নির্বাচন গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে সব নির্বাচনই যে গণতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক হয় তা নয়। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের শর্ত হলো- অবাধ মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা। এসব শর্ত লঙ্ঘন করে যদি কোন নির্বাচনে অনিয়ম, দুর্নীতি, পক্ষপাত ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার কৌশল অবলম্বন করা হয়, তাহলে গণতন্ত্রের ব্যাপারে জনমনে সৃষ্টি হয় হতাশা। তাই গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ খুবই জরুরি বিষয়। এসব বিষয়ে আমাদের দেশে সমস্যা রয়েছে। জনগণের মতামত ও রায়কে শ্রদ্ধা করার বদলে যেনতেন প্রকারে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মানসিকতা আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি দুঃখজনক বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে আস্থা বা বিশ্বাসের সংকট আমাদের দেশে প্রকট। ফলে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সব দলের নিকট একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অন্যতম প্রবক্তা ছিল। কিন্তু কি যে হয়ে গেল, এখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার ঘোরতর বিরোধী। তারা এখন দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো পরিবেশ দেশে নেই। এরকম নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে আস্থার প্রয়োজন তা মোটেও নেই। বরং রাজনৈতিক দলগুলো অহরহ পরস্পরের প্রতি অনাস্থা, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ প্রচারে রয়েছে ব্যস্ত। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ লাঘব করতে পারে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মানসিকতা। কিন্তু আলাপ-আলোচনা দূরে থাকুক পরস্পরের মুখ দেখাদেখিও রয়েছে বন্ধ। এমন বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দেশে সংকটের মাত্রা আরো বাড়বে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
গণতান্ত্রিক চেতনার বদলে সরকারি প্রভাব বলয়কে কাজে লাগিয়ে বিজয়ী হওয়ার মানসিকতা কখনো যে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না তার বড় প্রমাণ এবারের বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) নির্বাচন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয় : ব্যালট বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, প্রতিদ্বনদ্বী প্যানেলের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার, হামলা, ভাংচুর, সংঘর্ষ ও পেশীশক্তির মহড়ার মধ্যদিয়ে বিএমএ নির্বাচনের ফল পাল্টে দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। জাল ভোটের মহোৎসব চলায় মোট ভোটারের চেয়ে ভোট বেশি পড়েছে। বরিশাল, ময়মনসিংহ, মুন্সিগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, রাজবাড়ী, ভোলা, বরগুনা, ঝালকাঠি, শরীয়তপুর, নরসিংদী, জামালপুরসহ আরো কয়েকটি জেলা থেকে মোট ভোটারের চেয়ে বেশি ভোটের হিসাব নির্বাচন কমিশনে এসেছে। নির্বাচন কমিশনও গত শুক্রবার বিকেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন। ভোটারের চেয়ে ভোট বেশি হওয়ায় ফল প্রকাশ করতে পারছে না কমিশন। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে পেশাজীবী চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ'র এবারের নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা। এরপরেও সরকারি দলের চাপে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষিত হলে আমরা তেমন অবাক হব না। কারণ গণতন্ত্রের বিজয়ের বদলে যারা নিজেদের বিজয়কে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, তাদের প্রতাপে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারে।
একটি পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে শাসকদলের লোকজন ভোট-জালিয়াতির ব্যাপারে এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারলে, জাতীয় নির্বাচনের বেলায় দলটি কোনরূপে আবির্ভূত হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। ফলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন- এবারের বিএমএ নির্বাচন আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের মতো এতো বড় নির্বাচন বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। তাই এখনও আমাদের সামনে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। এই বিষয়টি সরকার দ্রুত উপলব্ধি করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে অগ্রসর হলে জাতীয় দুর্যোগের কালো মেঘ অনেকটাই কেটে যেতে পারে। কিন্তু যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়ার সর্বনাশা মানসিকতা পরিহার করে গণতান্ত্রিক চেতনায় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হন কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন