বুধবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১২

প্রয়োজন আইনের শাসন



গত ২৫ নবেম্বর দিবাগত রাত। আশুলিয়া থেকে বহদ্দারহাট। রাজধানী ঢাকার আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশন গার্মেন্টসে ভয়াবহ আগুন লাগে এবং প্রায় একই সময়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের ৩টি গার্ডার ভেঙ্গে পড়েছে। আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টসে ১২৪ জন শ্রমিক আর বহদ্দারহাটে গার্ডারে চাপা পড়ে ২২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে দেশ-বিদেশের মিডিয়াগুলোর প্রধান শিরোনাম ছিল, তৈরি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে একশ' চবিবশ জন শ্রমিকের করুণ মৃত্যু। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আর কতো পোশাক শ্রমিককে, আর কতো অসহায় মানুষকে এভাবে মৃত্যুর কাফেলায় শামিল হতে হবে? এসব অনাহুত মৃত্যুর দায় কি সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ-মালিক এবং সরকার এড়িয়ে যেতে পারেন?
আমাদের প্রশ্ন, ফ্লাইওভারের বহু টন ওজনের গার্ডার কীভাবে ভেঙ্গে পড়ে? ফ্লাইওভারটি নির্মাণে যে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ নিয়েছে, তারা কি জানতো না যে নিচ দিয়ে অবিরত মানুষ চলাচল করে? নির্মাণের সময় শত শত টন ওজনের গার্ডার ভেঙ্গে পড়ে কীভাবে? মোটা অংকের কমিশনের বিনিময়ে নাকি উপযুক্ত নির্মাণ সংস্থাকে কাজটি দেয়া হয়েছিল? কোথায় সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান? ব্যাপক জনমতের চাপে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, সে ভালো কথা। ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হওয়া যাবে। কিন্তু এতোগুলো মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া হলো, তাদের ফিরিয়ে দেবে কে? এসব তো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। এসব নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। এগুলো কি এড়ানো যেতো না? আমরা যদি বলি আওয়ামী সরকারের চার বছরের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অবহেলা, কমিশন, ঘুষ-দুর্নীতি, সর্বক্ষেত্রে দলবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, লুটপাট এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের নজরদারির অভাবেই এক সাথে এতো মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী? তা মোটেও ভুল হবে না। চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের মান নিয়ে আগেও বহু অভিযোগ উঠেছিল। এর আগেও সেখানে জুন মাসে একবার গার্ডার ভেঙ্গে পড়েছিল। ভাগ্য ভালো, সেখানে তখন লোক চলাচল কম থাকায় আরও বড় কোন ঘটনা ঘটেনি। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সততা, কর্মদক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে তখন চট্টগ্রাম ও ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলো বিস্তর লিখেছে। তাতে কোনো তোয়াক্কা করেনি সরকার ও তার সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
আমাদের দেশে পোশাক কারখানাগুলোতে আগুনে পুড়ে শ্রমিকদের মরার ঘটনাও নতুন নয়। এর আগেও বহুবার আগুন লেগেছে। শ্রমিকরা আগুনে পুড়ে পুড়ে কয়লা হওয়ার করুণ দৃশ্য দেশবাসী মাঝেমধ্যেই দেখেছেন। এবার সাভার আশুলিয়া তাজরিন গার্মেন্টসে আগুন লাগার ঘটনায় আমরা সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে যা দেখলাম তাতে অবরুদ্ধ হয়ে পুড়ে যাওয়া অসহায় মানুষগুলো অঙ্গার হওয়ার আগে মোবাইল ফোনে তাদের করুণ পরিণতির কথা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে জানিয়েছে। অনেকে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেছে, গার্মেন্টসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও মালিকপক্ষ আগুন লাগার সাথে সাথেই সবগুলো গেট বন্ধ করে দ্রুত সটকে গেছে। তাৎক্ষণিক উদ্ধারে সচেষ্ট থাকলে হয়তো দুর্ঘটনার মাত্রা অনেক কম হতো। ঐ গার্মেন্টসে অগ্নি নির্বাপণের পর্যাপ্ততা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ দায় কার? সরকার ও তার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা এ দায় এড়াতে পারেন না।
আমরা কেন আজ কোথাও নিরাপদ নই? বর্তমান সরকারের আমলে সারাদেশের মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু কেন আজ অস্বাভাবিক? ঘরেও না, বাইরেও না। নিজের ঘরে থাকবেন, ঘুমাবেন? সাংবাদিক সাগর-রুনী অথবা ফরহাদ খাঁ দম্পতিদের মতো শোবার ঘরে খুন হবেন! রাস্তায় বের হবেন? বিএনপি নেতা ইলিয়াছ আলী কিংবা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী ছাত্রের মতো গুম হবেন; যে কোনো সময় হুড়মুড় করে আপনার ওপরই ভেঙ্গে পড়তে পারে ফ্লাইওভারের শত শত টন ওজনের গার্ডার কিংবা যান্ত্রিক দানব বাস-ট্রাকে চাপা দিয়ে কেড়ে নিতে পারে আপনার প্রাণ।
সত্যিই আজ মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুই যেন অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ট্রাজেডি আর ঢাকার আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টসের ভয়াবহ আগুন আমাদের সবাইকে সারাদেশের মানুষকে অশান্ত করে তুলেছে। শত শত পরিবারকে তছনছ করে দিয়েছে। অনিশ্চিত করে দিয়েছে হাজারো পরিবারের ভবিষ্যৎকে। সে কী এক ভয়াবহ দৃশ্য।
আমরা সবাই জানি, মানুষের মৃত্যু অমোঘ। কিন্তু তরতাজা, হৃষ্টপুষ্ট মানুষ হঠাৎ এভাবে থেতলে, রক্তাক্ত হয়ে; গেট বদ্ধ গার্মেন্টসের ভেতরে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে কয়লাখন্ড হয়ে? এটা সত্য, সরকার ও তার প্রশাসন আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশব্যাপী কেবল অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকার সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ করতে পারলে; নিয়মতান্ত্রিকভাবে সবকিছু পরিচালনা করতে পারলে অনেকাংশেই এসব দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতে পারে। আজ গোটা দেশেই মানুষরূপী হায়েনাদের নানা গ্যাঁড়াকলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারোই কাম্য নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads