রাজনৈতিক ভাষ্যকার : ব্যর্থতা ও অপকর্মের বিশাল পাহাড়ের চাপেই কি না সেটা একটি বড় প্রশ্ন বটে, তবে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা কান্ডজ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন। এ ব্যাপারে মন্ত্রীরাই যথারীতি সবার সামনে রয়েছেন। অসংখ্য উদাহরণের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে গত ১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের সমাবেশে দেয়া তার একটি উপদেশেরই উল্লেখ করা যাক। উপদেশটি সরকারের শীর্ষ স্থান থেকে বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে ‘খয়রাত' করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জামায়াত-শিবিরের ‘সঙ্গ' ছাড়ুন। তার মতে এটাই নাকি জনগণের ‘মনের আওয়াজ'! শুভাকাঙিক্ষর ঢঙে তিনি বলেছেন, জামায়াত-শিবিরের ‘সঙ্গ' ত্যাগ করলেই নাকি জনগণের মনে বেগম জিয়ার জন্য ‘একটু' হলেও জায়গা' হতে পারে! বেগম জিয়া যদি জামায়াত-শিবিরের ‘সঙ্গ' ত্যাগ না করেন তাহলে তার দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচার করা হবে বলেও হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থাৎ জামায়াত-শিবির এতটাই ‘খারাপ' যে, তাদের সঙ্গ ত্যাগের বিনিময়ে বেগম জিয়ার কথিত এবং এ পর্যন্ত অপ্রমাণিত দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচারও পরিত্যাগ করতে রাজি আছেন প্রধানমন্ত্রী! প্রসঙ্গক্রমে নিজেদের মহা এক আবিষ্কারের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। চর্বিত চর্বন করতে গিয়ে বলেছেন, কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানাচাল করতেই বেগম জিয়া নাকি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন!
আরো অনেক কথাই বলা হয়েছে। নিজের সরকারের বানোয়াট সাফল্যের হাস্যকর দীর্ঘ ফিরিস্তিও তুলে ধরেছেন তিনি। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তার কান্ডজ্ঞান সম্পর্কিত আলোচনা। প্রশ্ন উঠেছে, অন্য কোনো দলের- তাও আবার বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দলের করণীয় সম্পর্কে উপদেশ দেয়ার কোনো অধিকার শেখ হাসিনার থাকতে পারে কি না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য কষেই জবাব দিয়েছেন। ৩ ডিসেম্বর তিনি তাদেরকে নিজের চরকায় তেল দেয়ার পাল্টা উপদেশ দিয়ে বলেছেন, বিএনপি কি করবে না করবে, কার সঙ্গে থাকবে বা থাকবে না এবং কিভাবে চলবে এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের বলার কিছুই থাকতে পারে না। তিনি যেহেতু আওয়ামী লীগের সভানেত্রী সেহেতু তার উচিত আওয়ামী লীগের ভালোমন্দ নিয়ে মাথা ঘামানো। বিএনপির জন্য বেগম খালেদা জিয়াই যথেষ্ট। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে পরিচালিত আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগও যে জামায়াতে ইসলামীকে ‘সঙ্গে' রেখেছিল সে কথাও বিশেষ জোর দিয়েই উল্লেখ করেছেন মির্জা আলমগীর। তিনি সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বিএনপির এবং চার দলীয় জোট সরকারের আমলে বিজয়ের মাসে আওয়ামী লীগ এমনকি হরতালও করেছে। তাছাড়া ডিসেম্বর শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাস নয়, আন্দোলন-সংগ্রামের মাসও। ১৯৯০ সালের এই ডিসেম্বরেই বর্তমান আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান পার্টনার স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পতন ঘটানো হয়েছিল। গণতন্ত্রের জন্য প্রায় দশকব্যাপী পরিচালিত সে আন্দোলনেও জামায়াতে ইসলামী ‘সঙ্গে'ই ছিল- বিএনপির ‘সঙ্গে' যেমন ছিল তেমনি ছিল আওয়ামী লীগের ‘সঙ্গে'ও। সুতরাং এবারের ডিসেম্বরে জামায়াতকে ‘সঙ্গে' নিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে কোনো দোষ বা অন্যায়ই করেননি বেগম খালেদা জিয়া।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাস্তবে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সফল এবং প্রধান প্রতিদ্বনদ্বী দল বিএনপির জন্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ‘দরদ' উথলে ওঠার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বিএনপির ‘শুভ' চান বলেও তিনি জামায়াত-শিবিরের সঙ্গ ত্যাগ করার উপদেশ খয়রাত করেননি। গরজ বড় বালাই। আওয়ামী লীগের এতটা ‘উদার' হয়ে ওঠার পেছনে আসল মতলব অন্য রকম। সেটা জামায়াতের জনপ্রিয়তা এবং ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতকেন্দ্রিক হিসাব-নিকাশ। এর কারণ জানতে হলে কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। লগি-বৈঠার হত্যা-তান্ডব থেকে জেনারেল মইন ও ফখরুদ্দিনদের ক্ষমতা দখল এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ‘ডিজিটাল' নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনা পর্যন্ত সব কিছুর পেছনেই ছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনা। জাতির জন্য ধ্বংসাত্মক হলেও ভারতসহ কয়েকটি দেশ ও সংস্থার কূটনীতিক ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে আওয়ামী শিবির এবং দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি পাওয়া জনা কয়েক ব্যক্তি সে পরিকল্পনার বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এর পেছনেও আবার বিশেষ কারণ ছিল। সে কারণটি হলো, ২০০৭ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের প্রাক্কালে পরিচালিত সব জরিপেই দেখা গিয়েছিল, ভরাডুবি ঘটবে আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ভারতসহ বিশেষ কয়েকটি দেশের দরকার ছিল একটি সেবাদাস সরকার। এ ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াতের চার দলীয় জোটকে সম্মত করানো যায়নি বলেই উদ্দিন সাহেবদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করে ফেলা। এ লক্ষ্য নিয়ে প্রণীত নির্দেশনা অনুসারে হুদা-সাখাওয়াত-ছহুল হোসাইনদের নির্বাচন কমিশন বেছে বেছে এমন ১৩৩টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করেছিল যে আসনগুলোতে বিএনপি ও জামায়াত বেশি ভোট পেয়ে থাকে। আসনগুলোকে খন্ডিত করে অন্য এমন কিছু এলাকার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে বিএনপি ও জামায়াত আর সহজে জিততে না পারে। এখানেই ছিল ‘ডিজিটাল খেল'-এর প্রথম পর্যায়। দেশের প্রধান দুটি দল যাতে আপত্তি জানাতে ও প্রতিবাদ করতে না পারে সে জন্য উদ্দিন সাহেবরা একদিকে বিএনপিকে দ্বিখন্ডিত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন অন্যদিকে নানা অসঙ্গত প্রশ্ন তুলে জামায়াতকে রেখেছিলেন ব্যতিব্যস্ত। বেগম খালেদা জিয়ার পাশাপাশি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার ও হয়রানি করার পেছনেও ছিল একই উদ্দেশ্য- তারা যাতে দল দুটিকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে না পারেন। জেনারেল মইন উদের সামনে রেখে সে উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল হয়েছিল। ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা' বিদেশীদের পাশাপাশি জেনারেল মইন উদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। নির্লজ্জ ‘ডিজিটাল চৌর্যবৃত্তির' পথে ক্ষমতায় এসেছেন তিনি। এদিকে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো গেলেও জামায়াতে ইসলামীসহ এদেশের ইসলামী ও দেশপ্রেমিক দলগুলোকে নির্মূল করে ফেলা কিন্তু সম্ভব হয়নি। একই কারণে রোডম্যাপের অন্তরালে সক্রিয় রাষ্ট্র ভারতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ‘ডিজিটাল' নির্বাচনে জামায়াতের সাফল্যে ভারতের মাথাব্যথা বরং অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কারণ, প্রতি আসনে গড়ে ৮৬ হাজার ৫৪৬টি করে ৩৮ আসনে জামায়াত পেয়েছে ৩২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৮২ ভোট। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত পেয়েছিল ২৩ লাখ ৮৫ হাজার ৩৬১ ভোট। সে হিসাবে ২০০৮ সালে জামায়াতের ভোট বেড়েছে নয় লাখ তিন হাজার ৪২১টি- শতকরা হিসাবে ১৪ ভাগ। এর সঙ্গে বাকি ২৬১ আসনে জামায়াতের ভোটাররা চার দলীয় জোট প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিলেন। প্রতি আসনে এই ভোটারদের সংখ্যা কম করে ১০ হাজার ধরলেও ছিল ২৬ লাখ ১০ হাজার। এর সঙ্গে ৩৮ আসনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা যোগ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, জামায়াতের ভোটার রয়েছেন অন্তত ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮২ জন। তাছাড়া সামগ্রিক অর্জনের ক্ষেত্রেও জামায়াত যথেষ্ট সম্মানজনক অবস্থানে ছিল। আওয়ামী লীগেরও চারজনসহ ১৫৫৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ৯৩২ জনের অর্থাৎ ৬০ শতাংশেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। কিন্তু জামায়াতের একজন ছাড়া কারো জামানত বাজেয়াপ্ত হয়নি। যার বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তিনিও ৩২ হাজার ৫২৭ ভোট পেয়েছিলেন। অর্থাৎ রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্মূল হওয়ার পরিবর্তে জামায়াতে ইসলামীর শক্তি ও জনসমর্থন উল্টো বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল বলেই মাথা খারাপ হয়েছিল ভারতের, সেই সাথে আওয়ামী লীগের তো বটেই। সে কারণে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই ভারতের পরামর্শে সরকার ‘তক্কে তক্কে' থেকেছে, কিন্তু জামায়াতকে পাকড়াও করার মতো যুৎসই কোনো অজুহাত খুঁজে পায়নি। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার পর পর স্বয়ং বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মীমাংসা করে যাওয়া কথিত যুদ্ধাপরাধকেই অজুহাত বানানো হয়েছে। এ ব্যাপারেও সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে স্বার্থে আঘাত লাগার পর। দেখা গেছে, ২০১০ সালের মে মাস পর্যন্ত নীরবে থাকার পর সরকার ঠিক তখনই তৎপর হয়েছিল, জামায়াতে ইসলামী যখন বিএনপির সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। সেই থেকে শুরু। ইতোমধ্যে জামায়াতের প্রধান নেতাদের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। তালা লাগানো হয়েছে দলটির সকল অফিসে। জামায়াতকে এমনকি মিছিল-সমাবেশও করতে দেয়া হচ্ছে না। নেতা-কর্মীদের পুলিশ দিয়ে পেটানো হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। কিন্তু কিছুতেই জামায়াতকে দিয়ে নতি স্বীকার করানো যাচ্ছে না। বিএনপির সঙ্গেও জামায়াতের সম্পর্ক নষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। ওদিকে এগিয়ে আসছে নির্বাচনের সময়। ক্ষমতাসীনরা শুধু নয়, ভারতসহ তাদের শুভাকাঙিক্ষরাও বুঝতে পেরেছে, জামায়াতকেই শুধু ধাওয়ার মুখে রাখলে চলবে না, একই সঙ্গে বিএনপির সঙ্গেও দলটির সম্পর্কে ভাঙন ঘটাতে হবে। না হলে নির্বাচনে ভরাডুবি তো ঘটবেই, আওয়ামী লীগ এমনকি নির্মূল হয়ে যাওয়ার পর্যায়েও চলে যেতে পারে। এজন্যই কৌশল হিসেবে বিএনপির মধ্যে জামায়াত সম্পর্কে মন্দ ধারণা তৈরি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সে কৌশলের অংশ হিসেবেই বেগম খালেদা জিয়াকে জামায়াতের ‘সঙ্গ' ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগ থেকে। বিএনপি এবং বেগম জিয়ার জন্য ‘দরদ' একেবারে উথলে উঠেছে তাদের। পর্যবেক্ষকরা অবশ্য মির্জা আলমগীরের পাল্টা জবাব ও পরামর্শকেই বেশি গুরুতপূর্ণ মনে করছেন। বেগম জিয়ার ‘শুভ' কামনা করার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের উচিত নিজের চরকায় তেল দেয়া, আগামী নির্বাচনে যাতে মান বাঁচানোর মতো আসন তিনি পেতে পারেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন