মাসুমুর রহমান খলিলী
সরকারপক্ষের হিসাবটা হচ্ছে অনেকটা এ রকমÑ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানা হবে না এ কারণে যে, বিএনপি বা ১৮ দল নির্বাচনে যেন না আসতে পারে। বিএনপি নির্বাচনে এলে বড় রকমের জালজালিয়াতি ছাড়া নির্বাচনে জয় কঠিন। আর ২০০৮ সালের অবস্থা তখন যেহেতু থাকবে না, নীরবভাবে নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনা কঠিন হবে। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টি, বিরোধী দল ভেঙে কিছু স্বতন্ত্রপ্রার্থী এবং ছোটখাটো কিছু দলকে নিয়ে একটি আগাম নির্বাচন করা গেলে কঠোর হাতে সব দমন করে আরো বছর তিনেক অন্তত ক্ষমতায় থাকা যাবে।
এরশাদ ও জাতীয় পার্টির এ পরিকল্পনার সাথে বড় রকমের দ্বিমত নেই। তবে এ ধরনের নির্বাচনে সেনাবাহিনী নামানোর জন্য শর্ত দিয়েছে দলটি। তিনি মনে করেন, নির্বাচনে সেনাবাহিনী নামানো হলে প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচনের উদ্যোগ সমর্থন করছে বলে মনে হবে। আর বিরোধী দল নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করতেও কয়েক দফা ভাববে। সরকারের শীর্ষ মহলের অবশ্য শঙ্কা হলো, সেনাবাহিনী এ ধরনের একতরফা নির্বাচনে কাজ করতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্মত হবে কি না। দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে একতরফা নির্বাচন করতে প্রশাসনিকভাবে যেসব জালজালিয়াতি করতে হয়, তাতে বাধা আসার শঙ্কাও থাকতে পারে। উভয় কারণে সরকার বেশ ইতস্তত সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে।
বিরোধী দলের আন্দোলনের গতি কোন পর্যন্ত যাবে, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে সরকারের। ৯ ডিসেম্বর সড়কপথ ও রেলপথ অবরোধের যে কর্মসূচি ১৮ দল দিয়েছে, তা কঠোর হাতে দমন করার চিন্তা এখনো পর্যন্ত রয়েছে। বিজয় দিবসের কর্মসূচি নিয়ে মহাজোটকে সক্রিয় রাখা গেলে বিরোধী দল খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না বলে যুক্তি দেখানো হচ্ছে। তবে কোনো কারণে আন্দোলন বেপরোয়া গতি পেলে জরুরি অবস্থার বিকল্পও সামনে রাখা হয়েছে।
একসময় সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য স্বল্প সময়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে, যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হবে। একটি কূটনৈতিক পক্ষ এ প্রস্তাবকে ভিত্তি করে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। তারা এ রকম একটি ধারণা পেশ করেন দুই বা তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংসদ ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হবে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। এর বাইরে চারজন মন্ত্রী সরকারপক্ষ থেকে আর পাঁচজন মন্ত্রী বিরোধীপক্ষ থেকে থাকবে। বিরোধীপক্ষের মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থাকবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকবে। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। এ ধরনের একটি প্রস্তাব সরকারপক্ষ থেকে একসময় উত্থাপিত হলেও এখন আর এ প্রস্তাবে সরকারপ্রধান রাজি হচ্ছেন না; বরং বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি বা স্পিকারের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিরোধী দল মানবে না বলে ঘোষণা করলেও কূটনৈতিক মহলের এই অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব তারা বিবেচনা করার আভাস দিয়েছে।
রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় উদ্যোগী দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। গত চার মাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সূচি পাচ্ছেন না। ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে নিয়ে আমেরিকান বক্তব্যে যতটা না সরকারপ্রধান বিব্রত, তার চেয়ে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে শেখ হাসিনা অধিক বিব্রত বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। ২০১২ সালে নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা না হলে ২০১৬ পর্যন্ত অচলাবস্থা চলতে পারে বলে যে আশঙ্কা মার্কিন রাষ্ট্রদূত ব্যক্ত করেছিলেন, সেটিকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেন সরকারপ্রধান।
সরকারপক্ষের ধারণা, প্রতিবেশী দেশ ভারত বিরোধী দলের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেও তাদের ঝুলে থাকা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগকে আরেক দফা ক্ষমতায় আসতে তারা সাহায্য করবে। আমেরিকার কাছে আওয়ামী লীগ সে ধরনের অগ্রাধিকার তো পাবেই না বরং নানা ইস্যুতে টানাপড়েনের কারণে তারা বিএনপি বা তৃতীয় কোনো পক্ষের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে।
সরকারের সামনে এখন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাইরে দু’টি। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেভাবে শুরু এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার বিচার আরম্ভ করা হয়েছে তাকে একটি পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে চাইবে সরকার। এ ব্যাপারে তিনটি পক্ষ থেকে বড়ভাবে বাধার মুখে পড়ছে সরকার। প্রথম পক্ষ হলো, শীর্ষস্থানীয় মুসলিম দেশগুলো এ বিচারকে মুসলিম বিশ্ব থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন এবং বিশেষভাবে ভারতনির্ভর করে তুলবে বলে আশঙ্কা করে। কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে এটি জানিয়েও দেয়া হয়েছে। তুরস্কে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতিবাদে লাখ মানুষের সমাবেশ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কয়েকটি দেশেও এ ব্যাপারে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান, জ্বালানি তেল ও বিদেশী সহায়তাÑ এ তিন ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের ওপর বাংলাদেশ বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এসব কারণে মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ কত দূর এগোতে পারবে, তা নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে। এ ধরনের চাপের মুখোমুখি হওয়া থেকে বাঁচতে ইসলামাবাদের ডি-৮ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অংশ নেননি বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। দ্বিতীয় বাধাটি আসছে জাতিসঙ্ঘ ও এর মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনসহ পশ্চিমা গোষ্ঠী থেকে। এ বিচারকে বেশির ভাগ বিশ্বসংস্থা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অস্বচ্ছ বিচার উদ্যোগ হিসেবে মূল্যায়ন করছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ আগ্রহ ছিল এখন সেই আগ্রহ হতাশায় রূপ নিয়েছে। ফলে যুদ্ধাপরাধ বিচার যে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না, তা ট্রাইব্যুনাল অঙ্গন থেকে সুখরঞ্জন বালীকে ‘অপহরণ’-এর ঘটনা নিয়ে বিশ্বমিডিয়ার কাভারেজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় স্পষ্ট হচ্ছে। এ বিচারের তৃতীয় পক্ষ হলো জামায়াতে ইসলামী। এই ইস্যুতে বিএনপি কখনো সক্রিয়, কখনো চুপচাপ থাকলেও জামায়াত বরাবরই ছিল সরব। এই সরবতা কত দূর পর্যন্ত গড়ায় সে হিসাব নিশ্চিতভাবে করতে পারছে না সরকার।
সরকারের আরেকটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ পদ্মা সেতু প্রকল্পকে ঘিরে। এ প্রকল্পের সাথে দু’টি স্পর্শকাতর পক্ষ জড়িত। একটি হলো কানাডা, অপরটি বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ব্যাপারে উভয়ের কাছে প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিব্রতকর এমন তথ্যপ্রমাণ রয়ে গেছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে আচরণ এবং তাদের চাপকে উড়িয়ে দেয়ার আগে এসব নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হচ্ছে। কানাডার আদালত সিএনসি লাভালিনের ঘুষের টাকা কার কার ব্যাংক হিসাবে গেছে এসব যদি আগামী এপ্রিলে মামলাটি শুনানির সময় বা এর আগে প্রকাশ করে দেয়, বিশ্বব্যাংকও যদি এ সংক্রান্ত সংবেদনশীল তথ্যপ্রমাণ প্রকাশ করে, তাহলে সরকারের জন্য এটি বড় রকমের বিব্রতকর হয়ে পড়তে পারে। এ ছাড়া আমেরিকার এফবিআইয়ের কাছে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নানা স্পর্শকাতর তথ্যপ্রমাণ রয়েছে বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর বেরোচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ শান্তিমিশন, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের অর্থায়নÑ এসবের ওপর শীর্ষ পশ্চিমা দেশগুলোর একধরনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এসব কারণে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী যতই বলুনÑ আমরা আমেরিকার কথা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ করিনি; বাস্তবে ১৯৭১ আর ২০১২ সালের প্রেক্ষাপট এক নয় বলে সরকারের অনেক শীর্ষ নীতিনির্ধারক মনে করছেন। ইউরোপ-আমেরিকার সাথে দ্বন্দ্বে যাওয়ার বিপদও এ কারণে বিপর্যয়কর হতে পারে বলে তাদের ধারণা।
শাসকদলের আবার ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে পৌছার পথে বাধা যদি শেষ পর্যন্ত হিমালয় আকার নেয়, তবে শেষ উপায় হিসেবে ভাবা হচ্ছে জরুরি অবস্থা। জরুরি অবস্থার চিন্তা যে আসলেই কতটা সক্রিয় তা স্পষ্ট হয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার কথায়। প্রধানমন্ত্রী বলছেনÑ বিরোধীদলীয় নেতা জরুরি অবস্থা আনতে চাইছেন আর বিরোধীদলীয় নেতা বলছেনÑ প্রধানমন্ত্রী জরুরি অবস্থা আনতে চাইছেন। যিনিই জরুরি অবস্থা আনতে চান না কেন, তাতে জরুরি নির্গমনের পথও নিশ্চয়ই একটি থাকবে। বাধার হিমালয় যদি জয় সম্ভব না-ই হয়, তবে সেই নির্গমনপথটাই হয়ে উঠতে পারে অবলম্বন। শুধু শঙ্কা হলো, ক্ষমতা রক্ষা আর ক্ষমতায় যাওয়ার এ লড়াইয়ের ঘাত-প্রতিঘাতে দেশের মানুষকে কতটা না মূল্য দিতে হয় শেষ পর্যন্ত।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন