মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০১৩

শিকড়বিহীন এক উন্মূল প্রজন্ম


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : 
আমরা ওয়ান-টু-থ্রি করে পার হতে হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছি। এই গোটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের চিনেছি। আমাদের পূর্বপুরচষদের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস জানতে পেরেছি। তাদের টিকে থাকার দুর্দান্ত লড়াই আমাদের অবিরাম প্রেরণা যুগিয়ে আসছে। এ শিক্ষার ধারাবাহিকতায়ই আমরা বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছর ধরে আলাদা জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। এই জনপদের মানুষের বিরচদ্ধে শোষণবঞ্চনার কথা জানতে পেরেছি। আমরা জানতে পেরেছি, এই জনপদের মানুষ নিরবচ্ছিন্নভাবে কীভাবে যূথবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়েছে। জাতীয় ঐক্য ছাড়া এই জনপদে মানুষের টিকে থাকা একেবারেই অসম্ভব ছিল। তার কারণ নদী। বাংলাদেশ নদ-নদীপ্রধান জনপদ। অবিরাম খরা-বন্যা-ঘূর্ণিঝড় আমাদের নিত্যসঙ্গী। তারপরও আমরা যে কেনো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাইনি, শিক্ষাপদ্ধতির ভেতর দিয়েই আমরা তা উপলব্ধি করেছি। অর্থাৎ আমাদের সময়ের শিক্ষাপদ্ধতি, তার কারিকুলামের ভেতরেই তা ছিল। সেখানে যতটুকু ছিল, তার চেয়ে আরও বেশি জেনেছি গ্রন্থ পড়ে।
বালাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ৪২ বছরের দেশ। তার আগেও এই জনপদ ছিল। এই ভূখন্ড ছিল। এখানকার মানুষের লড়াই সংগ্রাম ছিল। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে তার আসতে সময় লেগেছে। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে যে জনপদ বেড়ে উঠল, তা স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের বিলুপ্তি ঘটে না। যদি কেউ তেমন বিলুপ্তি ঘটিয়ে দিতে চায়, তা হলে বুঝতে হবে, তার অভিসন্ধি ভাল নয়। বাংলাদেশে এখন তেমন অভিসন্ধিরই কাল। সরকার সকলের দৃষ্টির অগোচরে এদেশের মানুষের হাজার বছরের লড়াই, সংগ্রাম আর টিকে থাকার ইতিহাস মুছে ফেলে দিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিকড়বিহীর এক উন্মূল জনগোষ্ঠীতে পরিণত করতে চাইছে। যে জনগোষ্ঠী যার গৌরবময় ইতিহাসের সন্ধান রাখবে না, পূর্বপুরচষের অধিকার বা টিকে থাকার লড়াই সম্পর্কে অবহিত থাকবে না, আর চলতি হাওয়ার পঙ্কে নিজেদের ডুবিয়ে দেবে। আর ঠিক মতো যদি এই কাজটি সম্পন্ন করা যায়, তাহলে ঐ জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আত্মমর্যাদা অর্থহীন হয়ে উঠবে। লক্ষ্য সম্ভবত সেটাই।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি টানা প্রায় বাইশ বছর। না, আমার অবস্থা আদুভাইয়ের মতো ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটে মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি করে বের হতে ঐ ২২ বছর লেগেছিল। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন ট্রাডিশন অনুযায়ী আমাদের হাতে থাকতো বইখাতা, বড় জোর কাঁধে থাকতো ঝোলা। তাতে আরও কিছু বই, ম্যাগাজিন ও পড়া বা লেখার সরঞ্জাম। আমরা শরীফ মিঞার ক্যান্টিনের সামনে কিংবা লাইব্রেরির বারান্দার সামনে বসেও একান্ত মনে পড়াশোনা করেছি অথবা আড্ডা দিয়েছি। ছাত্ররা কলা ভবনের ক্লাস সেরেই কোনোমতে দুপুরের খাবার খেয়ে লাইব্রেরির দিকে ছুট দিতো। তারপর বইয়ের স্তূপের ভেতরে বসে অধ্যয়ন। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে দেখলাম শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি পরিপাটী বেশভূষা। হাতে বই খাতার বদলে ব্রিফকেস নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। এই পরিবর্তন আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। মনে হয়েছে, সমাজের ভেতরে কি এমন ঘটলো যে, শিক্ষার্থীরা ব্রিফকেস নিয়ে ক্লাসে আসতে শুরচ করেছে। তখনও কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপ সংস্কৃতি চালু হয়নি। ঐ ব্রিফকেসে সম্ভবত তারা বই খাতাই রাখতো। কিন্তু এই জেনারেশনকে আমার কাছে খুব একটা লাইব্রেরিমুখী মনে হয়নি। তবে তারা ছিল খুব ব্যস্ত।
আমরা যেমন গণতন্ত্র, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, মিছিলে উচ্চকিত হাত তুলেছি, পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েছি, এই জেনারেশনের ভেতরে তেমনটা লক্ষ্য করিনি। তারা খুব ব্যস্ত। কেন এত ব্যস্ত ছিল, বুঝে উঠতে পারি না। এর মধ্যে শিক্ষাদান পদ্ধতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। বছর শেষে পরীক্ষার বদলে সেমিস্টার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য দাঁড়িয়েছিল সেমিস্টারগুলো দ্রচত পার হয়ে যাওয়া। পার হয়ে ঐ সেমিস্টার ও তাতে পাঠ্য বিষয়ের কথা একেবারে ভুলে যাওয়া।  আমাদের সময় সেটা ছিল না। ফাইনাল পরীক্ষার আগে সবকিছু একেবারে ঝালিয়ে নিতে হতো। এই দুই পদ্ধতির কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ সে বিষয়ে আমার কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু একটা বিষয় তো সত্য যে, বছর শেষে পাঠ্য বিষয়াদি আর একবার ঝালিয়ে নেয়া কোনো বাধ্যবাধকতা তখন আর ছিল না।
এভাবেই এক একটি জেনারেশনের মধ্যে একেক ধরনের পরিবর্তন আসে। সে পরিবর্তনের গতি পথ নির্ধারণ করার দায় রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তাদের। কী প্রজন্ম তারা গড়ে তুলতে চাইছেন সেটি তারা নির্ধারণ করেন। সেভাবে শিক্ষা কার্যক্রম ও সমাজ পরিচালিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে বিগত দুই দশক ধরেভিভ আমাদের শাসকরা তেমন বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পেরেছে, সেরকম দাবি করা যায় না। পাঠ্য বিষয়াদিতে জ্ঞান চর্চা ক্রমেই সংকুচিত করে আনা হয়েছে। কিন্তু জ্ঞানচর্চা ছাড়া ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনুসন্ধান ছাড়া, নিজের শিকড়ের সন্ধান ছাড়া যে জেনারেশন গড়ে উঠবে, তার হাতে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিরাপদ কিনা সেটি দেখার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মের।
আগে এদেশের নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। কিন্তু সত্য এই যে, তাদের নেতৃত্বের কালে যারা তরচণ শিক্ষার্থী ছিলেন তাদেরও আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। এর গুণগত বিচার কী সেদিকে যেতে চাই না। কিন্তু এটাই তো খুব স্বাভাবিক যে, আজ যারা তরচণ শিক্ষার্থী তারা শিক্ষা জীবন শেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। সমাজের কর্ণধার হবেন। কিন্তু আমরা যদি তাদের উপযুক্ত শিক্ষা ও জ্ঞান দিয়ে পরিপুষ্ট না করতে পারি, তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিরাপদ থাকবে না।
আমরা এখনকার শিক্ষার্থীদের এই জনপদের মানুষের ইতিহা্স, ঐতিহ্য কতটা শেখাচ্ছি বা শেখাতে চাইছি? এদেশের মানুষের আছে আড়াই হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস। নরসিংদীর ওয়ারী বটেশ্বর তার প্রমাণ। সেখানে আমাদের পূর্বপুরচষেরা নির্মাণ করেছিলেন পাকা রাস্তা। এ দেশ ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের প্রধান ক্ষেত্র। পাহাড়পুর-ময়নামতি প্রভৃতি বৌদ্ধ বিহার আমরা আগেই আবিষ্কার করেছি। সেগুলো বিহার হলেও ছিল এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সেখানে শিক্ষালাভের জন্য আসতেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। সর্বশেষ আবিষ্কার মুন্সীগঞ্জের রামপালে। এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় ১১শ’ বছর আগের বৌদ্ধ বিহার। তেমনিভাবে আমাদের পূর্বপুরচষেরা লেখাপড়ার জন্য বাংলা লিপির উদ্ভাবন করেছিলেন ২২শ’ বছর আগে। তাদের লিখিত কাব্য আছে প্রায় দেড় হাজার বছর আগের। মনসামঙ্গল কাব্যে লিপিবদ্ধ আছে এই জনপদের মানুষের নত না হওয়ার কাহিনী।
কেউ বলতে পারেন, এখনকার দিনে এসব জানার প্রয়োজন কী? দ্বন্দ্বটা সম্ভবত সেখানেই। এর প্রয়োজন এই যে, ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা জানতে পারবেন যে, তার ইতিহাস-ঐতিহ্য কী। সেই গৌরবের ধারাবাহিকতা রক্ষায় তার দায়িত্ব আছে। কিন্তু এই গৌরবের কাহিনীই যদি জানা না থাকে, তাহলে এই প্রজন্ম হবে ভাসা পানার মতো। স্রোতের টানে যেদিকে খুশি ভেসে চলে যাবে। রাষ্ট্রের জন্য বিপদ সেখানেই। নতুন প্রজন্মকে আমরা জানতেই দেইনি কী ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি চেয়েছিল। কেন এই জনপদের প্রায় সকল লোক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। সে ক্ষেত্রেও তারা সম্ভবত নিরচপায়ই ছিল। কেননা ইসলাম মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলিয়ে সকলকে সমান মর্যাদা দিয়েছিল। এই সাম্য ছাড়া যূথবদ্ধতা ছাড়া আমাদের টিকে থাকাই অসম্ভব হতো।
আমরা তরচণ প্রজন্মকে জানতেই দেইনি যে, এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে কী অসামান্য সৃষ্টিশীল অবদান রেখেছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে কী অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এখন আমরা বাংলাদেশের ইতিহাস আলোচনা শুরচ করি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে। যেন তার আগে এদেশের মানুষ কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেনি। ভাষা আন্দোলনেও যারা শহীদ হন, আমরা তার জন্য পাকিস্তানীদের দায়ী করি। কিন্তু একবারও ভেবে দেখি না যে, সে সময় শাসন ক্ষমতায় ছিলেন এদেশের মানুষেরাই। এভাবেই ইতিহাস বিকৃত করে আমরা ভুল পথে নিয়ে গেছি।
গত দুই দশকে এই বেপথু-লক্ষ্যহীন-দূরদৃষ্টিহীন পথযাত্রায় আমরা এখন এক উন্মূল প্রজন্ম তৈরী করেছি। কিছুকাল আগে তার একটা উচ্ছ্বাস দেখলাম শাহবাগে। বলার অপেক্ষা রাখে না সরকারি মদতেই এমন একটা সার্কাসের আয়োজন হয়েছিল। তারা মতলবীভাবে অভিযুক্ত কয়েকজন ব্যক্তির ফাঁসির দাবি করেছে। দাবিটা ফাঁসির হবে, না ন্যায়বিচারের হবে, উন্মূল বলেই তারা সেটি বিবেচনা করে দেখেনি। সাধারণ গণতান্ত্রিক চেতনা হচ্ছে আদালতের রায় মেনে নেয়া। সে রায়ে সন্তুষ্ট না হলে উচ্চ আদালতে আপিল করা। সে রকম রায় আমরা মেনে নিতে বাধ্য। কিন্তু শাহবাগে আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ এর বিপরীত। মতলব ছিল সেখানে প্রধান। প্রথমে সে­vগান ছিল ফাঁসি চাই। তারপর সে­vগান উঠল, ফাঁসি দাও, জবাই করো। তারপর সে­vগান শিবির ধরো ধোলাই করো। তারপর ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করো। আর শেষ পর্যন্ত সে­vগান দাঁড়ালো আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে এক্ষুণি গ্রেফতার করো। আজব তারচণ্য! যখন তারা এমন সে­vগান তুলছিল, তখন সরকার নির্বিচারে গুলী চালিয়ে ১৭০ জন লোককে হত্যা করলো। তারচণ্যের বিবেক জাগ্রত হলো না।
অথচ তাদের কাছে তো আশা ছিল তারা ন্যায়ের পক্ষে সে­vগান তুলবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত করার দাবি ওঠাবে। গণহত্যা বন্ধের জন্য সোচ্চার হবে। তা না হলে তারচণ্য কী! কিন্তু এ জন্য আমি তাদের দোষ দেই না। আমরা তাদের এ রকম শিক্ষায়ই দীক্ষিত করেছি। যে তরচণ দম্পতি তাদের অবোধ সন্তানের গালে লিখে নিলো যে, রাজাকারের ফাঁসি চাই, অমন কচি কণ্ঠ দিয়ে বলিয়ে নিল যে, ফাঁসি চাই, সেই দম্পতির শিক্ষার ঘাটতিটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। সমাজে মূল্যবোধের এই যে বিরাট ধস আমরা সৃষ্টি করেছি, তা থেকে পরিত্রাণের পথ অবিলম্বে বের করতে হবে। তারচণ্য যদি মতলবী ধারার কাছে আত্মসমর্পণ করে তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবেই বিপন্ন হয়ে যাবে। সমাজের বিবেকবান মানুষের কাছে আমাদের আহবান, বড় দেরি হয়ে গেছে। আসুন এখনই এর প্রতিকারের উদ্যোগ নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads