শওকত মাহমুদ
|
রোববার ২ ডিসেম্বরের কাগজে দুটি শিরোনামে আবারও প্রমাণ হলো—বাংলাদেশ আসলেই কলা-প্রজাতন্ত্র (Banana Republic) বনে গেছে। এক. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বলে সর্বশেষ হুমকি ছেড়েছেন যে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটের রাজনীতি না ছাড়লে বেগম খালেদা জিয়ার কথিত দুর্নীতির বিচার হবে। অর্থাত্ রাজনীতি কেমন করে কার সঙ্গে করতে হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার। অন্যথায় মামলা বা কারাবাস। দুই. অগ্নিদগ্ধ তাজরীন ফ্যাশনের বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা বেতন না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরেছে। সরকার নিরাপদে থাকা মালিকের কাছ থেকে শ্রমিকদের বেতন আদায় করে দিতে নারাজ। মালিকের পক্ষেই দাঁড়াল সরকার।
কলা-প্রজাতন্ত্রের বিশ্বস্বীকৃত বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—রাষ্ট্রে যখন গণতন্ত্র নামেমাত্র থাকে, দুঃশাসন-দুর্নীতি চরমে, পার্লামেন্টের সদস্যরা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন (টিআইবির সাম্প্রতিক জরিপে যা স্পষ্ট), সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের দায়িত্ব ভুলে সংসদ সদস্যরা ব্যবসা-বাণিজ্য পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে না, মত প্রকাশের অধিকার ভূলুণ্ঠিত, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ প্রতিকারহীন হয়ে দাঁড়ায়; তখনই তা কলা-প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। এটা ফ্যাসিবাদেরই আরেক রূপ। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো এ মুহূর্তে অনলাইন জরিপের ফলাফল যেভাবে ছাপছে, তাতে এ সমাচার আভাসিত যে, জনমত উপেক্ষা করেই সরকার দেশ চালাচ্ছে এবং কূটনীতিও গণআকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী। বাংলাদেশের দুই সীমান্তে বিএসএফ এবং নাসাকা বাহিনী হত্যা, নির্যাতন ও পুশইনের অমানবিক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। আমরা প্রতিবাদ করি না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্বর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি’র উদ্বেগের সঙ্গে শামিল হই না। আন্তর্জাতিকতা ও মানবিকতার পরিপূরণে বাংলাদেশ ব্যর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্র হিসেবেই দুর্বল হয়ে গেছে। প্রতিটি ইস্যুতেই বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকার চক্রান্তের গন্ধ খুঁজে আপন অস্তিত্বের স্বার্থে রাজনীতি ঘোরাচ্ছে। সরকারের এমনি অমানবিকতা, উদ্যোগহীনতা সার্বিকভাবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে রক্তশূন্য করে তুলেছে। সত্যিকারভাবে নির্বাচিত না হলে একটি সরকার যে খুব দ্রুত স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী হয়ে পড়ে, আওয়ামী লীগের সরকার তার প্রমাণ।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির বর্তমান ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং জিয়া পরিবারকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে কিছু প্রমাণ করতে না পারার ব্যর্থতা সর্বোপরি সরকারের প্রতি গণমানুষের বিপুল ধিক্কারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন-মেজাজ ভালো যাচ্ছে না। গত ২৮ নভেম্বর বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের রাজধানী-কাঁপানো জনসভা মূলত একটি গণঅভ্যুত্থানেরই পদধ্বনি। বেগম জিয়া আন্দোলনের যে কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তাতে হরতাল নেই বরং জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি মুখ্য ছিল। রাজপথ অবরোধ, গণসংযোগ প্রভৃতি কর্মসূচি আন্দোলনের গতানুগতিক রূপরেখা হলেও সময়ের কারণে এ সবই এখন জনগণের কাছে ক্ষোভ প্রকাশের বাহনরূপে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিরোধী দলকে ‘নট নড়ন চড়ন’ অবস্থায় নিয়ে যাওয়াতে সামান্য কর্মসূচি পাওয়া গেলে দলীয় কর্মী এবং উত্সুক জনগণ ভিড় জমায়। মানুষ বা যানবাহনের ওপর হামলার কর্মসূচি নয়। অথচ সেদিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টাঙ্গাইলে এক জনসভায় ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে বসলেন যে, বিরোধী নেত্রী মানুষ মারার কর্মসূচি দিচ্ছে। কিসাস অর্থাত্ হত্যার বদলে হত্যার নীতি ঘোষণাকারী প্রধানমন্ত্রী উল্টো বললেন যে, বেগম জিয়া জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে লাশ চায়।
শনিবার প্রধানমন্ত্রী আরেক জনসভায় হুমকি জারি করলেন যে, জামায়াতের সঙ্গে মিলে রাজনীতি না ছাড়লে বেগম জিয়ার দুর্নীতির বিচার হবে। বেগম জিয়ার দুই সন্তানের বিরুদ্ধে বিষোদগার অব্যাহত রেখে বললেন, তারা বিদেশে বিলাসী জীবন যাপন করছে। নতুন নতুন গাড়ি কিনছে। এসব উক্তি শুধু বানোয়াটই নয়, তীব্র মানহানিকরও বটে। তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান অসুস্থ হয়ে বিদেশে চিকিত্সাধীন—গোটা জাতি এ খবর জানে। তারা যে নিরপরাধ, অপপ্রচারের শিকার—এও সবাই বুঝতে পেরেছেন। জামায়াতের সঙ্গে মিলে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে পাশের চেয়ারে বসে শেখ হাসিনা নব্বইয়ের প্রথমার্ধে যখন বিরোধী নেত্রীর রাজনীতি করছিলেন, তখন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেননি তাকে জামায়াতের সংশ্রব ত্যাগ করার জন্য। কেননা তা হতো গণতান্ত্রিক ঔদার্য এবং রাজনৈতিক শালীনতার পরিপন্থী। কিন্তু শেখ হাসিনা অবলীলায় তা বলে দিলেন। জামায়াতে ইসলামী আইন দ্বারা নিবন্ধিত দল এবং সংসদেও তার প্রতিনিধিত্ব আছে। বিএনপি কার সঙ্গে জোট বাঁধবে, সেটা তো সরকারপ্রধান নির্ধারণ করতে পারে না। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কয়েকজনের বিচার হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর বিচার হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধের বিচার ত্বরান্বিত বা বিলম্বিত করার ক্ষমতার জানান দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভায় যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতেই বিচার প্রক্রিয়ায় সরকারের নিয়ন্ত্রণের চিত্র পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।
এসব কথার অবতারণা এজন্য যে, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করা বাংলাদেশ এখন অসভ্য রাষ্ট্র বনে যাচ্ছে। বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে না দেয়া, ক্রসফায়ার-গুমে নেপথ্য-উত্সাহ দেয়া, সাংবাদিক-হত্যায় নিশ্চুপ থাকা, ভিন্নমতের অসহনীয় দলন, আইন রক্ষাকারীদের সরকারের রক্ষাকারী হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো এখন প্রতিদিনের। জনগণের দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রতিদিন নানা নাগরিক সমস্যায়। কিন্তু সরকার নির্বিকার।
কলা প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হলো, সরকার তাদের একান্ত অনুগতদের স্বার্থ রক্ষা করে তাদের সব সুবিধা দিতে চায়। সেখানে গোল্লায় যায় যুক্তি এবং শৃঙ্খলা। শেয়ারবাজারে লক্ষ-কোটি টাকা আত্মসাত্কারীদের বিচার হলো না। অথচ জনগণের কাছে লুটেরাকুল চিহ্নিত। হলমার্ক, ডেসটিনি সব লুটপাটের ঘটনায় জড়িত সরকারপ্রধানের উপদেষ্টারা। পদ্মা সেতুর ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ সরকারি অস্বীকারে প্রথমে পাত্তা না পেলেও এখন দুদকই স্বীকারোক্তি দিচ্ছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পরিবারের কেউ জড়িত কিনা, আমরা জানি না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনা থেকেই যখন বলে দিয়েছিলেন যে, জাতির জনকের পরিবার সম্পর্কিত আইনে স্বীকৃত সদস্যরা কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয়, তখন প্রশ্ন উঠেছিল, তাহলে কি এমন কোনো আত্মীয় আছেন, যারা ওই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত? পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিতর্কিত পরামর্শক এসএনসি লাভালিন কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি নিক্সন চৌধুরী কার আত্মীয়?
এ সরকারের আমলে কোনো তদন্ত এগোতে চায় না, যদি তাতে সরকারের ঘনিষ্ঠ কেউ থাকে। এ করেই পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত হয়ে গেল। তাজরীন ফ্যাশনে আগুন লেগে ১১১ জন মরল, চট্টগ্রামে অপ্রয়োজনীয় উড়াল সেতুর গার্ডার ভেঙে ২০ জনের বেশি মারা গেল। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মহানগর আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক তাই তাকে ধরা যাবে না। তাজরীনের মালিককে পুলিশ গ্রেফতার তো দূরের কথা, ডেকেও জিজ্ঞেস করে না। তিনি তার ইচ্ছামত মিডিয়ার সামনে আসেন। মিডিয়াও খুঁজতে চায় না। তিনি বেতন দেননি, কিন্তু সরকার তাকে চাপ দেয় না। শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ, কিন্তু সরকারের তাতে কী? পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করছে। সামরিক জান্তার আমলে মিয়ানমারে পুলিশ একবার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বেধড়ক মেরেছিল। ক’দিন আগে টিভিতে দেখলাম সেই ঘটনার জন্য পুলিশ বৌদ্ধ ভিক্ষুকের পা মুছে ক্ষমা চাচ্ছে। কবে যে বাংলাদেশে এমন দেখব, জানি না। তাজরীনের মালিক নাকি আওয়ামী লীগের পেশিশক্তিবহুল এক নেতার শুভাকাঙ্ক্ষী। একজন গার্মেন্ট মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাকে বলেছেন, আসলে গজব পড়েছে এই সরকারের ওপর। ক্ষমতায় আসার জন্য আওয়ামী লীগ যেসব অনৈতিক কাজ করেছে, সেসবের প্রতিফল এখন নাজেল হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে আশুলিয়ায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের তীব্র আন্দোলনের মুখে বিজিএমইএ’র কর্মকর্তারা সরকারের একজন মাথার কাছে সমাধান খুঁজতে গিয়েছিলেন। তিনি নাকি তাদের বলেছিলেন, ২০০৬ সালের শেষদিকে আশুলিয়ায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের একশ্রেণীর নেতাদের টাকা দিয়ে লাগাতার বিক্ষোভে উস্কে দিয়েছিলাম। ওদের এখন টাকা দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। বিজিএমইএ’র নেতারা বলেছিলেন, ওদের টাকা দিয়েও তো লাভ হয় না। অন্য জায়গার পয়সাও তো পাচ্ছে। যেহেতু তারা বর্তমান মহাজোট সরকারের অংশীদার, আপনারা বলে দিলে তো ক্ষান্ত হতে পারে। জবাব দিল, সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ তাদের দিয়ে নৈরাজ্য তৈরি করে ইমার্জেন্সি আনতে চেয়েছিল তখন। এখন তাই গার্মেন্ট খাতে কিছু হলেই নাশকতা মনে করে। কিন্তু প্রমাণ করতে পারে না। কেননা দেশবিধ্বংসী তত্পরতা চালিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে আওয়ামী লীগ সর্বদাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির জন্যও একটা রাষ্ট্র কলা-প্রজাতন্ত্র হয়ে যায়। বাংলাদেশ এর ফকফকা উদাহরণ। ভারতের সীমান্তরক্ষীরা আমাদের নাগরিকদের যেভাবে জুলুম করে, ইসরাইলের সেনাবাহিনীও গাজা সীমান্তে ফিলিস্তিনিদের ওপর ততটুকু করে না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তটি এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান রক্তাক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আমেরিকান সাময়িকী ‘ফরেন এফেয়ার্স’ দ্বারা। ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশীদের হত্যাকে হত্যা বলে মানতে নারাজ। অথচ আমরা কোনো প্রতিবাদ করি না। ভারতকে কিছুই না বলে বাংলাদেশের স্বার্থ আদায়ের নীতি কার্যকর হয় না। আসলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র সবল না হলে কূটনীতিও বল পায় না। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতনে গোটা বিশ্ব এখন সোচ্চার, ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয় দানের জন্য জাতিসংঘ এবং ওআইসি ক্রমাগত আহ্বান জানিয়ে চলেছে বাংলাদেশের প্রতি। সেখানে বাংলাদেশ এখন অদ্ভুতভাবে নীরব-নিরুচ্চার। অভিজ্ঞ মহলের মতে, এক্ষেত্রে জাতিসংঘের সনদকে উপেক্ষা করা হছে, বিশ্বজনীন মানবাধিকার সনদকে বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে। এমনকি রামুতে বৌদ্ধদের ওপর সহিংসতা চালাতে দিয়ে সরকার বোঝাতে চেয়েছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা থাকবে না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা সম্প্রতি মিয়ানমার সফরে গিয়ে বলেছেন, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা-পীড়ন বন্ধ করতে হবে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাভাষী মুসলমান হতে পারে বৃহত্তর এথনিক গোষ্ঠী। প্রায় ২০ কোটি। মিয়ানমার ও আসামে তারা নির্যাতিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশ প্রতিবাদ না করতে সতর্ক। আসলে বাংলাভাষী মুসলমানরাই কি বাংলাদেশে ভালো আছে? সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ বাদ দেয়ার পর টুপি-দাড়িওয়ালা মানুষরা রাষ্ট্রীয় পীড়নের শিকার হচ্ছে।
মূলত মিয়ানমারের পরিস্থিতি আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। ১২শ’ বছর আগে থেকে রোহিঙ্গারা সেখানে আছে। আরাকান আমাদেরই অংশ ছিল ব্রিটিশদের দেশ ভাগাভাগির আগে। কিন্তু রাখাইন রাজ্যে বাংলাভাষী রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমার নাগরিক বলে মেনে নেয় না। অং সান সু চির মতো গণতন্ত্রের নেত্রীও তাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অনুপ্রবেশকারী মনে করেন। একই সঙ্গে দেশটির প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন দেশে পাঠানো উচিত। ১৯৮২’র নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী তারা নাগরিক নন, এমনকি ১৩৫টি এথনিক গ্রুপের একটিও নয়। এপি’র সাংবাদিক দল জানিয়েছে, এখন রোহিঙ্গাদের মধ্যে নাগরিকত্বের যে নামকাওয়াস্তে জরিপ চলছে, তাতে জাতিসত্তার কলামটি শূন্য রাখা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ৯০ দশকের প্রথমার্ধে যেসব রোহিঙ্গা অত্যাচারের ভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের অধিকাংশকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়ে প্রমাণ করেছে, তারা তাদেরই নাগরিক। বতর্মান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য সু চির মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছে। গত জুনে এবং অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের ওপর নারকীয় দাঙ্গা হয়েছে। বাংলাদেশের কেউ প্রতিবাদ করেনি। সামরিক শাসনের সময় রোহিঙ্গা-রাখাইন দ্বন্দ্ব অমন সহিংস না হলেও এখন গণতন্ত্রায়নের পর্বে এমন নৃশংসতা ঘটছে কেন? কেন দেশটিজুড়ে রোহিঙ্গাবিরোধী উন্মাদনা ছড়ানো হচ্ছে? মিয়ানমারের সর্বশেষ বিতর্কিত নির্বাচনে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে ‘দি রাখাইন ন্যাশনালিটিজ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (আরএনডিপি)’ ৪৪টির মধ্যে একাই ৩৫টি আসন পেয়েছে। ড. মউংয়ের নেতৃত্বাধীন এ দল মারাত্মকভাবে মুসলিম-বিদ্বেষী। মিয়ানমারের ১৪টি রাজ্য সংসদের মধ্যে কেবল রাখাইনে ক্ষমতাসীন সেনা-সমর্থিত ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হতে পারেনি। রাজনীতির নতুন রসায়নে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার রোহিঙ্গারা।
যদি সিলেট আর নাফ নদীর ওপারে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে বাংলাভাষী মুসলমানরা ক্রমাগত নির্যাতিত হতে থাকে এবং বাংলাভাষী মুসলিমবিদ্বেষী রাজনীতি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তকে উত্তপ্ত করে চলে, তবে বাংলাদেশকে একদিন না একদিন ভূমিকা নিতেই হবে। বাংলাদেশের ভেতরে সব ধর্মাবলম্বীর নিরাপত্তা ও সম্মান দেয়ার ঐতিহ্য বজায় রেখে বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে আমাদের এগোতে হবে। ভাষা আন্দোলনের জন্য বাংলা যখন আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছে, সেই ভাষাভাষীদের মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামে পিছিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। কলা-প্রজাতন্ত্ররূপে বেঁচে থাকা নিরর্থক।
কলা-প্রজাতন্ত্রের বিশ্বস্বীকৃত বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—রাষ্ট্রে যখন গণতন্ত্র নামেমাত্র থাকে, দুঃশাসন-দুর্নীতি চরমে, পার্লামেন্টের সদস্যরা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন (টিআইবির সাম্প্রতিক জরিপে যা স্পষ্ট), সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের দায়িত্ব ভুলে সংসদ সদস্যরা ব্যবসা-বাণিজ্য পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে না, মত প্রকাশের অধিকার ভূলুণ্ঠিত, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ প্রতিকারহীন হয়ে দাঁড়ায়; তখনই তা কলা-প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। এটা ফ্যাসিবাদেরই আরেক রূপ। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো এ মুহূর্তে অনলাইন জরিপের ফলাফল যেভাবে ছাপছে, তাতে এ সমাচার আভাসিত যে, জনমত উপেক্ষা করেই সরকার দেশ চালাচ্ছে এবং কূটনীতিও গণআকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী। বাংলাদেশের দুই সীমান্তে বিএসএফ এবং নাসাকা বাহিনী হত্যা, নির্যাতন ও পুশইনের অমানবিক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। আমরা প্রতিবাদ করি না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্বর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি’র উদ্বেগের সঙ্গে শামিল হই না। আন্তর্জাতিকতা ও মানবিকতার পরিপূরণে বাংলাদেশ ব্যর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্র হিসেবেই দুর্বল হয়ে গেছে। প্রতিটি ইস্যুতেই বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকার চক্রান্তের গন্ধ খুঁজে আপন অস্তিত্বের স্বার্থে রাজনীতি ঘোরাচ্ছে। সরকারের এমনি অমানবিকতা, উদ্যোগহীনতা সার্বিকভাবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে রক্তশূন্য করে তুলেছে। সত্যিকারভাবে নির্বাচিত না হলে একটি সরকার যে খুব দ্রুত স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী হয়ে পড়ে, আওয়ামী লীগের সরকার তার প্রমাণ।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির বর্তমান ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং জিয়া পরিবারকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে কিছু প্রমাণ করতে না পারার ব্যর্থতা সর্বোপরি সরকারের প্রতি গণমানুষের বিপুল ধিক্কারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন-মেজাজ ভালো যাচ্ছে না। গত ২৮ নভেম্বর বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের রাজধানী-কাঁপানো জনসভা মূলত একটি গণঅভ্যুত্থানেরই পদধ্বনি। বেগম জিয়া আন্দোলনের যে কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তাতে হরতাল নেই বরং জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি মুখ্য ছিল। রাজপথ অবরোধ, গণসংযোগ প্রভৃতি কর্মসূচি আন্দোলনের গতানুগতিক রূপরেখা হলেও সময়ের কারণে এ সবই এখন জনগণের কাছে ক্ষোভ প্রকাশের বাহনরূপে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিরোধী দলকে ‘নট নড়ন চড়ন’ অবস্থায় নিয়ে যাওয়াতে সামান্য কর্মসূচি পাওয়া গেলে দলীয় কর্মী এবং উত্সুক জনগণ ভিড় জমায়। মানুষ বা যানবাহনের ওপর হামলার কর্মসূচি নয়। অথচ সেদিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টাঙ্গাইলে এক জনসভায় ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে বসলেন যে, বিরোধী নেত্রী মানুষ মারার কর্মসূচি দিচ্ছে। কিসাস অর্থাত্ হত্যার বদলে হত্যার নীতি ঘোষণাকারী প্রধানমন্ত্রী উল্টো বললেন যে, বেগম জিয়া জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে লাশ চায়।
শনিবার প্রধানমন্ত্রী আরেক জনসভায় হুমকি জারি করলেন যে, জামায়াতের সঙ্গে মিলে রাজনীতি না ছাড়লে বেগম জিয়ার দুর্নীতির বিচার হবে। বেগম জিয়ার দুই সন্তানের বিরুদ্ধে বিষোদগার অব্যাহত রেখে বললেন, তারা বিদেশে বিলাসী জীবন যাপন করছে। নতুন নতুন গাড়ি কিনছে। এসব উক্তি শুধু বানোয়াটই নয়, তীব্র মানহানিকরও বটে। তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান অসুস্থ হয়ে বিদেশে চিকিত্সাধীন—গোটা জাতি এ খবর জানে। তারা যে নিরপরাধ, অপপ্রচারের শিকার—এও সবাই বুঝতে পেরেছেন। জামায়াতের সঙ্গে মিলে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে পাশের চেয়ারে বসে শেখ হাসিনা নব্বইয়ের প্রথমার্ধে যখন বিরোধী নেত্রীর রাজনীতি করছিলেন, তখন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেননি তাকে জামায়াতের সংশ্রব ত্যাগ করার জন্য। কেননা তা হতো গণতান্ত্রিক ঔদার্য এবং রাজনৈতিক শালীনতার পরিপন্থী। কিন্তু শেখ হাসিনা অবলীলায় তা বলে দিলেন। জামায়াতে ইসলামী আইন দ্বারা নিবন্ধিত দল এবং সংসদেও তার প্রতিনিধিত্ব আছে। বিএনপি কার সঙ্গে জোট বাঁধবে, সেটা তো সরকারপ্রধান নির্ধারণ করতে পারে না। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কয়েকজনের বিচার হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর বিচার হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধের বিচার ত্বরান্বিত বা বিলম্বিত করার ক্ষমতার জানান দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভায় যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতেই বিচার প্রক্রিয়ায় সরকারের নিয়ন্ত্রণের চিত্র পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।
এসব কথার অবতারণা এজন্য যে, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করা বাংলাদেশ এখন অসভ্য রাষ্ট্র বনে যাচ্ছে। বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে না দেয়া, ক্রসফায়ার-গুমে নেপথ্য-উত্সাহ দেয়া, সাংবাদিক-হত্যায় নিশ্চুপ থাকা, ভিন্নমতের অসহনীয় দলন, আইন রক্ষাকারীদের সরকারের রক্ষাকারী হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো এখন প্রতিদিনের। জনগণের দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রতিদিন নানা নাগরিক সমস্যায়। কিন্তু সরকার নির্বিকার।
কলা প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হলো, সরকার তাদের একান্ত অনুগতদের স্বার্থ রক্ষা করে তাদের সব সুবিধা দিতে চায়। সেখানে গোল্লায় যায় যুক্তি এবং শৃঙ্খলা। শেয়ারবাজারে লক্ষ-কোটি টাকা আত্মসাত্কারীদের বিচার হলো না। অথচ জনগণের কাছে লুটেরাকুল চিহ্নিত। হলমার্ক, ডেসটিনি সব লুটপাটের ঘটনায় জড়িত সরকারপ্রধানের উপদেষ্টারা। পদ্মা সেতুর ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ সরকারি অস্বীকারে প্রথমে পাত্তা না পেলেও এখন দুদকই স্বীকারোক্তি দিচ্ছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পরিবারের কেউ জড়িত কিনা, আমরা জানি না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনা থেকেই যখন বলে দিয়েছিলেন যে, জাতির জনকের পরিবার সম্পর্কিত আইনে স্বীকৃত সদস্যরা কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয়, তখন প্রশ্ন উঠেছিল, তাহলে কি এমন কোনো আত্মীয় আছেন, যারা ওই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত? পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিতর্কিত পরামর্শক এসএনসি লাভালিন কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি নিক্সন চৌধুরী কার আত্মীয়?
এ সরকারের আমলে কোনো তদন্ত এগোতে চায় না, যদি তাতে সরকারের ঘনিষ্ঠ কেউ থাকে। এ করেই পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত হয়ে গেল। তাজরীন ফ্যাশনে আগুন লেগে ১১১ জন মরল, চট্টগ্রামে অপ্রয়োজনীয় উড়াল সেতুর গার্ডার ভেঙে ২০ জনের বেশি মারা গেল। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মহানগর আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক তাই তাকে ধরা যাবে না। তাজরীনের মালিককে পুলিশ গ্রেফতার তো দূরের কথা, ডেকেও জিজ্ঞেস করে না। তিনি তার ইচ্ছামত মিডিয়ার সামনে আসেন। মিডিয়াও খুঁজতে চায় না। তিনি বেতন দেননি, কিন্তু সরকার তাকে চাপ দেয় না। শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ, কিন্তু সরকারের তাতে কী? পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করছে। সামরিক জান্তার আমলে মিয়ানমারে পুলিশ একবার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বেধড়ক মেরেছিল। ক’দিন আগে টিভিতে দেখলাম সেই ঘটনার জন্য পুলিশ বৌদ্ধ ভিক্ষুকের পা মুছে ক্ষমা চাচ্ছে। কবে যে বাংলাদেশে এমন দেখব, জানি না। তাজরীনের মালিক নাকি আওয়ামী লীগের পেশিশক্তিবহুল এক নেতার শুভাকাঙ্ক্ষী। একজন গার্মেন্ট মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাকে বলেছেন, আসলে গজব পড়েছে এই সরকারের ওপর। ক্ষমতায় আসার জন্য আওয়ামী লীগ যেসব অনৈতিক কাজ করেছে, সেসবের প্রতিফল এখন নাজেল হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে আশুলিয়ায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের তীব্র আন্দোলনের মুখে বিজিএমইএ’র কর্মকর্তারা সরকারের একজন মাথার কাছে সমাধান খুঁজতে গিয়েছিলেন। তিনি নাকি তাদের বলেছিলেন, ২০০৬ সালের শেষদিকে আশুলিয়ায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের একশ্রেণীর নেতাদের টাকা দিয়ে লাগাতার বিক্ষোভে উস্কে দিয়েছিলাম। ওদের এখন টাকা দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। বিজিএমইএ’র নেতারা বলেছিলেন, ওদের টাকা দিয়েও তো লাভ হয় না। অন্য জায়গার পয়সাও তো পাচ্ছে। যেহেতু তারা বর্তমান মহাজোট সরকারের অংশীদার, আপনারা বলে দিলে তো ক্ষান্ত হতে পারে। জবাব দিল, সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ তাদের দিয়ে নৈরাজ্য তৈরি করে ইমার্জেন্সি আনতে চেয়েছিল তখন। এখন তাই গার্মেন্ট খাতে কিছু হলেই নাশকতা মনে করে। কিন্তু প্রমাণ করতে পারে না। কেননা দেশবিধ্বংসী তত্পরতা চালিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে আওয়ামী লীগ সর্বদাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির জন্যও একটা রাষ্ট্র কলা-প্রজাতন্ত্র হয়ে যায়। বাংলাদেশ এর ফকফকা উদাহরণ। ভারতের সীমান্তরক্ষীরা আমাদের নাগরিকদের যেভাবে জুলুম করে, ইসরাইলের সেনাবাহিনীও গাজা সীমান্তে ফিলিস্তিনিদের ওপর ততটুকু করে না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তটি এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান রক্তাক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আমেরিকান সাময়িকী ‘ফরেন এফেয়ার্স’ দ্বারা। ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশীদের হত্যাকে হত্যা বলে মানতে নারাজ। অথচ আমরা কোনো প্রতিবাদ করি না। ভারতকে কিছুই না বলে বাংলাদেশের স্বার্থ আদায়ের নীতি কার্যকর হয় না। আসলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র সবল না হলে কূটনীতিও বল পায় না। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতনে গোটা বিশ্ব এখন সোচ্চার, ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয় দানের জন্য জাতিসংঘ এবং ওআইসি ক্রমাগত আহ্বান জানিয়ে চলেছে বাংলাদেশের প্রতি। সেখানে বাংলাদেশ এখন অদ্ভুতভাবে নীরব-নিরুচ্চার। অভিজ্ঞ মহলের মতে, এক্ষেত্রে জাতিসংঘের সনদকে উপেক্ষা করা হছে, বিশ্বজনীন মানবাধিকার সনদকে বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে। এমনকি রামুতে বৌদ্ধদের ওপর সহিংসতা চালাতে দিয়ে সরকার বোঝাতে চেয়েছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা থাকবে না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা সম্প্রতি মিয়ানমার সফরে গিয়ে বলেছেন, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা-পীড়ন বন্ধ করতে হবে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাভাষী মুসলমান হতে পারে বৃহত্তর এথনিক গোষ্ঠী। প্রায় ২০ কোটি। মিয়ানমার ও আসামে তারা নির্যাতিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশ প্রতিবাদ না করতে সতর্ক। আসলে বাংলাভাষী মুসলমানরাই কি বাংলাদেশে ভালো আছে? সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ বাদ দেয়ার পর টুপি-দাড়িওয়ালা মানুষরা রাষ্ট্রীয় পীড়নের শিকার হচ্ছে।
মূলত মিয়ানমারের পরিস্থিতি আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। ১২শ’ বছর আগে থেকে রোহিঙ্গারা সেখানে আছে। আরাকান আমাদেরই অংশ ছিল ব্রিটিশদের দেশ ভাগাভাগির আগে। কিন্তু রাখাইন রাজ্যে বাংলাভাষী রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমার নাগরিক বলে মেনে নেয় না। অং সান সু চির মতো গণতন্ত্রের নেত্রীও তাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অনুপ্রবেশকারী মনে করেন। একই সঙ্গে দেশটির প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন দেশে পাঠানো উচিত। ১৯৮২’র নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী তারা নাগরিক নন, এমনকি ১৩৫টি এথনিক গ্রুপের একটিও নয়। এপি’র সাংবাদিক দল জানিয়েছে, এখন রোহিঙ্গাদের মধ্যে নাগরিকত্বের যে নামকাওয়াস্তে জরিপ চলছে, তাতে জাতিসত্তার কলামটি শূন্য রাখা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ৯০ দশকের প্রথমার্ধে যেসব রোহিঙ্গা অত্যাচারের ভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের অধিকাংশকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়ে প্রমাণ করেছে, তারা তাদেরই নাগরিক। বতর্মান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য সু চির মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছে। গত জুনে এবং অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের ওপর নারকীয় দাঙ্গা হয়েছে। বাংলাদেশের কেউ প্রতিবাদ করেনি। সামরিক শাসনের সময় রোহিঙ্গা-রাখাইন দ্বন্দ্ব অমন সহিংস না হলেও এখন গণতন্ত্রায়নের পর্বে এমন নৃশংসতা ঘটছে কেন? কেন দেশটিজুড়ে রোহিঙ্গাবিরোধী উন্মাদনা ছড়ানো হচ্ছে? মিয়ানমারের সর্বশেষ বিতর্কিত নির্বাচনে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে ‘দি রাখাইন ন্যাশনালিটিজ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (আরএনডিপি)’ ৪৪টির মধ্যে একাই ৩৫টি আসন পেয়েছে। ড. মউংয়ের নেতৃত্বাধীন এ দল মারাত্মকভাবে মুসলিম-বিদ্বেষী। মিয়ানমারের ১৪টি রাজ্য সংসদের মধ্যে কেবল রাখাইনে ক্ষমতাসীন সেনা-সমর্থিত ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হতে পারেনি। রাজনীতির নতুন রসায়নে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার রোহিঙ্গারা।
যদি সিলেট আর নাফ নদীর ওপারে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে বাংলাভাষী মুসলমানরা ক্রমাগত নির্যাতিত হতে থাকে এবং বাংলাভাষী মুসলিমবিদ্বেষী রাজনীতি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তকে উত্তপ্ত করে চলে, তবে বাংলাদেশকে একদিন না একদিন ভূমিকা নিতেই হবে। বাংলাদেশের ভেতরে সব ধর্মাবলম্বীর নিরাপত্তা ও সম্মান দেয়ার ঐতিহ্য বজায় রেখে বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে আমাদের এগোতে হবে। ভাষা আন্দোলনের জন্য বাংলা যখন আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছে, সেই ভাষাভাষীদের মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামে পিছিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। কলা-প্রজাতন্ত্ররূপে বেঁচে থাকা নিরর্থক।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন