বৃহস্পতিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১২

বাংলাদেশের কপালে আবার দুর্নীতির কলঙ্ক তিলক



সৈয়দ আবদাল আহমদ



ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। বিজয়ের মাসে তাই আমরা স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেলিত থাকি। কিন্তু ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকারের অপকর্মের ফল হিসেবে এবার বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের কপালে জুটেছে আবার দুর্নীতির সেই কলঙ্ক তিলক। এই দুর্নীতির কলঙ্ক আমাদের বিজয়ের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে।
গতকাল ঢাকার প্রভাতী দৈনিকগুলোতে বাংলাদেশের দুর্নীতির খবরই ছিল বড় বড় শিরোনাম। বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ২৪ ধাপ নেমে গেছে। একই দিন দুর্নীতির আরেকটি খবর গণমাধ্যমে সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। সেটি হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে দুদকের আলোচনা ভেঙে গেছে। দুদক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত প্রধান ব্যক্তি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পক্ষ নিয়েছে। তাকে বাদ দিয়ে মামলা করার দুদকের সুপারিশে সম্মত হয়নি বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক প্যানেল। আলোচনা ভেঙে দিয়ে বিশ্বব্যাংক প্যানেল বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে। এর ফলে অনিশ্চিত হয়ে গেছে পদ্মা সেতু প্রকল্প । পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন সম্ভবত আর হচ্ছে না।
বাংলাদেশে দুর্নীতি বর্তমানে যে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে, বুধবার প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টই তার প্রমাণ। রিপোর্ট প্রকাশ করে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল বলেন, দুর্নীতি এখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করেছে। দেশের অগ্রগতিকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, দুর্নীতিতে বাংলাদেশের স্কোর এক পয়েন্ট কমেছে এবং অবস্থান ২৪ ধাপ নেমেছে। কাজেই একথা বলা যায় যে, দুর্নীতির মাত্রা অনেক বেড়েছে। রিপোর্টটিতে বলা হয়, দুর্নীতির ক্ষেত্রে গত এক বছরে বাংলাদেশের ২৪ ধাপ অবনতি হয়েছে। গত বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বিশ্বের ১৮৩টি দেশের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০ নম্বরে। আর এবার ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪তম। আবার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশের মধ্যে ৫টির অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। অবনতি হয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের। এর মধ্যে পাকিস্তানের অবনতি ৫ ধাপ আর বাংলাদেশের ২৪ ধাপ। দুর্নীতিতে এবার বাংলাদেশের স্কোর কমেছে এক পয়েন্ট। গত বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৭, এবারের স্কোর ২৬। স্কোর কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২০ থেকে কমে ১৪৪-এ এসেছে।
দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে টিআইবি বলছে, ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি, রেলওয়ের নিয়োগ-বাণিজ্য ও দুর্নীতি, শেয়ারবাজার লুটপাট, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, দখল, ক্ষমতাসীনদের সম্পদের হিসাব না দেয়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ক্ষমতা খর্ব, দুদকের বিতর্কিত অবস্থান, ফৌজদারি ও দুর্নীতির মামলা ঢালাওভাবে প্রত্যাহার ইত্যাদি ঘটনা বাংলাদেশে দুর্নীতিকে উদ্বেগজনক অবস্থায় নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে টিআইবির চেয়ারপার্সন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের মন্তব্য হচ্ছে—দুর্নীতি, অনিয়ম, অবিচারের কারণে দরিদ্র মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ সম্পর্কে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে দুদকের অবস্থানে সরকারের অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। প্রশাসন রাজনীতিকীকরণ, কালো টাকা সাদা করার অব্যাহত সুযোগদান, দুর্বলতর সরকারি ক্রয় নীতিমালা দুর্নীতিকে উত্সাহিত করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির ধারণা সূচক তৈরিতে জরিপে ১৩টি আন্তর্জাতিক জরিপ থেকে তথ্য নিয়েছে। বাংলাদেশের বেলায় যে সাতটি সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে সেগুলো হচ্ছে—বার্টলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, গ্লোবাল ইনসাইড কান্ট্রি রিস্ক রেটিং, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পারফরমেন্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে এবং ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স। তথ্যের সময়কাল ছিল জানুয়ারি ২০১১ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১২ পর্যন্ত। দুর্নীতি ও ঘুষের প্রবণতা, সরকারি তহবিল আত্মসাত্, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় অবৈধ অর্থ সংগ্রহ—এ ধরনের দুর্নীতি বাংলাদেশে বেশি। টিআই মনে করে, দুর্নীতি হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বেআইনি কাজ। এটি বৈশ্বিক সমস্যা। তবে বাংলাদেশে এ সমস্যাটি বাড়ছেই।
কিছুদিন আগে টিআইবি সংসদ সদস্যদের ওপর একটি গবেষণা জরিপ প্রকাশ করেছিল। ওই জরিপে বলা হয়, বর্তমান সংসদের ৯৩ শতাংশ এমপিই দুর্নীতি তথা অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। এবারের সংসদে যেহেতু প্রায় পুরোটাই সরকারি দলের এমপি, সে কারণে টিআইবির জরিপ তাদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। শুধু মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি দলের নেতারাই নন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ জরিপে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, টিআইবির এই জরিপ উদ্দেশ্যমূলক ও অনির্বাচিত ব্যক্তিদের ক্ষমতায় বসানোর ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। মানুষ কখন রিঅ্যাক্ট করে, যখন কেউ তার দুর্বল জায়গায় আঘাত করে। যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকার দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এবং ওই খবর জানাজানি হয়ে যাচ্ছে, তাই জড়িতরা রিঅ্যাক্ট করছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের সভা-সমাবেশে বক্তৃতার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে তাদের মুখে এখন চুরি, দুর্নীতি, কমিশন খাওয়া, ঘুষ, কালো টাকার কথাই বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, তারা ওইগুলো চর্চা করছেন। তাই তাদের খবরটি যাতে বাইরে বেরিয়ে না পড়ে সেজন্য ভয় থেকেই অন্যের দুর্নীতি-অনিয়মের কথাগুলো বেশি করে বলছেন। একই কুমির ছানা বার বার প্রদর্শন করছেন।
বর্তমানে টিআইবির চেয়ারপার্সন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই বান্ধবী হিসেবে পরিচিত এবং প্রায় একই রাজনীতির সমর্থক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। কিন্তু তিনি এ পদে থেকেও টিআই-এর দুর্নীতির প্রতিবেদন থেকে শেখ হাসিনা সরকারকে রক্ষা করতে পারেননি। দুর্নীতির মাত্রা কোন পর্যায়ে গেলে এমন অবস্থা হয় তা সহজেই বোঝা যায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালে গ্লোবাল রিপোর্ট প্রকাশকালে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গুরুত্বের সঙ্গেই বললেন, এখন হাই-প্রোফাইল দুর্নীতি হচ্ছে।
শেখ হাসিনা সরকারের এই হাই-প্রোফাইল দুর্নীতিরই একটি হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি। গত প্রায় এক বছর ধরে এই দুর্নীতি নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের অর্থায়ন বাতিল করে দিয়েছে। এই দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী মাতামাতি হচ্ছে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দিতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। ছুটিতে যেতে হয়েছে সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেনসহ বেশ কয়েক কর্মকর্তাকে। অবশেষে সরকার নাকে খত দিয়ে জানায় যে, দুদকের মাধ্যমে পদ্মা সেতু দুর্নীতির তদন্ত হবে এবং এই তদন্তে বিশ্বব্যাংক প্যানেল তদারকি করতে পারবে। সরকার বিশেষ দূত পাঠিয়ে (পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে) বিশ্বব্যাংককে পুণরায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের অনুরোধ জানায়। তবে তারা তদন্ত পরিস্থিতি দেখে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানায়। বিশ্বব্যাংক দুদককে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে। তদন্ত শুরু হয়। বিশ্বব্যাংক প্যানেল দু’দফায় বাংলাদেশ সফর করে এবং দুদকের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে। কিন্তু সবশেষে যা দেখা যাচ্ছে, দুদক সরকারের কথার বাইরে যেতে পারছে না। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির তদন্ত তারা স্বাধীনভাবে করেনি। সরকার যেভাবে বলছে, সেভাবে করছে। অর্থাত্ সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় নিক্সন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে দুর্নীতির মামলা থেকে বাইরে রাখছে। এ অবস্থা মেনে নেয়নি বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল। দুদকের সঙ্গে আলোচনা ভেঙে দিয়ে তারা বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে। সরাসরি কিছু না বললেও দুদক থেকে বেরিয়ে বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো সাংবাদিকের বলেন, ‘দুদকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। তাদের ধন্যবাদ। আমরা চলে যাচ্ছি, আমরা এখন এয়ারপোর্টে যাচ্ছি।’ এভাবে বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার বিষয়টি আমরা কীভাবে দেখব? হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা যাবে আমরা বিশ্বব্যাংকের একটি বিবৃতি পেয়েছি। সেখানে হয়তো বলা হতে পারে, দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় বিশ্বব্যাংককে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে ইত্যাদি।
প্রশ্ন হচ্ছে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে সরকারের এমন কি দুর্বলতা? এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে সার্টিফিকেট দেন। দুদক তাকে সার্টিফিকেট দেয় একজন দুর্নীতিমুক্ত অর্থাত্ ‘সত্ মানুষ’ হিসেবে। দুর্নীতির মামলায় জড়ানো হলে তিনি কি আসল কথা ফাঁস করে দেবেন? থলের বিড়াল কি বেরিয়ে যাবে? অনেকেরই সন্দেহ, এই দুর্নীতির সঙ্গে রাঘব বোয়াল জড়িত। আবুল হোসেন মামলায় পড়লে কোর্টে তিনি বিপদে পড়ে সেই নাম ফাঁস করে দিতে পারেন। তাই তাকে মামলায় জড়ানো যাবে না। রিপোর্টাররা যতটুকু জানতে পেরেছেন তা হচ্ছে, দুদক সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ অভিযোগপত্রে অন্তত ১০ জনের তালিকা দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় তা ভণ্ডুল হয়ে গেছে। নখদন্তহীন দুদকের চেয়ারম্যান বেচারা গোলাম রহমানকে সাংবাদিকদের বলতে হয়েছে—বাংলাদেশের আইনে যা সিদ্ধান্ত নেয়ার তা দুদকই নেবে। এ কথাও শোনা গিয়েছিল যে, এত চাপ সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান পদত্যাগও করতে পারেন। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, তদন্তে দুদক যা কিছু পেয়েছে তা যেন জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেয়। কিন্তু দুদক তা প্রকাশ করবে বলে মনে হয় না।
দুর্নীতির খবর এখন বাংলাদেশের দৈনিকগুলোর নিত্যদিনের নিউজ আইটেম। দুর্নীতির খবর ছাড়া কোনো পত্রিকা বের হচ্ছে না। কোনো পত্রিকায় মন্ত্রীর দুর্নীতির খবর, কোনোটিতে এমপি বা সরকারি দলের নেতার দুর্নীতির খবর—দুর্নীতির শেকড় শীর্ষ পর্যায় থেকে নিম্নস্তরে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ছোটখাটো দুর্নীতি এখন গা-সওয়া ব্যাপার হয়ে গেছে। বর্তমান দুর্নীতি হচ্ছে বড় স্কেলে, যা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ইফতেখারুজ্জামানের ভাষায় ‘হাইপ্রোফাইল দুর্নীতি’।
রেলের দুর্নীতির জন্য মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে রেল মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। অদৃশ্য চাপে তার মন্ত্রিত্ব থাকলেও (দফতরবিহীন মন্ত্রী) সেটা কোনো কাজে আসছে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাছ থেকে সবাই এখন চৌদ্দ মাইল দূরে থাকে। রেলের কালো বিড়াল খুঁজতে গিয়ে নিয়োগবাণিজ্যের সোনার খনি পেয়েছিলেন তিনি। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী সেখান থেকে বেশ কয়েক কোটি টাকা হাতানোর সুযোগ হয় তার। কিন্তু এপিসের ড্রাইভারের কারণে মওকা আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি তিনি। সবকিছু ফাঁস হয়ে যায়, যখন ৭৫ লাখ টাকার বস্তাসহ এপিএস ও রেলের জিএম ধরা পড়েন পিলখানা গেটে। টাকার বস্তাটি তারা নিয়ে যাচ্ছিলেন মন্ত্রী সুরঞ্জিতের বাসায়। সেই ড্রাইভার আরটিভিতে সাক্ষাত্কার দিয়ে বলেছে, এ ধরনের টাকার বস্তা আরও কয়েকবার গেছে সুরঞ্জিতের বাসায়। রেলের ঘুষের টাকা ছেলে সৌমেনের টেলিকম ব্যবসায় বিনিয়োগ হয়েছে।
রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল দুর্নীতিও ক্ষমতাসীনদের বড় স্কেলের দুর্নীতি। এ দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে বলে পত্র-পত্রিকায় অনেক রিপোর্ট হয়েছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে দুর্নীতির জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বিদ্যুত্ কিনছে সরকার। এতে প্রতি বছর সরকারকে ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে। সঞ্চয় হারিয়ে ৩৩ কোটি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর এখন একমাত্র সম্বল চোখের পানি। টেলিফোন খাতে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে। অবৈধ ভিত্তআইপির দুর্নীতির ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। সরকার টেলিকমিউনিকেশন গেটওয়ে লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রেও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। এ টেলিকম ব্যবসাও পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রী কিংবা আত্মীয়রা। সরকার সম্প্রতি ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে। একেকটি ব্যাংকে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে ৪০০ কোটি টাকা। ক্ষমতাসীন দলের সব পরিচিত মুখই এই ব্যাংক পেয়েছে। এখানেও বড় দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। দ্য ফারমারস ব্যাংক নামে একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে থেকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্বও পালন করছেন ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। একডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেলিভিশন দেয়ার ক্ষেত্রেও নেপথ্যে রয়েছে বড় অঙ্কের দুর্নীতি। বিদ্যুত্ পাচ্ছে না মানুষ, কিন্তু খুঁটির ব্যবসা জমজমাট। ১০ লাখ খুঁটি কেনা হয়েছে; আরও ১৫ লাখ খুঁটি কেনা হচ্ছে। এখানেও লেনদেন হচ্ছে ঘুষের টাকা। সোনালী ব্যাংকের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর নাম আসছে। ডেসটিনির ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতি ও আত্মসাতের সঙ্গেও জড়িত ক্ষমতাসীনরা। ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল হারুনসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে এ দুর্নীতির মামলা চলছে। ক্ষমতাসীনরা এখন জেনারেল হারুনকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোতে চলছে নিয়োগবাণিজ্য। পদোন্নতি-বদলির ক্ষেত্রেও চলছে ঘুষ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এবং বিশ্বব্যাংকে দেয়া দুর্নীতির খবরই নয়; বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন চলছে, সহসাই কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বাংলাদেশের বড় দুর্নীতির খবর আসতে পারে এবং তা আবার তোলপাড় সৃষ্টি করতে পারে। দুর্নীতির কারণে বিদেশি বিনিয়োগ একেবারেই আসছে না। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীও এ কথা উচ্চারণ করেছেন। তিনি ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্নীতির কারণে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বিশেষায়িত মার্কিন তহবিল মিলেনিয়াম সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কয়েক মাস আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৯ জন রাষ্ট্রদূত সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রীকেও বাংলাদেশ সফরে এসে দুর্নীতির খারাপ ধারণা নিয়ে ফিরতে হয়েছে। বুধবার বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে একজন ব্রিটিশ বিনিয়োগকারী বলেন, বাংলাদেশের বড় বড় দুর্নীতির খবরে সেদেশে বিনিয়োগ করতে আমরা ভরসা পাচ্ছি না।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে, তার পাঁচ অগ্রাধিকারের অন্যতম ছিল দুর্নীতি দমন। সেখানে বলা হয়েছিল, দুদকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে একে শক্তিশালী করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণী দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি, উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ এবং নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের গত চার বছরের শাসনামলে দুর্নীতির কলঙ্ক বাংলাদেশের ইমেজকে তলানিতে নিয়ে গেছে। দুর্নীতি ও আওয়ামী লীগ অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। প্রতিশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ যেসব বিষয় করবে না বলে অঙ্গীকার করেছে, সেগুলো বেশি করে করেছে; যেমন ঘুষ, দুর্নীতি, উচ্ছেদ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও কালোটাকার অঙ্গীকার। শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের শেষ বছরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে এক নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সেই দুর্নীতির কলঙ্ক তিলক এবারও জুটেছে। সর্বত্রই আলোচনার বিষয় এখন ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads