আমানুল্লাহ কবীর
গত ১৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে তার দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে জামায়াত-শিবিরের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য বাড়াবাড়ি করা হলে শরিয়া আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ‘কিসাস’ তো আছেই।
এর আগে ও পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার আওয়ামী লীগ-যুবলীগের কর্মীদের জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত এবং যখনই যেখানে পাওয়া যাবে, তাদের ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করতে বলেছেন।
গত ১৫ নভেম্বর হিউম্যান রাইটস ফোরাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, গত চার বছরে দেশে ৪৬২টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে আর গুম করা হয়েছে ১৬৯ জনকে। এসব ঘটনা র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা ঘটিয়েছে বলে ফোরামের কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন। তারা বলেন, এতে জনমনে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থাও হ্রাস পাচ্ছে।
উল্লিখিত সব ঘটনা ও বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও বস্তুতপক্ষে যোগসূত্রহীন নয়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীÑ সবাই রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। রাষ্ট্রপতি খেয়ালবশত ফাঁসির আসামিদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী উপহাস ছলে শরিয়া আইন ও ‘কিসাসের’ কথা বলেছেন কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিণতির কথা না ভেবেই আওয়ামী লীগ কর্মীদের জামায়াত-শিবির সদস্যদের ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করতে বলেছেনÑ কোনো সচেতন ব্যক্তি এমনটা ভাবতে পারেন না; বরং উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত হবেন। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিÑ রাষ্ট্রের অভিভাবক, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের সর্বাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিÑ প্রধান নির্বাহী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রধান দায়ী ব্যক্তি। সুতরাং তারা যখনই কিছু বলেন বা করেন, তা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও তাদের বিচার-বিবেচনাকে আলোড়িত করে। ভালো হলে মানুষ খুশি হয়, মন্দ হলে হয় উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত।
প্রথমেই ফাঁসির আসামিদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের কথায় আসা যাক। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান সংবিধান-প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ২১ জন ফাঁসির আসামির দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছেন। কেউ যদি বলেন, ক্ষমাই মহত্ত্ব, তিনি ফাঁসির আসামিদের ক্ষমা করে মহত্ত্বেরই পরিচয় দিয়েছেন, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্রপতি তাদের ক্ষমা করেছেন কোন বিবেচনায় এবং তারা কারা বা সমাজে তাদের পরিচয় কী? সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি সরাসরি কাউকে ক্ষমা করার অধিকার রাখেন না। এ সংক্রান্ত সুপারিশ নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে হয়। অর্থাৎ জেলা প্রশাসন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় থেকে আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সবশেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। ক্ষমার জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করেন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ রাষ্ট্রপতিকে সই করতে হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতিকে রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২১ জন ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনই সংবিধান রক্ষা ও ‘ভীত বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ’ করার শপথ গ্রহণ করেছেন। রাজনৈতিক কারণে প্রধানমন্ত্রী এসব ফাঁসির আসামির দণ্ড মওকুফের সুপারিশ করে তিনি নিজে সংবিধান লঙ্ঘন ও শপথ ভঙ্গ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতিকেও তা করতে বাধ্য করেছেন। সংবিধান অনুসারে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ প্রধানমন্ত্রী এই বিধান মানেননি এবং দলীয় কর্মী বলে ফাঁসির আসামিদের ক্ষমা করার সুপারিশ করেছেন; অপর দিকে নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনকে বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন।
যেসব ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করা হয়েছে তারা সবাই দু’টি হত্যা মামলার আসামি। দু’টি হত্যাকাণ্ডই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডÑ যারা হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত তারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আর যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা বিএনপির কর্মী। ক্ষমাপ্রাপ্ত একজন হচ্ছে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের ছেলে বিপ্লব। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিপ্লব এলাকার ত্রাস বলে পরিচিত ছিল। সে সময়ই তার হাতে লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ড বিপ্লবের বাড়িতেই ঘটেছিল। এ ছাড়া বিপ্লব আরো তিনটি হত্যা মামলার আসামি। দু’টি হত্যা মামলায় ইতোমধ্যে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে এবং একটি মামলা এখনো বিচারাধীন। বিপ্লবের এ দু’টি মামলার সাজাও রাষ্ট্রপতি মাফ করে দিয়েছেন, সাজা কমিয়ে মাত্র ১০ বছর করা হয়েছে। বিপ্লবের বিরুদ্ধে নূরুল ইসলাম হত্যা মামলা তখনকার আওয়ামী সরকারের সময়ই শুরু হয়। কিন্তু এবার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার এই হত্যা মামলাকেই ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বলে অভিহিত এবং এ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি তা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। বিপ্লবের বিরুদ্ধে অন্য মামলাগুলোও একইভাবে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বলে প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়। তখনো শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, এখনো তিনিই প্রধানমন্ত্রী। এবার তিনি এসেছেন নির্বাচনের সময় দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তার সেই প্রতিশ্রুতি এখন হাওয়ায় ভাসছে আর খুনি বিপ্লব ভাসছে আশু মুক্তির স্বপ্নে। রাষ্ট্র যখন অন্যায়কারীর পক্ষাবলম্বন করে, তখন সাধারণ মানুষের কাছে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোনো ভরসা নেই। আল্লাহর কাছেই এখন বিচার প্রার্থনা করছেন নিহত নূরুল ইসলামের অসহায় পিতা।
অপর হত্যা মামলায় ২০ জনের ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ড ঘটে গত বিএনপি সরকারের সময়ে নাটোরে। নিহত ব্যক্তি সাব্বির আহমদ ওরফে গামা তখনকার বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা। এটিও ছিল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের আত্মীয়স্বজন এবং ২০ জনের মধ্যে ১৩ জনই এক পরিবারভুক্ত। তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় নিম্ন আদালতে। সে আদালতের আদেশই চূড়ান্ত নয়। কিন্তু মামলা উচ্চ আদালতে যাওয়ার আগেই তা ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বলে প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হলো। রাষ্ট্রপতি ২০ জনকেই সাজা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন এবং ইতোমধ্যে একজন ছাড়া বাকি ১৯ জন মুক্তিও পেয়েছে। একই পরিবারের ১৩ জন আসামি হওয়ায় এটাকে আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মনে হতে পারে। কিন্তু এটা সত্য যে, গামাকে হত্যা করা হয়েছে এবং তার এক বা একাধিক হত্যাকারী রয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতে সে বিচারের সুযোগ দেয়া হয়নি, যার ফলে বিচারপ্রক্রিয়া অসমাপ্ত রয়ে গেছে। বিচারপ্রার্থীরাও জানতে পারলেন না বিচারের চূড়ান্ত রায় কী।
বলা হয়ে থাকে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা ছাড়া সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতির আর কোনো ক্ষমতা নেই, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেকই তাকে সব কাজ সম্পাদন করতে হবে। এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। শপথ সংবিধানেরই অংশ এবং শপথ গ্রহণের সময় তিনি সংবিধান রক্ষার অঙ্গীকার করেন। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে তিনি যাতে তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সে জন্যই তিনি কোনো দল বা জাতীয় সংসদের সদস্য থাকতে পারেন না। তা ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতা নৈতিকতা-বিবর্জিত নয়। নৈতিক বলই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রধান উৎস। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। তিনি একই সাথে প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান থাকতে পারেন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দলীয় বিবেচনায় কাজ করার প্রবণতা থাকতেও পারে, যদিও তা অনেক সময়ই সংবিধানপরিপন্থী হতে পারে। দলের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির এই দায়বদ্ধতা নেইÑ তার দায়বদ্ধতা দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি সমান। প্রধানমন্ত্রী যাদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফের সুপারিশ করেছেন, তারা সবাই তার দলের নেতাকর্মী। রাষ্ট্রপতি সেই সুপারিশ অনুমোদন করে দলের প্রতি তার আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অপর দিকে, সংবিধানের প্রতি তার দায়বদ্ধতাকে গৌণ করে দেখেছেন। এর ফলে তিনি এক দিকে বিচারপ্রার্থীদের মৌলিক অধিকারকে ভ্রƒকুটি করেছেন, অপর দিকে খোদ রাষ্ট্রকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে সন্ত্রাসকেই অনুমোদন করা হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, তিনটি খুনের মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামির সব সাজাই রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করেছেন, যা ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শরিয়া আইন ও ‘কিসাস’-এর আওতায় জামায়াত-শিবিরের লোকদের বিচার করার ভয় দেখিয়েছেন। ‘কিসাস’ কথাটা সম্ভবত তার কাছে নতুন। ‘কিসাস’-এর অর্থ হচ্ছে সমশাস্তিÑ যেমন হত্যার বদলে হত্যা। আমাদের দেশে যে দণ্ডবিধি প্রচলিত আছে, তাতে হত্যার বদলে হত্যাই করা হয়। আদালতে কেউ যদি হত্যাকারী বলে প্রমাণিত হয়, তবে তার শাস্তি হয় ফাঁসি। অর্থাৎ হত্যার বদলে হত্যা। এই আইন আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে। সুতরাং ‘কিসাস’ চালু করা হলে কি এর কোনো হেরফের হবে? তবে সমশাস্তি অর্থে ‘কিসাস’-এর অন্য মানে দাঁড়ায় : কেউ কারো চোখ তুলে নিলে তারও চোখ তুলে নেয়া, কেউ কারো হাত কেটে দিলে তারও হাত কেটে দেয়া, কেউ কারো দাঁত তুলে নিলে তারও দাঁত তুলে নেয়া, তেমনি কেউ কারো রগ কেটে দিলে তারও রগ কেটে দেয়া। তবে আমাদের আইনে এই ব্যবস্থা নেই। এটা হতে পারে বিচারবহির্ভূতভাবে। প্রধানমন্ত্রী কি ‘কিসাস’ অর্থে সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন? তার নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীরের বক্তব্য ও হুমকি ধমকি থেকে সেটাই মনে হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে দলীয় কর্মীদের জামায়াত-শিবিরের লোকদের খুঁজে বের করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করতে বলছেন। অর্থাৎ তিনি দলীয় কর্মীদের আইন হাতে তুলে নেয়ার উসকানি দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রীয়ভাবে উচ্ছৃঙ্খলতা সৃষ্টি করছেন। অতীতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও মহিউদ্দীন খান আলমগীর উচ্ছৃঙ্খলতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে ‘জনতার মঞ্চ’ তৈরির পেছনে তিনি ছিলেন মূল হোতা বা ‘মাস্টারমাইন্ড’। ‘জনতার মঞ্চ’ তৈরি করে তিনি তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের উসকে দিয়েছিলেন। এ কাজটি করেছিলেন তিনি ওই সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগের হয়েÑ রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য। তাই ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে তিনি শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। তাকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছিল। এবার আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে তাকে পুরো মন্ত্রী করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কার এজেন্ডা নিয়ে তিনি মাঠে নেমেছেন, সময়ই তা বলে দেবে। আওয়ামী লীগের কর্মীদের হাতে আইন তুলে দিয়ে জামায়াত-শিবিরের লোকদের প্রতিহত ও পাকড়াও করার যে কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, তা দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। জামায়াত-শিবির অত্যন্ত সংগঠিত শক্তি। সরকারের পুলিশ ও সরকারি দলের কর্মীদের দিয়ে দমন-নির্যাতন চালিয়ে তাদের বিচ্ছিন্ন করার কৌশল বরং বুমেরাং হতে পারে। অস্তিত্বের প্রতি হুমকি মনে করলে তারাও তাদের লড়াইয়ের কৌশল পাল্টাতে পারে, যা সরকারের মোকাবেলা করা হবে আরো কঠিন। কারণ মহিউদ্দীন খান আলমগীর নিজেই সাক্ষী যে, সরকারের শেষ সময়ে পুলিশ ও প্রশাসন কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না, বরং পরবর্তী সরকারের আনুকূল্য কিভাবে লাভ করা যায় সে ব্যাপারেই বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী সামনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কথা বিবেচনা করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে আন্দোলন দমনের যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তাতে আন্দোলন আরো বেগবানই হবে।
মানুষের মনে চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। তারা রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। হিউম্যান রাইটস ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, এ সরকারের গত চার বছরে ৪৬২টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে আর গুম করা হয়েছে ১৬৯ জনকে। ফোরামের কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব ঘটনা ঘটিয়েছে র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। যারা বিচারবহির্ভূতভাবে নিহত ও গুম হয়েছেন তাদের অনেকেই রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিশেষত বিরোধী দলের। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীকেও গুম করা হয়েছে। গুম করার কৌশল নতুন, এ সরকারের আমলেই শুরু হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন ভয়াবহ ঘটনার কোনো নিরপেক্ষ বা বিচার বিভাগীয় তদন্তও হয়নি। উপযুক্ত তদন্ত না করে এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচারের ব্যবস্থা না করে বরং সরকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে লালন-পালন ও উৎসাহিত করেছে, যে কারণে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলছে। দু-চারটি ঘটনা ছাড়া মানবাধিকার কমিশনও মানবাধিকারের এমন ভয়াবহ লঙ্ঘনের ব্যাপারে সোচ্চার হয়নি কিংবা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সমাজটা যেন অনুভূতিশূন্য পাথর হয়ে গেছে, সেখানেও কোনো প্রতিবাদ দানা বেঁধে ওঠেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, যারা আদালতের কাছে বিচার প্রার্থনা করেছেন, তারাও জানতে পারেননি কেন তাদের প্রিয়জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুমের শিকার হয়েছেন, কারা কেন এসব ঘটনা ঘটিয়েছে এবং দায়ী ব্যক্তিদের আদৌ কোনো বিচার হবে কি না। আদালত বিচারপ্রার্থীদের কাক্সিত বিচার নিশ্চিত করতে পারেননি। আদালতের এই ব্যর্থতা মানুষকে আরো হতাশ করেছে।
ফাঁসির আসামিদের দলীয় বিবেচনায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন, প্রধানমন্ত্রীর কিসাস করার হুমকি এবং বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে জামায়াত-শিবির ধরার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উসকানি রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাস লালন-পালন ও উৎসাহিত করার প্রমাণই বহন করে। বলা যায়, সন্ত্রাস দমনের নামে সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাস করছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন