সোমবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১২

সরকারের অসংলগ্ন অগণতান্ত্রিক আচরণ ও জামায়াত-শিবির



আজকের নিবন্ধটি শুরু করার আগে কতগুলো স্মরণীয় উক্তি পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজারে এক জনসমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন। এ ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন যে, ‘তিনি যদি তার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে বাদ না দেন, জামায়াত না ছাড়েন তাহলে তার পরিবার সদস্যদের দুর্নীতির বিচার করবেন'। প্রধানমন্ত্রীর এই হুঁশিয়ারীটি দেশব্যাপী মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনার এই হুঁশিয়ারীর সম্ভবত ১/২ দিন আগে তারই দলের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি বলে পরিচিত এবং এক সময়ের আওয়ামী লীগ জেনারেল সেক্রেটারি বেগম সাজেদা চৌধুরী বিরোধীদলগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে, দেশ স্বাধীন করেছে এবং তারাই এ দেশের মালিক। অন্য কারোর এ দেশে থাকার অধিকার নেই। বেগম সাজেদা চৌধুরীর দেশের মালিকানা দাবি এবং তার দলের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী সমর্থকদের এই দেশ থেকে বের করে দেয়ার এই ঘোষণাটিও সারাদেশে একটি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। পাঠকদের হয়তো মনে আছে যে, ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ঈদুল আযহার পর পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ১৮ দলীয় জোটের নেতা বেগম খালেদা জিয়া ভারত সফর করে এসেছেন। এই সফরকালে তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জিসহ ভারতের সরকারি ও বেসরকারি নেতৃবৃন্দের সাথে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন। তার এই সফরকে ঘিরে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিশ্লেষণমূলক বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত ভারত সরকার কর্তৃক বেগম জিয়াকে সেই দেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানোর আগে তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেননি অথবা এও হতে পারে যে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বেগম জিয়াকে ভারত কর্তৃক আমন্ত্রণ জানানো এবং তার ভারত সফর পছন্দ করেননি। এ অবস্থায় বেগম জিয়া দেশে ফেরার পর আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি এবং স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দেশবাসীকে হঠাৎ করে একটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, ক্ষমতায় যাবার জন্য বেগম জিয়া ভারত সরকারের সঙ্গে যে সমস্ত আলোচনা করেছেন এবং গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন শিগগিরই তিনি তা সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে অবহিত করবেন। তার এই ঘোষণাটিও দেশবাসী স্বাভাবিকভাবে নেননি। অনেককে বলতে শোনা গেছে যে, ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে বেগম জিয়ার আলোচনাকালে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কেউ কি তা শোনার জন্য টেবিলের নিচে লুকিয়ে ছিলেন? নাকি গোপন কোন আড়িপাতা যন্ত্র বসিয়ে রেখেছেন? অবশ্য সৈয়দ আশরাফ তার এবং তার দলের আরো অনেক প্রতিশ্রুতির ন্যায় এই প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেননি।
বেগম মতিয়া চৌধুরী এখন কৃষিমন্ত্রী। এক সময় মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী ছিলেন এবং জ্বালাময়ী বক্তৃতার জন্য অগ্নিকন্যা খ্যাতি পেয়েছিলেন। বেগম মতিয়া চৌধুরী ৭০-এর দশকের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন তিনি তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের শুধু নেত্রীই নন, নীতি-নির্ধারকদেরও একজন। তিনি সম্প্রতি জামায়াত-শিবির নির্মূল অভিযানের সরকারি কর্মকান্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন যে, তাদের দমনের জন্য পুলিশ লাগবে না, যুবলীগই যথেষ্ট। তার এই ঘোষণাকে এখনো বুড়ো বয়সের ভীমরতির ফল বলে কেউ আখ্যায়িত করেছেন বলে আমি এখনো শুনিনি। নিশ্চিন্তপুরে পোশাক কারখানায় আগুন লেগে ১২৬ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তারা এই নির্মম অগ্নিকান্ড চলাকালে কেউ সেখানে যাননি। না প্রধানমন্ত্রী, না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ঘটা করে জাতীয় শোক দিবস পালন করলেন। আর এই অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী করলেন জামায়াত-শিবিরকে। বিস্মিত দেশবাসী বুঝতে পারছেন না আমরা কোন মুলুকে আছি। কেউ কেউ বলছেন, যে হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রীর বাজার আমলও এর চেয়ে ভাল ছিল। উদ্ধৃতিগুলো অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। এখন আমি আলোচনায় আসতে চাই।
বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক উন্মত্ততার একটি অস্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছে বলে মনে হয়। এর অনুঘটক আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার, তার মন্ত্রী এবং নেতৃবর্গ। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে মোগল, পাঠান, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিগত দিনের ইতিহাসে এত নিম্নমানের ও মিথ্যাবাদী সরকার আর কোনদিন ক্ষমতায় আসেনি। ভারতের বস্তাভর্তি টাকা ও কূটপরামর্শ এবং ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের সরকারের সাথে অাঁতাত করে একটি প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এই সরকার গদীতে বসেই শুধু ধরাকে সরা জ্ঞানই নয় বরং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক ও সকল প্রতিপক্ষ শক্তিকে ধ্বংস করার কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। তাদের প্রথম টার্গেট ছিল বিডিআর ও সেনাবাহিনী। অত্যন্ত নিপুণতার সাথে তারা এই টার্গেটে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের দ্বিতীয় টার্গেট এ দেশের ইসলামী জাতীয়তাবাদী শক্তি। এই শক্তিটির ওপর তারা আঘাতের পর আঘাত হেনে চলছেন। তারা প্রথম আঘাত হেনেছেন জামায়াতের ওপর এবং এই আঘাত ও ধ্বংস প্রক্রিয়ার মাঝামাঝি এসে তারা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপিকেও নির্মূলের অভিযান শুরু করেছেন। বিশ্লেষকদের বেশিরভাগই ইতোমধ্যে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলেছেন যে, বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামপন্থী দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তাহলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়াও সম্ভবপর নয়। এ সত্যটি আওয়ামী লীগ জানে এবং এ প্রেক্ষিতে তারা শুরু থেকেই বিএনপি এবং জামায়াতকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু তারা তাতে সফল হননি। এরপর তারা জামায়াতের নির্বাচিত শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতৃবৃন্দকে সরকারের বিরোধিতা থেকে বিরত রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল এবং পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে এ সরকারের ক্ষমতার পাঁচ বছর মেয়াদকালে বিদেশে চলে যাবার কিংবা দেশে থাকলে সকল প্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু তারা সরকারের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। জামায়াত নেতাদের প্রতি সরকারের এই পরামর্শ ২০০৯ সালে দৈনিক মানবজমিন এবং ইংরেজি সাপ্তাহিক Probe সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সরকারি দলের এ প্রস্তাবের পিছনে প্রাথমিক যে কারণটি ছিল তা হচ্ছে জনগণের ম্যান্ডেট না নিয়ে অন্যূন ২০২১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় আশীর্বাদে ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে ভারতকে ট্রানজিট, করিডোর, বন্দর, গ্যাস-কয়লাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সরকারের সাথে যে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে যাচ্ছিলেন সেই চুক্তির বিরুদ্ধে যাতে জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও জনমত গঠন করতে না পারে। কিন্তু সরকার তার প্রাথমিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর তারা জামায়াতকে স্তব্ধ করার জন্যে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মিথ্যা ও সাজানো মামলা শুরু করে। পরবর্তীকালে বিএনপির কয়েকজন নেতাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তার নিজের এবং দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে কেয়ারটেকার সরকারের আমলে দায়ের করা সকল দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার পুত্রদ্বয়সহ অপরাপর নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো সচল রাখেন এবং নিজেদের সৎ ও দেশপ্রেমিক প্রমাণ ও বিরোধীদলীয় নেতাদের দুর্নীতিপরায়ণ ও দেশদ্রোহী হিসেবে পরিচিত করানোর জন্য রাষ্ট্রীয় সকল প্রচারযন্ত্রকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এর মধ্যে সরকার ক্ষমতার মসনদকে নিষ্কণ্টক করার জন্য আরো দুটি কাজ করেছেন এবং এ দুটির মধ্যে একটি হচ্ছে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল এবং আরেকটি হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিলোপ সাধন। সরকার ইতোমধ্যে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, তাদের দুর্নীতি, দুঃশাসন, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার ফলে মুনাফাখোরী ও মজুতদারীর ফলে সৃষ্ট দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবনকে এতই দুবির্ষসহ করে তুলেছে যে, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও অবাধ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসা সম্ভবপর হবে না। পুনরায় যদি তারা ক্ষমতায় আসতে না পারেন তাহলে দুর্নীতি-দুঃশাসনের জন্য তাদের বিচারের কাঠগড়ায় অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। এই অবস্থায় তারা এখন উদ্বিগ্ন এবং যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দৃঢ়সংকল্প। জামায়াত শিবির ও বিএনপির ওপর বর্তমানে যে আঘাত হানছেন এটা তাদের ঐ উদ্বেগেরই অভিব্যক্তি বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এই দেশের ইতিহাসে নতুন অথবা গোপন কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয়। চল্লিশের দশক থেকে তারা রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে এবং এ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কখনো গোপন তৎপরতা কিংবা সন্ত্রাসী জঙ্গিপনার অভিযোগ শোনা যায়নি। কিংবা কখনো তা প্রমাণিতও হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি এ ধরনের অভিযোগ উঠছে। গত ৫ নবেম্বর জামায়াতের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি চলাকালে সরকারি নির্দেশনায় পুলিশ বাহিনী তাদের প্রবলভাবে বাধা দেয় এবং এ বাধা দেয়ার ফলে বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। পুলিশ তাদের বেধড়ক মারধর করে। শুধু মারধর নয় অকথ্য ভাষায় গালাগালিও করে। এই গালাগালির একটি সংলাপ আমি নিজেই শুনেছি। জামায়াত এবং শিবিরের বিক্ষোভরত কয়েকজন কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে ঢাকার একটি থানায় নিয়ে যায়। ঘটনা জানার জন্যে আমার এক সহকর্মীসহ আমি সেখানে গিয়েছিলাম এবং থানার মধ্যে তাদের পুলিশ কর্তৃক বেধড়ক পিটানোর নির্মম ঘটনা প্রত্যক্ষ করে আমি হতবাক না হয়ে পারিনি। তারা তাদের লাঠি দিয়ে পিটাচ্ছিল আর বলছিল যে, ‘তোরা রাজাকার, জামায়াত-শিবির, কুত্তার বাচ্চা। তোদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।' আরেকজন পুলিশ কনস্টেবল বলছিল যে, ‘তোদের যদি ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনা থাকতো তাহলে হয়ত পিটুনি  কম খেতি। তোদের ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনা নেই। আর জোট করে গেলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পারবি না। কাজেই মার খাওয়া হচ্ছে তোদের ভাগ্যের লিখন।' গত চার বছর ধরে সারাদেশের জামায়াত-শিবির কর্মীরা তাদের এই গালাগালি, মারধরের শিকার হয়ে আসছেন এবং এত মার খেয়েও তারা যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন ইতিহাসে এর কোন নজির নেই। বলাবাহুল্য, গত চার বছরে সরকার জামায়াত-শিবিরের প্রায় ২৪০০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার এবং আড়াই লক্ষাধিক কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। জামায়াত একটি বৈধ রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ থেকে ৪২ নং অনুচ্ছেদ পর্যন্ত নাগরিকদের যে মৌলিক অধিকার বিধৃত আছে তা তাদেরকে রাজনৈতিক কর্মকান্ড, সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং ও সরকারের সমালোচনার অধিকার প্রদান করেছে। তারা এই সরকারের আমলের শুরু থেকেই এই অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার শুধু বঞ্চিতই হচ্ছেন না এই অধিকার ভোগের যখনই চেষ্টা করছেন তখনই তাদের কুকুরের মত পেটানো হচ্ছে এবং যারা পেটাচ্ছেন তারা হচ্ছেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, মানুষের সেবক। তাদের বেতন-ভাতা হয় মানুষের খাজনার অর্থ থেকে এবং এই খাজনায় জামায়াত-শিবিরেরও অংশ আছে। পুলিশ ও আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর লোকেরা এ পর্যন্ত গ্রেফতার বাণিজ্যের মাধ্যমে যে অর্থ কামাই করেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে এর দ্বিতীয় কোনও নজির নেই।
২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রথমত ছাত্রমৈত্রীর একজন ও পরে ছাত্রশিবিরের আরেকজন নেতা নিহত হন এবং এ নিয়ে ছাত্রলীগের সাথে এ দুটি ছাত্র সংগঠনের বিরোধ চলে আসছিল। বলাবাহুল্য, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে এবং এটা করতে গিয়ে তারা অন্য সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন করতে শুরু করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার দলীয় আধিপত্যকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের এই বিভেদ মীমাংসা করার জন্যে ২০১০ সালের প্রথমদিকে দুজন মন্ত্রী ও একজন শীর্ষ নেতা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সফর করেন এবং তা সুরাহা করতে ব্যর্থ হন। এরই কয়েকদিন পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের পর আবাসিক হলের প্রায় তিনশ গজ দূরে ম্যানহোলের ভিতরে একজন ছাত্রলীগ কর্মীর লাশ পাওয়া যায়। সরকার এবং ছাত্রলীগ শিবিরের ওপর এর দোষ চাপায়। শিবির তা অস্বীকার করে এবং এ হত্যাকান্ডকে ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দলের ফল বলে অভিহিত করে। কিন্তু সরকার কোন প্রকার তদন্ত না করেই এর জন্যে শিবির ও জামায়াতের সকল শীর্ষস্থানীয় নেতাকে এর জন্য দায়ী করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একজন ছাত্র মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন। কেউ হত্যাকারীকে দেখেনি। কিন্তু সরকার এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে চিরুনী অভিযান শুরু করে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এবং তামাবিল থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত সমগ্র বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের হাজার হাজার নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়, তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চলে। এ নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদেরকে প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। জামায়াতের আমীর, নায়েবে আমীর, শূরা ও কর্মপরিষদ সদস্য এবং বেশ কয়েকজন জেলা আমীরকে এ মামলার আসামী করা হয়। তখন থেকেই জামায়াত যখনই তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এবং সরকারি নীতির বিরুদ্ধে তাদের সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী আন্দোলন করতে গেছে তখনই ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশের যৌথ বাহিনীর হাতে তারা নির্যাতিত হয়েছে। যতই দিন গেছে ততই নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। এই নির্যাতনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একজন পুলিশ সুপার বলেছেন যে, সরকারের ইচ্ছা পূরণ ছাড়া পুলিশ বাহিনীর আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। গত চার বছরে সরকার পুলিশ বাহিনীতে প্রায় ২৩ হাজার লোক নিয়োগ দিয়েছেন। এদের শতকরা নববই ভাগেরও বেশি ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডার এবং তারা অস্ত্র পেয়ে সেই অস্ত্র ও লাঠি রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। আর মানুষের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে কেউ অনন্তকাল ধরে শুধু মার খেতে চায় না। মরার আগে কিছু প্রতিরোধও গড়ে তোলে। বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশে মার খাওয়া কর্মীরা যদি এ ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং তোলার চেষ্টা করেন তাহলে তাদের এককভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। প্রবীণদের আপনি আটকে রাখবেন। প্রবীণরা অনেক সংযমী। নবীনরাতো সব সময় সংযমী হতে নাও পারেন। ছাত্রলীগতো সরকারি দলেরই অঙ্গ-সংগঠন। তারা নিজেরা নিজেরা মারামারি করে এ পর্যন্ত নিজ দলেরই ২৪ জনকে হত্যা করেছে। শিবিরের ১০ জন ও অন্যান্য দলের ৮ জন তাদের হত্যার শিকার হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা- পরবর্তী বিক্ষোভ, হরতাল ও অগ্নিসংযোগে তারা অংশ নিয়েছে এবং পুলিশের সঙ্গে মারামারি করেছে, পুলিশকে বেধড়ক পিটিয়েছে, সাংবাদিকদের পিটিয়েছে, তাদের ক্যামেরা কেড়ে নিয়েছে। বিজিবি সদস্যদের পিটিয়েছে। তারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নৈতিক স্খলন এমন কোন অপরাধ নেই যার সাথে জড়িত নেই। সরকার এগুলোকে অপরাধ গণ্য করেন বলে মনে হয় না। জামায়াত-শিবিরের নেতাদের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, আত্মসাৎ অথবা অনৈতিক কোন কর্মকান্ডের সন্ধান পায়নি। দুই জন মন্ত্রীকে ফাঁসানোর জন্য তারা তাদের অপরাধ খুঁজে বেরিয়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। তথাপিও জামায়াতের বিরুদ্ধে তাদের নির্মূল অভিযান বন্ধ হয়নি বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের কেন্দ্রীয়, মহানগর ও বহু জেলা দফতর খুলতে দেয়া হয় না। স্বাভাবিক রাজনৈতিক তৎপরতা তারা চালাতে পারছেন না। এ অবস্থায় যখনই তারা তা করতে যান তখনি বলা হয় তারা চোরাগুপ্তা হামলা চালাচ্ছেন। চোরাগুপ্তা হামলা হয় থানায়, পুলিশ ফাঁড়িতে অথবা সরকারি স্থাপনায়। সেখানে বোমা, গ্রেনেড অথবা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়। জামায়াতের ৬০ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের হামলার কোন নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কি তাদেরকে সেদিকেই ঠেলে দিতে চান? তাদের এই চাওয়া অবাস্তব, কেননা এটি জামায়াত-শিবিরের ঈমান-আকিদা ও আদর্শের পরিপন্থী।
গতকাল সোমবার জামায়াত বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে জনসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল এবং তার জন্য ডিএমপি অনুমতিও দিয়েছিল। ৩০ নবেম্বর প্রথম আলোসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় সকল পত্রিকায় এ খবর বেরিয়েছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জামায়াতকে এ সমাবেশ করতে দেয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন যে, জামায়াতকে বেআইনী সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। তিনি বলেছেন যে, তাদের প্রতিরোধ করা হবে। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী, তিনিও ক্ষমতাসীন দলের তৃতীয় শ্রেণীর মাস্তানের ন্যায় ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। আমাদের একটা পা ভাঙ্গা হলে দশটা পা ভাঙ্গা হবে।' তিনি জামায়াত-শিবিরের মূলোৎপাটনেরও ঘোষণা দিয়েছেন। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে তার এই ঘোষণা দেশবাসীকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। দেশের মানুষের খাজনায় বেতন না হলে যে ব্যক্তির বাজার চলে না সেই ব্যক্তির এই আস্ফালন আমাদের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকি। জামায়াতকে প্রতিহত করার সরকারি সিদ্ধান্তের ফল হিসেবে দলটি হরতাল ঘোষণা করেছে। এখন রাজনীতি কোন দিকে যায় সেটিই দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads