের গ্রেফতার করে ইস্যু থেকে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য। কর্মীদের ইস্যু থেকে সরে গিয়ে মুক্তি চাই দাবির পেছনে ছোটার ব্যবস্থা করার জন্য। সম্ভবত এ মুহূর্তে বিরোধীদলীয় রাজনীতি সেই স্তরে নেই। মাঝে মধ্যে নেতাদের গ্রেফতার করে সংলাপে বসে সমঝোতায় আসার একটি কৌশল অবলম্বন করা হয়Ñ সম্ভবত সরকার এমন ধারণাকেও পুষ্ট করতে চায়।
আমরা মনে করি, এই গ্রেফতারের মাধ্যমে জনগণের কাছে সরকার ভুল বার্তাই পৌঁছিয়েছে। বিরোধী দলকে নো রিটার্নের পথে টেনে নেয়া মোটেও সমীচীন হবে না। সময় আরো গড়িয়ে যাওয়ার আগে স্থিতিশীল রাজনীতির স্বার্থে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়া উচিত। নয়তো হঠকারী এই সিদ্ধান্ত আরো নতুন নতুন হঠকারিতার পথ খুলে দেবে। এটি গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ রুদ্ধ করে দেবেÑ যা কারো কাম্য হতে পারে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন