ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
আমাদের মহামান্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ নবেম্বর টাঙ্গাঈলের ধনবাড়ীর এক জনসভায় বলেছেন যে, ‘বিএনপির দুটি গুণ,/ দুর্নীতি আর মানুষ খুন।' প্রধানমন্ত্রী সুশিক্ষিত মানুষ। আমাদের মতো বহু কষ্টে একটি মাত্র পিএইচডি ডিগ্রি তিনি অর্জন করেননি। আপ-সে-আপ ডজনাধিক পিএইচডি ডিগ্রি তার পদতলে এসে হাজির হয়েছে। তিনি বুকে তুলে নিয়েছেন। আমরা তুচ্ছ সাধারণ নাগরিক। যথাযথভাবে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন না করলে এবং শিক্ষকতা পেশায় না থাকলে আমাদের সরাসরি পিএইচডির জন্য রেজিস্ট্রেশন করার যোগ্যতা অর্জিত হয় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য সেটা কোনো ব্যাপার ছিল না। তাকে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করতে হয়নি। এমফিল ডিগ্রি অর্জন করতে হয়নি। কিংবা এমফিল ফাস্ট পার্ট করে পিএইডিতে ট্রান্সফার করতে হয়নি। এমফিলের জন্য অনার্স-মাস্টার্সের মতো ক্লাস করতে হয়নি। ডিগ্রি হাজির। তা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। সেগুলো উল্লেখ করলে লোকে আমাকে নিন্দা-মন্দ করতে পারে। কিন্তু আমাকে এরকম দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটিমাত্র পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে হয়েছে এবং ধারণা করি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ও যদি (কোনো সম্ভাবনা নেই) আমাকে আর একটি পিএইচডি ডিগ্রি অফার করে আমি তা গ্রহণ করবো না। কারণ তা আমি অর্জন করিনি।
এত বড় সুশিক্ষিত মানুষ তার কাব্যপ্রেম আছে। তিনি প্রবাদ প্রবচনে বিশেষ অভিজ্ঞ। এগুলো আমরাও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অধ্যয়ন করেছি। কিন্তু এখন আর সবকিছু মনে রাখতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঝেমধ্যে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, তিনি প্রবাদ প্রবচনে বিশেষভাবে আসক্ত এবং সেগুলো খুব মনে রাখতে পারেন। প্রবাদ প্রবচনই শুধু নয়, আঞ্চলিক লোককথায়ও তিনি ভারী ওস্তাদ। যখন তিনি বলেন যে, ‘আমার বেগুন আমি রানবো/ যত খুশি লবণ দেবো'- এগুলো প্রবাদ প্রবচনে খুব একটা প্রচলিত নেই। আঞ্চলিক লোককথায় প্রচলিত আছে। আমি কখনও কখনও চমৎকৃত হই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন সব কথা বলেন যে, শৈশবের স্মৃতি বুকের মধ্যে কিলবিল করে ওঠে। প্রসঙ্গটা না ভাবলেও প্রবচনগুলো আমার খুব ভাল লাগে। স্বাগত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
এই যে তিনি বললেন, ‘বিএনপির দুই গুণ/দুর্নীতি আর মানুষ খুন'- তা ছিলো আমার কাছে খুব কৌতূহলোদ্দীপক। বেশিরভাগ সংবাদপত্র ঐ শিরোনামেই রিপোর্টটি প্রকাশ করেছিল। শিরোনাম দেখে আমি দারুণ মজা পেয়েছিলাম। কী চমৎকার মিল দিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কথা বলতে পারেন। আমি নিঃসঙ্কোচে বলতে চাই যে, বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এই ভাষায় কোনোদিন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতে পারবেন না। কেউ বলতে পারেন যে, তিনি তো আর দীর্ঘকাল গ্রামে বাস করেননি, এত কথা তার জানা নেই। সম্ভবত সে কারণেই পারবেন না। সে যাই হোক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তৃতা আমাকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। আমার মা-চাচী-খালা-দাদীরা এরকম নানা নতুন নতুন স্লোগান দিতেন। শৈশব-কৈশোরে হেসেই মরতাম। এখন দেখি এগুলোই সম্ভবত বাস্তবতা।
ধনবাড়ীর জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, ‘‘বিএনপির দুই গুণ, দুর্নীতি আর মানুষ খুন। তারা যখনই ক্ষমতায় আসে, তখনই মানুষ খুন করে। গাড়ি থেকে মানুষ নামিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করার নজিরও তাদের রয়েছে।’’ বিএনপি যদি তাই করে থাকে, তাহলে সে কথা বলবার অধিকার প্রধানমন্ত্রীর আছে। কিন্তু লজ্জা মানুষের ষড়রিপুর একটি নয়। সুতরাং লজ্জা যে থাকতেই হবে এমন নিকৃষ্ট দাবি যারা করে, বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে তাদের চেয়ে ইতর প্রাণী এই বাংলাদেশে আর কেউ নেই। ফলে তাদের দুই গুণ। দুর্নীতি আর মানুষ খুন।
প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান সময়েও এমন নির্লজ্জ বক্তব্যে খানিকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছি। দুর্নীতি আর মানুষ খুন এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কোন লজ্জায় বিএনপিকে দোষী করলেন, সেটি রীতিমতো ভাবনার বিষয়। তারা এখনও জোর গলায় বলেন যে, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া বি-শা-ল দুর্নীতি করেছে। শেখ হাসিনার ডেকে আনা রাষ্ট্রঘাতী মইন-ফখরের সরকারও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। অথচ ঐ অভিযোগে তাকে পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে উপর থেকে ফেলে দিয়ে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে ফেলা হয়েছে, যাতে তারেক রহমান আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে না পারেন। কিন্তু আল্লাহর অসীম রহমতে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। যে মীরজাফর জেনারেল মইন উদ্দিন আহমদ এই কাজ করেছিলেন, তিনি এখন চিরস্থায়ী পঙ্গু। তার মেরুদন্ডের রজ্জু নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই এবং আশ্চর্য এই যে, একটা দেশের সেনাবাহিনী প্রধান বহু আগে থেকেই ভিন্ন আর এক দেশের নাগরিক। যদি সমালোচনা করতে চাই তাহলে বলতে হবে, যে সরকার এক ভিনদেশী নাগরিককে সেনাবাহিনী প্রধান করেছে, সে সরকার তা ঠিক করেনি।
বিএনপির তরফ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, মইন-ফখরের বিচার করা হোক। তখন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলে বসলেন যে, মইন-ফখরকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তাদের বিচার করতে হলে খালেদা জিয়া করুক। এর চাইতে হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে? ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, শেখ হাসিনা এই মর্মে ঘোষণা দিয়েছিলেন, মইন-ফখর যাই করুক, বিএনপিকে ধ্বংস করুক। তাতে তার শতভাগ সমর্থন রয়েছে। তিনি যদি ভবিষ্যতে কখনও ক্ষমতায় আসেন তবে সংবিধান সংশোধন করে তাদের সকল কর্মকান্ডের বৈধতা দেবেন। দিয়েছেনও। এমন বেহায়াপনার নজির ইতিহাসে খুব কমই আছে।
ত্রাণ তহবিল-খেকো সাবেক প্রধান বিচারপতি সংবিধান সংশোধনীর যেসব বিষয় জারি করেছেন, তাতে আছে যে, মইন-ফখররা যা করেছে, সব বৈধ। তাহলে কোন আক্কেলে বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর দায়েরকৃত মামলার বিচার কাজ চলতেই থাকবে? কিন্তু বাংলাদেশে এভাবেই চলছে।
কিন্তু তাতে কি শেখ হাসিনা বিএনপিকে লক্ষ্য করে এই কথা বলতে পারেন যে, ‘বিএনপির দুই গুণ/দুর্নীতি আর মানুষ খুন।' শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে চ্যালা-চামুন্ডেরা পর্যন্ত এখন দুর্নীতির মহোৎসবে লিপ্ত এবং দুর্নীতি জায়েজ করার জন্য শেখ হাসিনা সরকার নির্লজ্জভাবে আইনও পাস করেছে। এটাও পৃথিবীর ইতিহাসে কম কলঙ্কজনক অধ্যায় নয়। আর মানুষ খুন! প্রতিদিন দেশে কমপক্ষে গড়পরতা ১৪ জন মানুষ খুন হচ্ছে। শেখ হাসিনার প্রিয় ছাত্রলীগের ঘাতকরা কোথাও না কোথাও ছাত্রদল-শিবিরকে হত্যা করছে। তা না পারলে নিদেনপক্ষে ছাত্রলীগের আর একজন ঘাতককে খুন করছে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে সাধারণ মানুষ খুনিবান্ধব বলতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত খুনের দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ২৫ জন খুনিকে ক্ষমা করা হয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যারা রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তারা মাত্র চারজন খুনিকে খুনের দন্ড মার্জনা করেছিলেন। আর বর্তমান বয়োবৃদ্ধ অশীতিপর মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান গত চারবছরেই ২১ জন ফাঁসীর আসামিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আশ্চর্য ঘটনা এই যে, এই ক্ষমাপ্রাপ্ত আসামিদের জেলগেট থেকে মুক্ত করে এনে হাসিনা সরকারের মন্ত্রীরা সার্কিট হাউজে ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছেন। তারপরও শেখ হাসিনা কোন বিবেচনায় বললেন যে, ‘বিএনপির দুই গুণ/দুর্নীতি আর মানুষ খুন'।
খুন এই সরকারের ওপেন জেনারেল লাইসেন্স। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগসহ যত রকম লীগ আছে সবাই মিলে একেবারে উলুধ্বনি দিয়ে নরহত্যা করছে। সন্ত্রাসবান্ধব সরকার হত্যাকারীকে বুকে তুলে নিচ্ছে। স্বদলের হলেও নিহতের পরিবারের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না, বিচার তো অনেক দূরের কথা। এই যে প্রায় সপ্তাহে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কোথাও না কোথাও একজন না একজন খুন হচ্ছে, তাতে মনে হয়, এখানে সরকারের অবস্থান খুনির পক্ষে । কারণ ছাত্রলীগের কোনো খুনি এ পর্যন্ত কোনো বিচারের সম্মুখীন হয়েছে বলে শুনিনি। সেদিন দেখলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক বহিষ্কৃত নেতা, যে তার সহকর্মীকে হত্যার দায়ে বহিষ্কৃত হয়েছিল, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের মিছিলে পুলিশের সামনে পিস্তল দিয়ে গুলী করছে। একজন খুনি পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে পিস্তল হাতে গুলী করছে। পুলিশ তাকে আটক করলো না কেন? এতে সাধারণ মানুষের মনে এই ধারণাই হবে যে, নিশ্চয়ই সরকারের কোনো মহলের নির্দেশ আছে যে, ছাত্রলীগ খুনি হলেও তাকে গ্রেফতার করা যাবে না। কিন্তু প্রতিপক্ষের হামলায় যখন ছাত্রলীগের এই খুনি তানিম গুরুতর আহত হলো, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগ তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিল। অর্থাৎ খুনিকে বুকে টেনে নিল। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পরামর্শ ছিল কিনা বলতে পারি না। কিন্তু এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এই সরকার খুনিবান্ধব।
আর দুর্নীতি? দুর্নীতিকে সরকার এখন রাষ্ট্রীয়করণ করে ফেলেছে। এমনকি আইন করেছে যে, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সরকার যাই করুক না কেন এর বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো মামলা দায়ের করা যাবে না। বলিহারি সিদ্ধান্ত। প্রায় সাড়ে তিনশ' কোটি টাকা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের পক্ষ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিনা বলেছেন? বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত তাকে মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে উপাধি দিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা বমাল ধরা পড়ার পরও তাকে মন্ত্রীর পদে বহাল রেখেছেন। অবশ্য খামাখা। দফতরবিহীন এই মন্ত্রী আরও দুর্নীতি করার জন্য এখন দফতরের আশায় শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করতে একেবারে দিশেহারা। কী যে ভয়ঙ্কর বেহায়া এই সরকার ও তার মন্ত্রীরা। টাকার বস্তাসহ গ্রেফতারকৃত এতবড় দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য স্পষ্ট নয়। যে মন্ত্রী দুর্নীতি বেশি করতে পারেন, এখন মনে হচ্ছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর তত প্রিয়। তারপরেও কি তিনি বিএনপির গুণের এমন গীত গাইতে পারেন?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন