মঙ্গলবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১২

ভারতের বিলিয়ন ডলার ঋণ দেশের ক্ষতিই করবে




ভারত স্বপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো উপকার করেছে বলে কোনো প্রমাণ নেই। ভারতের নীতি হলো বাংলাদেশ থেকে শুধু নেয়া, আর কিছু না দেয়া। ইন্দিরা-মুজিব ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী আমরা ভারতকে ১৫০ হেক্টরের বেরুবাড়ি ছিটমহল যথাসময় বুঝিয়ে দিয়েছি, কিন্তু তার বিনিময় দহগ্রাম-আঙ্গুরপোতা ছিটমহলের সংযোগের জন্য মাত্র তিন বিঘা করিডোর আজ পর্যন্ত বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিচ্ছে না ভারত। শুধু গোঁজামিল দিয়ে সংযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। মাত্র ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা ব্যারাজ পরীক্ষামূলক চালুর কথা বলে, আমাদের পানি আগ্রাসনের শিকার বানিয়েছে। ফারাক্কা চুক্তি নামে যে একদেশদর্শী চুক্তি করছে, তাতে শুষ্ক মৌসুমে আমাদের পানি দেয়া হয় না। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল আজ মরুভূমি হতে যাচ্ছে। তিস্তা নদীতে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে তার সব পানি প্রত্যাহার করায় আমাদের তিস্তা প্রকল্প ভেস্তে যেতে বসছে। পূর্বাঞ্চলে আবার ভারত টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের জন্য আরেক মরণফাঁদ তৈরি করতে যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে। এরই মধ্যে তার ৪২টি নদী থেকে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করছে। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের বেশ কতগুলো রীতি-নীতি আছে, কিন্তু ভারত তার কোনো তোয়াক্কাই করছে না। ভাটির দেশ বাংলাদেশকে পানিতে শুকিয়ে মারার সব ব্যবস্থাই ভারত পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্পকে ধ্বংস করার নীল নকশাও ভারত করে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ভারত একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। আকাশ সংস্কৃতির দ্বারা বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচারকে ধ্বংস করে চলেছে। তালপট্টি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দ্বীপ হওয়া সত্ত্বেও ভারত তা জবরদখল করে আছে। বঙ্গোপসাগরে আমাদের এলাকা থেকে ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরে নিচ্ছে এবং আমাদের ২৯ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকাকে ভারতের বলে দাবি করে আসছে এবং তাতে তারা তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালাচ্ছে আন্তর্জাতিক রীতিনীতিকে ভঙ্গ করে। সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ বাংলাদেশীদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে।
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট/করিডোর পাওয়ার ব্যবস্থা ভারত পাকাপোক্ত করে এক অসম চুক্তির মাধ্যমে। অথচ সে চুক্তিতে কী আছে সরকার তা জনসমক্ষে তো অবহিত করেনি, এমনকি জাতীয় সংসদকেও জানায়নি। যাই হোক, ভারতীয় ভারী যানবাহন চলাচলের উপযোগী করার জন্য ভারত ঋণের প্রস্তাব দেয়। সেই সুবাদে তারা ভারতের এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু সে ঋণ কি আদৌ বাংলাদেশের কোনো কাজে আসবে? নাকি তা আরেক মরণফাঁদ হবে? এই ঋণের সুদের হার হলো এক দশমিক ৭৫ ভাগ। আর বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফের সুদের হার হলো মাত্র দশমিক ৫ ভাগ। শর্তের প্রথম ধাপেই বাংলাদেশকে কুপোকাত করল ভারত।
এটা এখন সুস্পষ্ট, ভারতের ঋণের টাকা ব্যয় হবে ভারতেরই প্রকল্পে। আর তার শর্তে। অদ্ভুত শর্ত হলো বাংলাদেশে কাজ হবে আর তার অনুমোদন নিতে হবে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। বিশ্বে এ ধরনের শর্তের কোনো নজির নেই। বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে কত নতজানু, তা শর্তনামায় প্রকাশিত হয়। ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৮৫ ভাগ পণ্য ও সেবা ভারত থেকে আনতে হবে। বাকি ১৫ ভাগ পণ্য ও সেবা ভারতীয় ঠিকাদারের পরামর্শ মোতাবেক আনতে হবে। এখানে লক্ষণীয়, ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা নয়, সে দেশের ঠিকাদারের পরামর্শ নিতে হবে—কোন আত্মমর্যাদাশীল জাতি এ ধরনের শর্ত মানতে পারে, তা কল্পনা করা যায় না। এতসব একতরফা শর্ত মেনে এ ঋণ নেয়ার সার্থকতা কী? এতে ঋণের সুদসহ যে বোঝা জাতির ঘাড়ে চাপছে, তা পরিশোধ করা সহজ হবে না। ঋণের টাকার ব্যবহার করা হবে ভারতীয় মালামাল তার পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে নেয়ার জন্য। এখন ভারতকে যে নিরাপত্তাহীন প্রায় তিন গুণ বেশি রাস্তা ঘুরে পূর্বাঞ্চলে মালামাল পাঠাতে হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ খরচেই তা পৌঁছাতে পারবে এ প্রকল্প কার্যকর হলে। বিষয়টি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, প্রয়োজনে ভারত সমরাস্ত্রসহ সৈন্য পাঠাতে দ্বিধা করবে না। তখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা কোথায় থাকবে?
ভারতের স্বার্থে নির্মিতব্য প্রকল্পের জন্য রড, সিমেন্ট, বালু ও আনুষঙ্গিক নির্মাণসামগ্রী ভারত থেকেই আনতে হবে। প্রকল্পের প্ল্যান-ডিজাইন-নকশা—সবই ভারত থেকে আসবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ঋণচুক্তির শর্তের বাইরে নতুন নতুন শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে একরকম জিম্মি করে ফেলেছে ভারত। ভারতীয় ঋণের টাকা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো ক্ষমতাই বাংলাদেশের হাতে থাকছে না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ভারতের হাতেই থাকছে। এই ঋণের আওতায় ১৪টি প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার চূড়ান্ত করেছে, তা ভারতের নৌ, সড়ক ও রেল যোগাযোগের সহায়ক হবে। কর্মকর্তারা আরো জানান, ভারত বাংলাদেশের কোনো আপত্তিই গ্রাহ্য করছে না। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সময় এই বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তিকে ফলাও করে প্রচার করা হয় যে, এতে বাংলাদেশের অবকাঠামোর উন্নতি হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, যোগাযোগব্যবস্থায় বাংলাদেশের প্রয়োজন নেই, অথচ ভারতের প্রয়োজনেই তা করা হচ্ছে। ভারত আরও একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে, এই অবকাঠামো তৈরির ফলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কী উন্নতি হয়, তা ভারতকে অবহিত করতে হবে। ভাবখানা এমন যে, ভারত বাংলাদেশকে এই বিলিয়ন ডলার অনুদান হিসেবে দিয়েছে, তাই তার নজরদারি করাটা যথার্থ। এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, হাসিনা সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির পুরো সুযোগটি ভারত আদায় করে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কর্মকাণ্ডের যে বর্ণনা দিয়েছি, তাতে স্পষ্ট বলা যায়, ভারত কোনো কাজই বাংলাদেশের স্বার্থে করেনি। এই বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তিও বাংলাদেশের কোনো কাজে আসবে না। বরং এতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা শঙ্কায় পড়ার আশঙ্কা। অধিকন্তু এই সুযোগে ভারত পূর্বাঞ্চলে সমরাস্ত্র ও সৈন্য পাঠানোর কাজে ব্যবহার করলে চীন তা সহজভাবে মেনে নেবে না। অরুণাচলের ওপর চীনের দাবি বহুদিন থেকে আছে। তাই চীন বাংলাদেশকে ভারতের কলাবরেটর হিসেবে গণ্য করতে পারে। তখন চীন বাংলাদেশের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। তখন চীন বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন কাজে সহযোগী নাও থাকতে পারে। অথচ চীনই এতদিন নিঃশর্তভাবে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে আসছে। তারা বার্মা হয়ে চীনের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগের প্রস্তাব দিয়েছে। সোনাদিয়া দ্বীপে আন্তর্জাতিক নৌবন্দর (Deep Sea Port) গড়ারও আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান ভারতঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির জন্য তা ব্যাহত হতে পারে

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads