মোস্তাফিজুর রহমান
|
৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতন দিবস। ১৯৯০-এর এই দিনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছিল। বস্তুত ’৯০-এর ৪ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ওইদিন রাত ১০টার বিটিভির ইংরেজি সংবাদের শেষ দিকে সংবাদ পাঠকের হাতে একটি স্লিপ ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং তিনি পাঠ করেছিলেন কাঙ্ক্ষিত সেই বাক্য—‘এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স খ্যাত বিটিভির সংবাদ তখন দর্শকরা খুব একটা দেখতেন না। ফলে যারা শুনলেন তারাও বিশ্বাস করতে পারলেন না বিটিভির দেয়া এরশাদের পদত্যাগের সিদ্ধান্তের খবরটি। বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকা ছিল তখন খুবই জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম। রাত সাড়ে ১০টার বিবিসিতে প্রচারিত হলো ‘বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ আর তখনই সারা দেশে উল্লাসে ফেটে পড়ল জনতা। রাতের অন্ধকার ভেদ করে গগণবিদারী স্লোগানসহ বিজয়ের মিছিল নিয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলো লাখো জনতা। এরশাদের পতন হলো। ৬ ডিসেম্বর এরশাদের আনুষ্ঠানিক পদত্যাগ এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার নেয়ার মধ্য দিয়ে ৯ বছরের সামরিক-স্বৈরশাসনের অবসান হলো।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপির নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নল দেখিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করে বিশ্ববেহায়া খ্যাত এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। সংবিধান স্থগিত করে, সামরিক আইন জারি করে এরশাদ তার শাসনকাল শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ তার গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ঐতিহ্যের পথ ধরেই এরশাদের সামরিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করেছে দেরি না করেই। ২৪ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে সামরিক আইন মানি না স্লোগান দিয়ে ছাত্ররা মিছিল বের করেছে। তারপর এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ঘোষিত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্য ও সংগ্রাম ক্রমেই দানা বাঁধতে থাকে। এই ঐক্য ও সংগ্রামের নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি সামরিক শাসনবিরোধী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্য ও সংগ্রামের পাশাপাশি জাতীয় অঙ্গনেও রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন জোটের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়। আন্দোলন দমন ও নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য এরশাদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকে না। ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রামের জনসভায় এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়ে ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই শেখ হাসিনা ’৮৬-র নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এরশাদের অবৈধ সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়ার চক্রান্তের এই নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। ’৮৭-এর ডিসেম্বরে এই সংসদও এরশাদ ভেঙে দিলেন। ’৮৮-এর ৩ মার্চ দেশে আবারও জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সাইনবোর্ডসর্বস্ব কতক রাজনৈতিক দল ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করল। ভোটারবিহীন এই নির্বাচনের মাধ্যমে এরশাদ আরেকটি সংসদ গঠন করে বেসামরিক লেবাসে স্বৈরাচারী শাসন চালাতে থাকেন। দেশব্যাপী এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। সমাজের সব স্তরের মানুষ আন্দোলনে শামিল হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১০ অক্টোবর, ১৯৯০। ৭ দল, ৮দল, ৫ দল আহূত সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির দিনে উল্লাপাড়ার কলেজছাত্র ছাত্রদল নেতা জেহাদ পুলিশের গুলিতে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ জেহাদের লাশকে সামনে নিয়ে ডাকসু ভিপি আমানউল্লাহ আমানের নেতৃত্বে ডাকসু ও ২২ সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য। সব সংকীর্ণতা পরিহার করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে দেশের সব গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়। সাধারণ ছাত্র সমাজসহ গোটা দেশবাসীর মধ্যে ছাত্র সংগঠনগুলোর এই ঐক্য ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃত্বে লাগাতার সংগ্রামের কর্মসূচি চলতে থাকে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে, জেলায়-জেলায়, শিল্পাঞ্চলে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ডাকে বড় বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এরশাদের পাল্টা কর্মসূচি ব্যর্থ করে দিয়ে মন্ত্রী পাড়া ঘেরাওয়ের সাহসী কর্মসূচিও সর্বাত্মক সফল হয়। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের এই সাহসী সংগ্রামের কাফেলার পাশাপাশি জাতীয় নেতৃত্ব, শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, ডাক্তার-প্রকৌশলী, আইনজীবী, শ্রমিক-কর্মচারী, কৃষক-খেতমজুর, যুব-নারী সমাজের সম্মিলিত সংগ্রামে বেসামাল এরশাদ শেষ রক্ষার জন্য ক্যাম্পাস দখলে নেয়ার ষড়যন্ত্র করেন, লেলিয়ে দেন ভাড়াটিয়া সশস্ত্র পেটোয়া বাহিনী। সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। জয়ী হয় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃত্বে ছাত্র সমাজ। ২৭ নভেম্বর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন বিএমএ নেতা ডা. মিলন। মৃত্যুঞ্জয়ী এই বীরের মৃত্যুর ঘটনায় এরশাদের মসনদ কেঁপে ওঠে। জরুরি আইন জারি করা হয়। জরুরি আইন ভঙ্গ করে পরদিন ভোরবেলায় রোকেয়া-শামসুন্নাহার হল, বুয়েট, মেডিকেল থেকে অকুতোভয় ছাত্রী বোনদের সঙ্গে মিছিলে শামিল হয় ছাত্র-জনতা। বন্ধ হয়ে যায় দেশের সংবাদপত্র, শুরু হয়ে যায় লাগাতার হরতাল-অসহযোগ। বেরিয়ে আসে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গোটা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। অবশেষে সেই ঐতিহাসিক ক্ষণ। ছাত্র-জনতার মহা গণঅভ্যুত্থান। ইতিহাসের পাতায় আরেকটি ইতিহাস। ’৮৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি জয়নাল-জাফরের রক্তাক্ত পথে সেলিম-দেলোয়ার, তাজুল, ময়েজ উদ্দিন, রাউফুন বসুনিয়া, শাহজাহান সিরাজ, মাহবুবুল হক বাবলু, নূর হোসেন, জেহাদ, ডা. মিলনসহ অসংখ্য শহীদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হলো। বিজয়ের আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠল দেশ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ উন্মোচিত হলো।
এরপর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে দেশের মানুষ ৯ বছরের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আপসহীন ও সাহসী ভূমিকার জন্য দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলের পক্ষে নীরব ব্যালট বিপ্লব সংঘটিত করল। গঠিত হলো বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। দুর্ভাগ্য গোটা জাতির, দেশবাসীর। নির্বাচনের এই ফলাফলকে শেখ হাসিনা মেনে নিতে পারলেন না। উনি বললেন, এই নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে, আর বললেন ২৪ ঘণ্টাও তিনি বিএনপি সরকারকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। শেখ হাসিনা তার কথা রেখেছেন। বিএনপি দেশবাসীর কাছে দেয়া অঙ্গীকার আর ৩ জোটের প্রণীত রূপরেখার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সংসদে সংবিধানের সংশোধনী এনে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে। দেশে শুরু হয় সংসদীয় ধারার রাজনীতি। এই রাজনীতিকেও নির্বিঘ্নে অগ্রসর হতে দেয়া হলো না। শুরু হলো বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক, সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। ’৯৪-এ সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবিতে আওয়ামী লীগ, সঙ্গে জাতীয় পার্টি, জামায়াত আন্দোলন শুরু করল। সংসদকে অকার্যকর করে তোলা হলো। ৯ বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জিত গণতন্ত্র স্থায়ী ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারল না। টানা হরতাল, অবরোধ, সংসদ থেকে পদত্যাগ—এই পটভূমিতে সংসদের মেয়াদ পূর্তির পর সাংবিধানিক বাধ্য-বাধ্যকতায় ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত এই সংসদকে দিয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এনে ’৯৬-এর জুনে আবারও নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হলো। এই নির্বাচনে নানা ষড়যন্ত্র আর প্রতিকূলতার মধ্যেও বিএনপি এককভাবে ১১৬টি আসন লাভ করল। সামান্য ভোটের ব্যবধানে বিএনপিকে হারিয়ে দেয়া হলো কমপক্ষে ৫০টি আসনে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করল। তার পরের ইতিহাস আওয়ামী লীগের ’৭২-৭৫ এর দুঃশাসনেরই পুনরাবৃত্তির ইতিহাস। দেশের মানুষ আবারও নতুন করে ’৭২-৭৫ এর আওয়ামী দুঃশাসনের চেহারা দেখল, আঁতকে উঠল দেশবাসী। পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠল দেশের মানুষ। গঠিত হলো চারদলীয় জোট। ২০০১-এর নির্বাচনে দেশের মানুষ আবারও ব্যালট বিপ্লব ঘটিয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী করল। নির্বাচনের আগেই জোট থেকে সরে গেল পতিত স্বৈরাচার এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টি। বিএনপিও কলঙ্কের দায় থেকে মুক্তি পেল। এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন শুরু-শেষের কর্মী-নেতা হিসেবে আমার এবং আমার মতো অনেকেরই দুঃখ, আমরা যার বিরুদ্ধে ৯ বছর সংগ্রাম করলাম, অসংখ্য শহীদের রক্তে যার হাত রঞ্জিত, সেই স্বৈরশাসক এরশাদকে আমাদের প্রয়োজনে আমরা সবাই পাশে বসিয়েছি। আর উনিই আজ আমাদেরকে গণতন্ত্রের ছবক দেন, শহীদ নূর হোসেন দিবসকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করেন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম আর অসংখ্য শহীদের আত্মদানকে প্রশ্নবিদ্ধ ও পরিহাস করার দুঃসাহস দেখান।
২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনকাল। ২০০১-এর নির্বাচনে বিপুল ভরাডুবির পরও শেখ হাসিনা বললেন স্থূল কারচুপির কথা এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করা, সংসদকে কার্যকর করা, দেশকে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সহযোগিতার পরিবর্তে পদে পদে বাধা প্রদান, নেতিবাচক-ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে অচল করে দেয়ার নীতি নিয়ে চলতে থাকে একেবারে প্রথম দিন থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় নারকীয় তাণ্ডব চালায়, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে, লাশের ওপর পৈশাচিক উন্মত্ততায় নৃত্য করে সভ্যতাকেই পদদলিত করে। ২২ জানুয়ারির (২০০৭) নির্বাচনে অংশ নিয়েও আকস্মিকভাবে তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, ১/১১-র পটভূমি তৈরি করে। সংঘটিত হয় ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় ১/১১। গঠিত হয় সেনা সমর্থিত মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই বললেন, এই সরকার হচ্ছে তাদের আন্দোলনের ফসল। তার পরের ইতিহাস আমাদের নিকট অতীতের ইতিহাস। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার পরিবার, জাতীয়তাবাদী আদর্শের দল বিএনপিকে ধ্বংসের সুগভীর চক্রান্ত নিয়ে অগ্রসর হলো মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সেনা সমর্থিত এই অবৈধ সরকার, তাদের গঠিত তল্পিবাহক নির্বাচন কমিশন। শেষ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বারবার বলেছেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই, এই দেশই আমার ঠিকানা, এখানেই আমার জন্ম, আর মৃত্যুও এই জমিনেই।’ তার এই দৃঢ়তা ও অসম সাহসের কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করেছে শাসকরা। শুরুতে তারা দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে চাইলেও পরবর্তী ঘটনাবলি এ সাক্ষ্যই দেয় যে, আওয়ামী লীগ নেত্রীর সঙ্গে তাদের সমঝোতা আগাগোড়াই। শেখ হাসিনাও তা গোপন করেননি। এখন যদিও তিনি বলেছেন, মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার দানবীয় সরকার।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপিকে অংশ নিতে হয়েছে। আমাদের জানা মতে অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে। বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন, এই নির্বাচন নীলনকশার নির্বাচন, এই নির্বাচনে বিএনপিকে ৩০টির বেশি আসন দেয়া হবে না। তারপরও এই অনির্বাচিত অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে একটি নির্বাচিত সরকার দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য কম মন্দ মনে করেই তিনি সে সময় আরও নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। দেশ ও বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়ে এক অবিশ্বাস্য ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষে নিয়ে নেয়া হয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের লাগামহীন কর্মকাণ্ড। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা সংসদকে অকার্যকর করে তুলেছে। বিরোধী দলের নগণ্য উপস্থিতিকেও তারা সম্মান জানাতে কুণ্ঠিত। বিরোধী দলের পক্ষে সম্মান ও ইজ্জত নিয়ে ওই সংসদে গিয়ে দেশের জন্য জনস্বার্থে কথা বলার ন্যূনতম সুযোগটুকু আওয়ামী লীগ রাখেনি। নির্বাচনে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে সংসদকে দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলসহ সমাজের নানা অংশের মানুষের মতামত উপেক্ষা করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ বহাল রেখে আগামী নির্বাচনের বিধান প্রবর্তন করেছে। এই প্রসঙ্গে তারা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের অজুহাত সামনে আনছেন। দুর্ভাগ্য, সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য তারা অপেক্ষা পর্যন্ত করলেন না, তড়িঘড়ি করে সংসদে বসে তারা পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে ফেললেন। তারা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ২য় অংশ বিবেচনায় আনলেন না। আরও দুই টার্ম দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ তো সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ২য় অংশেই দেয়া ছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করিয়ে এখন দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের একগুঁয়ে অনমনীয় নীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অবস্থানটা এখানে খুবই পরিষ্কার।
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না এবং এ ধরনের একতরফা নির্বাচন তারা দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিতও হতে দেবে না। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি এখন জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। বিদেশিরাও এই দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন এবং দেশকে সংঘাত-নৈরাজ্যের মুখে ঠেলে না দিয়ে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে তারাও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট এখন পর্যন্ত দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ-নিয়মতান্ত্রিক গণসম্পৃক্ত কর্মসূচি দিয়ে চলেছে। সরকারি মহল যদি এই গণদাবি মেনে না নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ফেলে, তাহলে দেশ অনিবার্য সংঘাত-নৈরাজ্যের মধ্যে নিপতিত হবে এবং এর সব দায়-দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে। ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতন দিবসে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর কাছে বিনীত প্রত্যাশা—দেশকে সংঘাত-সংঘর্ষের দিকে ঠেলে না দিয়ে, গণতন্ত্রের জন্য আবারও রক্ত না ঝরিয়ে, গণদাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আসুন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে জনগণের রায়ের কাছে নিজেদের ক্ষমতায় থাকা-না থাকার বিষয়টি ছেড়ে দিই। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। গণতন্ত্রের জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য তারা বারবার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম গড়ে তুলেছে, জয়ী হয়েছে। জনগণের সংগ্রাম কখনোই পরাজিত হয়নি, জনগণ কখনোই পরাভব মানেনি। গণতন্ত্রের জন্য চলমান সংগ্রামেও গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জনগণের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
লেখক : নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা,
বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপির নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নল দেখিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করে বিশ্ববেহায়া খ্যাত এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। সংবিধান স্থগিত করে, সামরিক আইন জারি করে এরশাদ তার শাসনকাল শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ তার গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ঐতিহ্যের পথ ধরেই এরশাদের সামরিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করেছে দেরি না করেই। ২৪ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে সামরিক আইন মানি না স্লোগান দিয়ে ছাত্ররা মিছিল বের করেছে। তারপর এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ঘোষিত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্য ও সংগ্রাম ক্রমেই দানা বাঁধতে থাকে। এই ঐক্য ও সংগ্রামের নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি সামরিক শাসনবিরোধী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্য ও সংগ্রামের পাশাপাশি জাতীয় অঙ্গনেও রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন জোটের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়। আন্দোলন দমন ও নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য এরশাদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকে না। ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রামের জনসভায় এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়ে ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই শেখ হাসিনা ’৮৬-র নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এরশাদের অবৈধ সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়ার চক্রান্তের এই নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। ’৮৭-এর ডিসেম্বরে এই সংসদও এরশাদ ভেঙে দিলেন। ’৮৮-এর ৩ মার্চ দেশে আবারও জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সাইনবোর্ডসর্বস্ব কতক রাজনৈতিক দল ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করল। ভোটারবিহীন এই নির্বাচনের মাধ্যমে এরশাদ আরেকটি সংসদ গঠন করে বেসামরিক লেবাসে স্বৈরাচারী শাসন চালাতে থাকেন। দেশব্যাপী এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। সমাজের সব স্তরের মানুষ আন্দোলনে শামিল হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১০ অক্টোবর, ১৯৯০। ৭ দল, ৮দল, ৫ দল আহূত সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির দিনে উল্লাপাড়ার কলেজছাত্র ছাত্রদল নেতা জেহাদ পুলিশের গুলিতে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ জেহাদের লাশকে সামনে নিয়ে ডাকসু ভিপি আমানউল্লাহ আমানের নেতৃত্বে ডাকসু ও ২২ সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য। সব সংকীর্ণতা পরিহার করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে দেশের সব গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়। সাধারণ ছাত্র সমাজসহ গোটা দেশবাসীর মধ্যে ছাত্র সংগঠনগুলোর এই ঐক্য ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃত্বে লাগাতার সংগ্রামের কর্মসূচি চলতে থাকে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে, জেলায়-জেলায়, শিল্পাঞ্চলে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ডাকে বড় বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এরশাদের পাল্টা কর্মসূচি ব্যর্থ করে দিয়ে মন্ত্রী পাড়া ঘেরাওয়ের সাহসী কর্মসূচিও সর্বাত্মক সফল হয়। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের এই সাহসী সংগ্রামের কাফেলার পাশাপাশি জাতীয় নেতৃত্ব, শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, ডাক্তার-প্রকৌশলী, আইনজীবী, শ্রমিক-কর্মচারী, কৃষক-খেতমজুর, যুব-নারী সমাজের সম্মিলিত সংগ্রামে বেসামাল এরশাদ শেষ রক্ষার জন্য ক্যাম্পাস দখলে নেয়ার ষড়যন্ত্র করেন, লেলিয়ে দেন ভাড়াটিয়া সশস্ত্র পেটোয়া বাহিনী। সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। জয়ী হয় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃত্বে ছাত্র সমাজ। ২৭ নভেম্বর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন বিএমএ নেতা ডা. মিলন। মৃত্যুঞ্জয়ী এই বীরের মৃত্যুর ঘটনায় এরশাদের মসনদ কেঁপে ওঠে। জরুরি আইন জারি করা হয়। জরুরি আইন ভঙ্গ করে পরদিন ভোরবেলায় রোকেয়া-শামসুন্নাহার হল, বুয়েট, মেডিকেল থেকে অকুতোভয় ছাত্রী বোনদের সঙ্গে মিছিলে শামিল হয় ছাত্র-জনতা। বন্ধ হয়ে যায় দেশের সংবাদপত্র, শুরু হয়ে যায় লাগাতার হরতাল-অসহযোগ। বেরিয়ে আসে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গোটা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। অবশেষে সেই ঐতিহাসিক ক্ষণ। ছাত্র-জনতার মহা গণঅভ্যুত্থান। ইতিহাসের পাতায় আরেকটি ইতিহাস। ’৮৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি জয়নাল-জাফরের রক্তাক্ত পথে সেলিম-দেলোয়ার, তাজুল, ময়েজ উদ্দিন, রাউফুন বসুনিয়া, শাহজাহান সিরাজ, মাহবুবুল হক বাবলু, নূর হোসেন, জেহাদ, ডা. মিলনসহ অসংখ্য শহীদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হলো। বিজয়ের আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠল দেশ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ উন্মোচিত হলো।
এরপর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে দেশের মানুষ ৯ বছরের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আপসহীন ও সাহসী ভূমিকার জন্য দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলের পক্ষে নীরব ব্যালট বিপ্লব সংঘটিত করল। গঠিত হলো বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। দুর্ভাগ্য গোটা জাতির, দেশবাসীর। নির্বাচনের এই ফলাফলকে শেখ হাসিনা মেনে নিতে পারলেন না। উনি বললেন, এই নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে, আর বললেন ২৪ ঘণ্টাও তিনি বিএনপি সরকারকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। শেখ হাসিনা তার কথা রেখেছেন। বিএনপি দেশবাসীর কাছে দেয়া অঙ্গীকার আর ৩ জোটের প্রণীত রূপরেখার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সংসদে সংবিধানের সংশোধনী এনে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে। দেশে শুরু হয় সংসদীয় ধারার রাজনীতি। এই রাজনীতিকেও নির্বিঘ্নে অগ্রসর হতে দেয়া হলো না। শুরু হলো বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক, সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। ’৯৪-এ সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবিতে আওয়ামী লীগ, সঙ্গে জাতীয় পার্টি, জামায়াত আন্দোলন শুরু করল। সংসদকে অকার্যকর করে তোলা হলো। ৯ বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জিত গণতন্ত্র স্থায়ী ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারল না। টানা হরতাল, অবরোধ, সংসদ থেকে পদত্যাগ—এই পটভূমিতে সংসদের মেয়াদ পূর্তির পর সাংবিধানিক বাধ্য-বাধ্যকতায় ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত এই সংসদকে দিয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এনে ’৯৬-এর জুনে আবারও নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হলো। এই নির্বাচনে নানা ষড়যন্ত্র আর প্রতিকূলতার মধ্যেও বিএনপি এককভাবে ১১৬টি আসন লাভ করল। সামান্য ভোটের ব্যবধানে বিএনপিকে হারিয়ে দেয়া হলো কমপক্ষে ৫০টি আসনে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করল। তার পরের ইতিহাস আওয়ামী লীগের ’৭২-৭৫ এর দুঃশাসনেরই পুনরাবৃত্তির ইতিহাস। দেশের মানুষ আবারও নতুন করে ’৭২-৭৫ এর আওয়ামী দুঃশাসনের চেহারা দেখল, আঁতকে উঠল দেশবাসী। পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠল দেশের মানুষ। গঠিত হলো চারদলীয় জোট। ২০০১-এর নির্বাচনে দেশের মানুষ আবারও ব্যালট বিপ্লব ঘটিয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী করল। নির্বাচনের আগেই জোট থেকে সরে গেল পতিত স্বৈরাচার এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টি। বিএনপিও কলঙ্কের দায় থেকে মুক্তি পেল। এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন শুরু-শেষের কর্মী-নেতা হিসেবে আমার এবং আমার মতো অনেকেরই দুঃখ, আমরা যার বিরুদ্ধে ৯ বছর সংগ্রাম করলাম, অসংখ্য শহীদের রক্তে যার হাত রঞ্জিত, সেই স্বৈরশাসক এরশাদকে আমাদের প্রয়োজনে আমরা সবাই পাশে বসিয়েছি। আর উনিই আজ আমাদেরকে গণতন্ত্রের ছবক দেন, শহীদ নূর হোসেন দিবসকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করেন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম আর অসংখ্য শহীদের আত্মদানকে প্রশ্নবিদ্ধ ও পরিহাস করার দুঃসাহস দেখান।
২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনকাল। ২০০১-এর নির্বাচনে বিপুল ভরাডুবির পরও শেখ হাসিনা বললেন স্থূল কারচুপির কথা এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করা, সংসদকে কার্যকর করা, দেশকে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সহযোগিতার পরিবর্তে পদে পদে বাধা প্রদান, নেতিবাচক-ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে অচল করে দেয়ার নীতি নিয়ে চলতে থাকে একেবারে প্রথম দিন থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় নারকীয় তাণ্ডব চালায়, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে, লাশের ওপর পৈশাচিক উন্মত্ততায় নৃত্য করে সভ্যতাকেই পদদলিত করে। ২২ জানুয়ারির (২০০৭) নির্বাচনে অংশ নিয়েও আকস্মিকভাবে তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, ১/১১-র পটভূমি তৈরি করে। সংঘটিত হয় ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় ১/১১। গঠিত হয় সেনা সমর্থিত মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই বললেন, এই সরকার হচ্ছে তাদের আন্দোলনের ফসল। তার পরের ইতিহাস আমাদের নিকট অতীতের ইতিহাস। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার পরিবার, জাতীয়তাবাদী আদর্শের দল বিএনপিকে ধ্বংসের সুগভীর চক্রান্ত নিয়ে অগ্রসর হলো মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সেনা সমর্থিত এই অবৈধ সরকার, তাদের গঠিত তল্পিবাহক নির্বাচন কমিশন। শেষ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বারবার বলেছেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই, এই দেশই আমার ঠিকানা, এখানেই আমার জন্ম, আর মৃত্যুও এই জমিনেই।’ তার এই দৃঢ়তা ও অসম সাহসের কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করেছে শাসকরা। শুরুতে তারা দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে চাইলেও পরবর্তী ঘটনাবলি এ সাক্ষ্যই দেয় যে, আওয়ামী লীগ নেত্রীর সঙ্গে তাদের সমঝোতা আগাগোড়াই। শেখ হাসিনাও তা গোপন করেননি। এখন যদিও তিনি বলেছেন, মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার দানবীয় সরকার।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপিকে অংশ নিতে হয়েছে। আমাদের জানা মতে অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে। বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন, এই নির্বাচন নীলনকশার নির্বাচন, এই নির্বাচনে বিএনপিকে ৩০টির বেশি আসন দেয়া হবে না। তারপরও এই অনির্বাচিত অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে একটি নির্বাচিত সরকার দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য কম মন্দ মনে করেই তিনি সে সময় আরও নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। দেশ ও বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়ে এক অবিশ্বাস্য ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষে নিয়ে নেয়া হয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের লাগামহীন কর্মকাণ্ড। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা সংসদকে অকার্যকর করে তুলেছে। বিরোধী দলের নগণ্য উপস্থিতিকেও তারা সম্মান জানাতে কুণ্ঠিত। বিরোধী দলের পক্ষে সম্মান ও ইজ্জত নিয়ে ওই সংসদে গিয়ে দেশের জন্য জনস্বার্থে কথা বলার ন্যূনতম সুযোগটুকু আওয়ামী লীগ রাখেনি। নির্বাচনে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে সংসদকে দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলসহ সমাজের নানা অংশের মানুষের মতামত উপেক্ষা করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ বহাল রেখে আগামী নির্বাচনের বিধান প্রবর্তন করেছে। এই প্রসঙ্গে তারা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের অজুহাত সামনে আনছেন। দুর্ভাগ্য, সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য তারা অপেক্ষা পর্যন্ত করলেন না, তড়িঘড়ি করে সংসদে বসে তারা পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে ফেললেন। তারা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ২য় অংশ বিবেচনায় আনলেন না। আরও দুই টার্ম দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ তো সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ২য় অংশেই দেয়া ছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করিয়ে এখন দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের একগুঁয়ে অনমনীয় নীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অবস্থানটা এখানে খুবই পরিষ্কার।
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না এবং এ ধরনের একতরফা নির্বাচন তারা দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিতও হতে দেবে না। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি এখন জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। বিদেশিরাও এই দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন এবং দেশকে সংঘাত-নৈরাজ্যের মুখে ঠেলে না দিয়ে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে তারাও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট এখন পর্যন্ত দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ-নিয়মতান্ত্রিক গণসম্পৃক্ত কর্মসূচি দিয়ে চলেছে। সরকারি মহল যদি এই গণদাবি মেনে না নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ফেলে, তাহলে দেশ অনিবার্য সংঘাত-নৈরাজ্যের মধ্যে নিপতিত হবে এবং এর সব দায়-দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে। ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতন দিবসে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর কাছে বিনীত প্রত্যাশা—দেশকে সংঘাত-সংঘর্ষের দিকে ঠেলে না দিয়ে, গণতন্ত্রের জন্য আবারও রক্ত না ঝরিয়ে, গণদাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আসুন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে জনগণের রায়ের কাছে নিজেদের ক্ষমতায় থাকা-না থাকার বিষয়টি ছেড়ে দিই। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। গণতন্ত্রের জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য তারা বারবার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম গড়ে তুলেছে, জয়ী হয়েছে। জনগণের সংগ্রাম কখনোই পরাজিত হয়নি, জনগণ কখনোই পরাভব মানেনি। গণতন্ত্রের জন্য চলমান সংগ্রামেও গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জনগণের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
লেখক : নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা,
বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন