মো. গোলাম হোসেন
|
পরাগ অপহরণের খবর আমার স্ত্রীর কাছেই প্রথম শুনতে পাই। ১২ নভেম্বরের দৈনিকগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্বসহ ছাপা হয়েছিল খবরটি। ১৩ নভেম্বরের দৈনিকে পরাগ উদ্ধারের কোনো খবর না থাকায় তাকে খুব পেরেশানই দেখা গেল। না, পরাগকে উদ্ধার করা গেল না, ওকে তারা মেরে ফেলেনি তো? কত সুন্দর চেহারা! ওর মা থাকবে কেমন করে। আপন মনে পরপর এসব বলে সদ্য অপারেশনের রোগী এই কক্ষ থেকে ওই কক্ষে পায়চারি করছেন। আমি তার কথায় সায় দেয়া থেকে বিরত থাকলাম, পাছে টেনশন বাড়ে। ১৪ নভেম্বর বোধকরি হকারের অপেক্ষায় তিনি গেটেই অপেক্ষা করছিলেন। পত্রিকার কপিটা বগলদাবা করে ঘরে ঢুকলেন। চোখে-মুখে তৃপ্তির ছাপ। হাসিমুখে উচ্চারণ, ‘পরাগ উদ্ধার হয়েছে।’ পত্রিকাটি নিজ দখলে রেখেই বললেন, ‘আমি পরাগের খবরটা পড়ি, তারপর দেখো।’ পড়া শেষ করে তবে দখল ছাড়লেন। পরাগ প্রসঙ্গ শেষে অন্য পাতায় চোখ বুলাচ্ছি। ১৫তম পৃষ্ঠায় নজরে পড়ল প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় সুরঞ্জিত সেন বলেছেন, ‘পরাগের ঘটনায় আমরা সংখ্যালঘুরা শঙ্কিত।’ হঠাত্ যেন হোঁচট খেলাম। ভুল দেখিনি তো? না, স্পষ্ট লেখা। প্রবীণ রাজনীতিবিদ, ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে ঘোর আস্থাশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাত সুরঞ্জিতের মুখেই সাংবিধানিক চেতনাবিরোধী সাম্প্রদায়িক উক্তি। বাংলাদেশে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা নেই, তবু সুরঞ্জিত বাবু সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি? তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি আশা করি দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার এবং কী চক্রান্তের কারণে তাদের গুলি করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।’ আগামী দিন কি তিনি তার এই দাবির ওপর অটল থাকবেন, বা থাকতে পারবেন? ওই একই অনুষ্ঠানে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কিছু তেলমর্দক বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাঘের সঙ্গে তুলনা করার মতো ধৃষ্টতাই শুধু দেখাননি, বরং বাঘের চেয়েও হিংস্র প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন সুকৌশলে।
দফতরবিহীন মন্ত্রী বলে তিনি হয়তো এখন অলস সময় কাটাচ্ছেন। লেখাটা হয়তো তার হাতে পৌঁছাতেও পারে, এই প্রত্যাশায় একটা ঘটনা বলছি। ১৪-১৫ বছর আগের কথা। চাকরির সুবাদে পরিচয়ক্রমে খাতির জমে গেল। আমি মুসলমান, তিনি সংখ্যালঘু। হিন্দুদের সাধারণত ধার-কর্য করা, দেয়ায় অনভ্যস্ত বা অনুদার মনে করা হলেও তার সঙ্গে আমার লেনদেন হতো। সময়-সুযোগ হলে তিনি আমার টেবিলে আসতেন, আমিও যেতাম ছুটির পরে। ডেকে বসাতেন সামনে। সহকর্মীরা ঠাট্টা করে বলতেন, ‘এই দুইয়েতে এত মিল কেন রে?’ একদিন বিকালে দেখি মুখটা আষাঢ়ে মেঘের মতো করে বসে আছেন। সামনে গিয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করতেই যা বললেন, তা মোটামুটি এই, ‘কী আর হবে, নিজে তো এক কাঠা জমি কিনতে পারছি না। বাপের রেখে যাওয়া সম্পদও রাখতে পারছি না।’ তার বক্তব্যে যা বুঝলাম, তারই কিছু প্রতিবেশী তার পৈতৃক সম্পত্তি গ্রাস করার ফন্দিফিকির করছে। নানা জটিলতায় জড়িয়ে ফেলেছে তাকে। লোকটা আসলেই সহজ-সরল প্রকৃতির বলে সুযোগ নিচ্ছে প্রতিবেশী দুষ্ট প্রকৃতির লোকগুলো। বললাম, ‘ওরা হিন্দু না মুসলমান?’ স্বর একটু চড়িয়েই অভিযোগের স্বরে বললেন, ‘আপনাদের জাতি ভাই ছাড়া আর কে?’ বললাম, ‘নিশ্চয় মৌলবাদী জামাতিই হবে। ক্ষমতায় তো আপনারাই, সাইজ করতে সমস্যা কোথায়?’ (জামায়াতে ইসলামীকে তিনি জামাতিই বলতেন)। এবার কণ্ঠস্বর পঞ্চমে তুলে বললেন, ‘আপনি কার কথা বলছেন, জামাতিরা ওখানে মরতে আসবে? সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানোর কথা বলছেন, সরিষাই তো ভূত হয়ে আছে। ওরাই তো সব জাল-জালিয়াতির মূল। তাহলে আমাদের জাতভাই বললেন যে, এখন তো দেখছি আপনারই জাতভাই।’ কষ্টের মধ্যেও মৃদু হেসে বললেন, ‘সরি।’ জ্ঞানী লোকদের জন্য নাকি ইশারাই কাফি! লম্বাকাহিনী শুনিয়ে তাহলে আর লাভ কী?
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ নানা ব্যাপারে নির্যাতিতরা কতবার কতভাবে একই অভিযোগ করে আসছে একটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে। সুরঞ্জিত বাবু সেই দলটিকে চেনেন তো? এক দেশের, এক গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে করিম-রহিমে যেমনি লাঠালাঠি হতে পারে, মামলা থাকতে পারে, তেমনি হতে পারে রাম-রহিমেও। আদালতপাড়ার অলি-গলির খবর জানা সুরঞ্জিত বাবু বলবেন কি—‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত বিবাদীরা কারা? কারা সংখ্যালঘুদের দোকানের জনম বাকির খদ্দের? কারা মাসে মাসে চাঁদার জন্য হাত পাতে? জমিজমা থেকে বেদখলের ফন্দিফিকিরে কারা? এই প্রশ্নগুলো সেদিন সেই বন্ধুকেও করেছিলাম। বহুক্ষণ নীরব থেকে দীর্ঘশ্বাস টেনে শুধু যেন এটাই বলেছিলেন, ‘এই ভুল ভাঙা দরকার, কিন্তু কীভাবে?’ সেন বাবুর অনুভূতিটা যদি জানতে পারতাম?
পরাগ উদ্ধারের হোতাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর সুরঞ্জিত বাবু এবং ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায় এখন শঙ্কামুক্ত হয়েছে নাকি? না, হতে যে পারেননি, পলাশের বাবা ও স্বজনদের কথাবার্তাই তার প্রমাণ। তাহলে শঙ্কামুক্ত হওয়ার বাস্তব পদক্ষেপগ্রহণে সত্সাহস দেখাতে পারবেন তো? আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠরা কিন্তু নিজেদের শঙ্কামুক্ত ভাবতে পারছি না মোটেও। কারণ আমরা এখন গুম ছাড়াও নানা আতঙ্কে। গত ১৭ নভেম্বর দৈনিক আমার দেশ-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে গত সাড়ে তিন বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে ৪৬২টি, গুম হয়েছে ১৫৬ জন, ২৮ জন ছাড়া বাকিদের লাশও পাওয়া যায়নি। এদের প্রায় সবাই একই আইডেনটিটি বহন করে বলে হয়তোবা প্রশাসনও তত্পরতা দেখায়নি পরাগের ঘটনার মতো। ফলে তালিকা দীর্ঘতরই হচ্ছে দিন দিন। এদিকে খালে-বিলে, নদীতে-ম্যানহোলে, রাস্তায়-ড্রামে প্রায় দিনই লাশ পাওয়া যাচ্ছে, কারও পাওয়া যাচ্ছে ক্ষতবিক্ষত ২৬ টুকরায় খণ্ডিত বীভত্স লাশও। কিন্তু দেখা যায় না পুলিশ বা প্রশাসনের প্রত্যাশিত তত্পরতা। খুনি-সন্ত্রাসীরা ‘অনুরাগ-বিরাগহীন’ অনুকম্পায় বেরিয়ে আসছে আর তাদের স্থানে গাদাগাদি করে পূরণ করা হচ্ছে সত্ ও ভালো মানুষ দিয়ে। অনেকের এখন রাতের ঘুম হারাম পুলিশ আর সন্ত্রাসের কারণে। সুরঞ্জিত বাবু কি অনুভব করেন, এদের অবস্থা কতটা সঙ্গিন? সব ধরনের জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি হিসেবে সংখ্যাগুরুরাও যে বর্তমান পরিস্থিতিতে শঙ্কিত ও বিব্রত—এই সত্যটাও বলুন না সাহস করে। এই যে প্রায় একই সময় একই এলাকা থেকে কালাচাঁন (৩০) নামে বিধবা মায়ের এক ছেলেও হঠাত্ করেই হাওয়া হয়ে গেল, তার মা রহিমা বেগম থানায় অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশ নাকি তার কথায় কর্ণপাতই করতে চায়নি। কারণটা কি এই যে, তার নেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, তার ওপর সংখ্যালঘুও নয়! তার বাড়িতে মন্ত্রী-এমপি তো দূরের কথা, বোধকরি চৌকিদারও যায়নি। একজন অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদীর কাছে হতদরিদ্র মা রহিমার শোক আর বিত্তবান লিপি মণ্ডলের শোকের অনুভূতি বিভাজন রেখা দ্বারা বিভক্তকরণ কীভাবে সম্ভব?
দুই প্রতিবেশী মুসলমানে যেমনি ঝগড়া হতে পারে, হতে পারে দুই হিন্দু-মুসলমানেও। খবর আসে ‘সংখ্যালঘু আক্রান্ত’ হয়েছে বলে। সংখ্যালঘুর প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে এটা ভালো হলেও মন্দ দিকও আছে। পরিবেশনটা এমন হলে কি ভালো হয় না—‘রাম-রহীমে মারামারি হয়েছে। হাত ভেঙেছে রামের আর ঠ্যাং ভেঙেছে রহীমের।’ সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু উভয় মিলেই তো বাংলাদেশী। এই দেশের শতাব্দীর ইতিহাসে রামুতে একটা ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটে গেল। এই ঘটনায় সরকারি দলের সম্পৃক্ততা ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ খোদ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তারা দাবি করেছে বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি। সরকার সাধু হলে তাদের অভিযোগ খণ্ডনের জন্য হলেও এই দাবি মেনে নেয়া উচিত। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সরকার এই সহজ পথটি এড়িয়ে গ্রেফতার করছে কেবল বিরোধী দলের লোকজন। এভাবে ছেঁড়া গামছা দিয়ে লজ্জা নিবারণ কতক্ষণ সম্ভব?
এই দেশে গত কয়েক বছরের মতো গুম, হত্যা ও সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। প্রায় সব ক্ষেত্রে ঘটক আর যাদের ওপর ঘটেছে, তাদের গোত্রগত বৈশিষ্ট্য প্রায় ক্ষেত্রেই এক ও অভিন্ন। ব্যতিক্রম পরাগ এবং ঘটনার প্রেক্ষাপটেও রোমাঞ্চকর নাটকের চেয়েও রোমাঞ্চকর। মা-বাবার কোলে সে অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছে, এটা সবার কাছেই স্বস্তিদায়ক।
একই অনুষ্ঠানে পরাগের কথা বলতে গিয়ে সেন বাবু বাঘতত্ত্ব নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। সে বিষয়ে আলাদা লেখার ইচ্ছা থাকলেও এখানেই বলে ফেলি। হ্যাঁ, বাঘে ছাড়ে বলেই তো তিনি এখনো দফতরবিহীন মন্ত্রী। তবে নিয়তি বৈরী হলে শিকার ধরার লোভে বাঘও ফাঁদে পড়ে, তখন তার স্থান হয় মিরপুর চিড়িয়াখানায়। শিশুরাও ‘বাঘ মামা’ বলে খোঁচা দিতে চায়, ঢিল ছোড়ে।
লেখক : সাবেক ব্যাংকার, কলামিস্ট
দফতরবিহীন মন্ত্রী বলে তিনি হয়তো এখন অলস সময় কাটাচ্ছেন। লেখাটা হয়তো তার হাতে পৌঁছাতেও পারে, এই প্রত্যাশায় একটা ঘটনা বলছি। ১৪-১৫ বছর আগের কথা। চাকরির সুবাদে পরিচয়ক্রমে খাতির জমে গেল। আমি মুসলমান, তিনি সংখ্যালঘু। হিন্দুদের সাধারণত ধার-কর্য করা, দেয়ায় অনভ্যস্ত বা অনুদার মনে করা হলেও তার সঙ্গে আমার লেনদেন হতো। সময়-সুযোগ হলে তিনি আমার টেবিলে আসতেন, আমিও যেতাম ছুটির পরে। ডেকে বসাতেন সামনে। সহকর্মীরা ঠাট্টা করে বলতেন, ‘এই দুইয়েতে এত মিল কেন রে?’ একদিন বিকালে দেখি মুখটা আষাঢ়ে মেঘের মতো করে বসে আছেন। সামনে গিয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করতেই যা বললেন, তা মোটামুটি এই, ‘কী আর হবে, নিজে তো এক কাঠা জমি কিনতে পারছি না। বাপের রেখে যাওয়া সম্পদও রাখতে পারছি না।’ তার বক্তব্যে যা বুঝলাম, তারই কিছু প্রতিবেশী তার পৈতৃক সম্পত্তি গ্রাস করার ফন্দিফিকির করছে। নানা জটিলতায় জড়িয়ে ফেলেছে তাকে। লোকটা আসলেই সহজ-সরল প্রকৃতির বলে সুযোগ নিচ্ছে প্রতিবেশী দুষ্ট প্রকৃতির লোকগুলো। বললাম, ‘ওরা হিন্দু না মুসলমান?’ স্বর একটু চড়িয়েই অভিযোগের স্বরে বললেন, ‘আপনাদের জাতি ভাই ছাড়া আর কে?’ বললাম, ‘নিশ্চয় মৌলবাদী জামাতিই হবে। ক্ষমতায় তো আপনারাই, সাইজ করতে সমস্যা কোথায়?’ (জামায়াতে ইসলামীকে তিনি জামাতিই বলতেন)। এবার কণ্ঠস্বর পঞ্চমে তুলে বললেন, ‘আপনি কার কথা বলছেন, জামাতিরা ওখানে মরতে আসবে? সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানোর কথা বলছেন, সরিষাই তো ভূত হয়ে আছে। ওরাই তো সব জাল-জালিয়াতির মূল। তাহলে আমাদের জাতভাই বললেন যে, এখন তো দেখছি আপনারই জাতভাই।’ কষ্টের মধ্যেও মৃদু হেসে বললেন, ‘সরি।’ জ্ঞানী লোকদের জন্য নাকি ইশারাই কাফি! লম্বাকাহিনী শুনিয়ে তাহলে আর লাভ কী?
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ নানা ব্যাপারে নির্যাতিতরা কতবার কতভাবে একই অভিযোগ করে আসছে একটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে। সুরঞ্জিত বাবু সেই দলটিকে চেনেন তো? এক দেশের, এক গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে করিম-রহিমে যেমনি লাঠালাঠি হতে পারে, মামলা থাকতে পারে, তেমনি হতে পারে রাম-রহিমেও। আদালতপাড়ার অলি-গলির খবর জানা সুরঞ্জিত বাবু বলবেন কি—‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত বিবাদীরা কারা? কারা সংখ্যালঘুদের দোকানের জনম বাকির খদ্দের? কারা মাসে মাসে চাঁদার জন্য হাত পাতে? জমিজমা থেকে বেদখলের ফন্দিফিকিরে কারা? এই প্রশ্নগুলো সেদিন সেই বন্ধুকেও করেছিলাম। বহুক্ষণ নীরব থেকে দীর্ঘশ্বাস টেনে শুধু যেন এটাই বলেছিলেন, ‘এই ভুল ভাঙা দরকার, কিন্তু কীভাবে?’ সেন বাবুর অনুভূতিটা যদি জানতে পারতাম?
পরাগ উদ্ধারের হোতাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর সুরঞ্জিত বাবু এবং ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায় এখন শঙ্কামুক্ত হয়েছে নাকি? না, হতে যে পারেননি, পলাশের বাবা ও স্বজনদের কথাবার্তাই তার প্রমাণ। তাহলে শঙ্কামুক্ত হওয়ার বাস্তব পদক্ষেপগ্রহণে সত্সাহস দেখাতে পারবেন তো? আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠরা কিন্তু নিজেদের শঙ্কামুক্ত ভাবতে পারছি না মোটেও। কারণ আমরা এখন গুম ছাড়াও নানা আতঙ্কে। গত ১৭ নভেম্বর দৈনিক আমার দেশ-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে গত সাড়ে তিন বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে ৪৬২টি, গুম হয়েছে ১৫৬ জন, ২৮ জন ছাড়া বাকিদের লাশও পাওয়া যায়নি। এদের প্রায় সবাই একই আইডেনটিটি বহন করে বলে হয়তোবা প্রশাসনও তত্পরতা দেখায়নি পরাগের ঘটনার মতো। ফলে তালিকা দীর্ঘতরই হচ্ছে দিন দিন। এদিকে খালে-বিলে, নদীতে-ম্যানহোলে, রাস্তায়-ড্রামে প্রায় দিনই লাশ পাওয়া যাচ্ছে, কারও পাওয়া যাচ্ছে ক্ষতবিক্ষত ২৬ টুকরায় খণ্ডিত বীভত্স লাশও। কিন্তু দেখা যায় না পুলিশ বা প্রশাসনের প্রত্যাশিত তত্পরতা। খুনি-সন্ত্রাসীরা ‘অনুরাগ-বিরাগহীন’ অনুকম্পায় বেরিয়ে আসছে আর তাদের স্থানে গাদাগাদি করে পূরণ করা হচ্ছে সত্ ও ভালো মানুষ দিয়ে। অনেকের এখন রাতের ঘুম হারাম পুলিশ আর সন্ত্রাসের কারণে। সুরঞ্জিত বাবু কি অনুভব করেন, এদের অবস্থা কতটা সঙ্গিন? সব ধরনের জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি হিসেবে সংখ্যাগুরুরাও যে বর্তমান পরিস্থিতিতে শঙ্কিত ও বিব্রত—এই সত্যটাও বলুন না সাহস করে। এই যে প্রায় একই সময় একই এলাকা থেকে কালাচাঁন (৩০) নামে বিধবা মায়ের এক ছেলেও হঠাত্ করেই হাওয়া হয়ে গেল, তার মা রহিমা বেগম থানায় অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশ নাকি তার কথায় কর্ণপাতই করতে চায়নি। কারণটা কি এই যে, তার নেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, তার ওপর সংখ্যালঘুও নয়! তার বাড়িতে মন্ত্রী-এমপি তো দূরের কথা, বোধকরি চৌকিদারও যায়নি। একজন অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদীর কাছে হতদরিদ্র মা রহিমার শোক আর বিত্তবান লিপি মণ্ডলের শোকের অনুভূতি বিভাজন রেখা দ্বারা বিভক্তকরণ কীভাবে সম্ভব?
দুই প্রতিবেশী মুসলমানে যেমনি ঝগড়া হতে পারে, হতে পারে দুই হিন্দু-মুসলমানেও। খবর আসে ‘সংখ্যালঘু আক্রান্ত’ হয়েছে বলে। সংখ্যালঘুর প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে এটা ভালো হলেও মন্দ দিকও আছে। পরিবেশনটা এমন হলে কি ভালো হয় না—‘রাম-রহীমে মারামারি হয়েছে। হাত ভেঙেছে রামের আর ঠ্যাং ভেঙেছে রহীমের।’ সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু উভয় মিলেই তো বাংলাদেশী। এই দেশের শতাব্দীর ইতিহাসে রামুতে একটা ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটে গেল। এই ঘটনায় সরকারি দলের সম্পৃক্ততা ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ খোদ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তারা দাবি করেছে বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি। সরকার সাধু হলে তাদের অভিযোগ খণ্ডনের জন্য হলেও এই দাবি মেনে নেয়া উচিত। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সরকার এই সহজ পথটি এড়িয়ে গ্রেফতার করছে কেবল বিরোধী দলের লোকজন। এভাবে ছেঁড়া গামছা দিয়ে লজ্জা নিবারণ কতক্ষণ সম্ভব?
এই দেশে গত কয়েক বছরের মতো গুম, হত্যা ও সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। প্রায় সব ক্ষেত্রে ঘটক আর যাদের ওপর ঘটেছে, তাদের গোত্রগত বৈশিষ্ট্য প্রায় ক্ষেত্রেই এক ও অভিন্ন। ব্যতিক্রম পরাগ এবং ঘটনার প্রেক্ষাপটেও রোমাঞ্চকর নাটকের চেয়েও রোমাঞ্চকর। মা-বাবার কোলে সে অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছে, এটা সবার কাছেই স্বস্তিদায়ক।
একই অনুষ্ঠানে পরাগের কথা বলতে গিয়ে সেন বাবু বাঘতত্ত্ব নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। সে বিষয়ে আলাদা লেখার ইচ্ছা থাকলেও এখানেই বলে ফেলি। হ্যাঁ, বাঘে ছাড়ে বলেই তো তিনি এখনো দফতরবিহীন মন্ত্রী। তবে নিয়তি বৈরী হলে শিকার ধরার লোভে বাঘও ফাঁদে পড়ে, তখন তার স্থান হয় মিরপুর চিড়িয়াখানায়। শিশুরাও ‘বাঘ মামা’ বলে খোঁচা দিতে চায়, ঢিল ছোড়ে।
লেখক : সাবেক ব্যাংকার, কলামিস্ট
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন