রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৩

৭ মার্চের বিখ্যাত ভাষণ


প্রতি বছরের মতো এ বছরও ২৬ মার্চে শেখ মুজিবের ১৯৭১-এর ৭ মার্চের রেকর্ড করা বক্তৃতা বাজানো হলো আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। যার লক্ষ্য, এ দেশের মানুষকে ১৯৭১-এর চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। এই ভাষণ নিয়ে এ যাবৎ অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এসব আলোচনা যে বস্তুনিষ্ঠভাবে হতে পেরেছে তা নয়। শেখ মুজিব তার এই বিখ্যাত ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কিন্তু সেই সাথে আবার এ কথাও দাবি করেছিলেন যে, তিনি (শেখ মুজিব) হলেন পাকিস্তানের  মেজোরিটি পার্টির নেতা। তিনি বলতে চাননি, তিনি কেবলই বাঙালিদের নেতা। এখন তার এই ভাষণ থেকে কিছু অংশ বাদ দেয়া হয়েছে। তার এই ভাষণে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কিন্তু এই অংশটা এখন আর মানুষকে শোনানো হচ্ছে না। ভাষণটি ছিল বেশ কিছুটা স্ববিরোধী। তবুও অনেক বুদ্ধিজীবী বলছেন, এটি খুবই অর্থবহ ভাষণ। এর মধ্যে নাকি ফুটে উঠেছে হাজার বছরের বাঙালি চেতনা। ৭ মার্চ খুব সকালে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফার্ল্যান্ড। শেখ মুজিবকে ফার্ল্যান্ড বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যদি স্বঘোষিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সমর্থন দেবে না। ফার্ল্যান্ডের এই বক্তব্য শেখ মুজিবকে প্রভাবিত করেছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ৭ মার্চের ভাষণ দেয়ার ঠিক কিছুক্ষণ আগে। ভাষণ দেয়ার পর শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা স্থগিত করে দেননি। ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা কেন ভেঙে গিয়েছিল, তা নিয়ে এখনো কেউ সেভাবে আলোচনা করছেন না। বিষয়টি হয়ে আছে রহস্যঘেরা। শেখ মুজিব আসলে গ্রেফতার হয়েছিলেন, না নিজেই চেয়েছিলেন তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে, সেটা পরিষ্কার নয়। শেখ মুজিবের পরামর্শদাতা এবং আওয়ামী লীগের একজন প্রথম শ্রেণীর নেতা ড. কামাল হোসেন ভারতে না গিয়ে ইচ্ছা করেই চলে গিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ড. কামাল হোসেনকে ঘোষণা করা হয়েছিল পাকিস্তানের চর বা এজেন্ট হিসেবে। এম আর আখতার মুকুল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘চরমপত্র’ নামে ঢাকার আঞ্চলিক বাংলায় কথিকা প্রচার করতেন। এতে তিনি ড. কামাল হোসেনকে, যত দূর মনে পড়ছে, কয়েকবার উল্লেখ করেছিলেন- ‘কামাল্ল্যা’ নামে। যেটাকে আমার কাছে মনে হয়েছিল খুবই অশিষ্ট। কিন্তু পরে দেখা গেল শেখ মুজিব দেশে ফিরে ড. কামাল হোসেনকে করলেন তার মন্ত্রিপরিষদের অন্যতম সদস্য। আর তাকে দিলেন সংবিধান রচনার ভার। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, মরহুম জিল্লুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু তিনি এই বেতার কেন্দ্র পরিচালনায় কতটা সক্রিয় ছিলেন, আমি তা বলতে পারি না। এই বেতার কেন্দ্র থেকে অনেকবার বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে ভিয়েতনামের গেরিলা যোদ্ধাদের মতো। কিন্তু পরে এটা বলা বন্ধ হয়। কারণ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভিয়েতনাম সম্পর্কে এভাবে বলা ভারত সরকার অনুমোদন করতে পারে না। ভারত সরকার কোনোভাবেই প্রশ্রয় দিতে পারে না, ভারতের ভূভাগ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রচারণায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল কলকাতায়। যদিও দাবি করা হতো, এর অবস্থিতি হলো মুজিবনগরে। বলা হচ্ছে, মরহুম জিল্লুর রহমান সাহেব ছিলেন জয়বাংলা পত্রিকার সাথে যুক্ত। তিনি জয়বাংলা পত্রিকার সাথে যুক্ত থাকলেও জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদনা করতেন না। জয়বাংলা ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকাটি চলত বেশ কিছুটা স্বাধীনভাবে। এই পত্রিকা প্রকাশের জন্য অর্থের জোগান দিয়েছিলেন প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক গাজী উল হক। গাজী সাহেব বগুড়ায় অবস্থিত পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের শাখা থেকে প্রায় ৩২ কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। এ থেকে সামান্য কিছু টাকা তিনি প্রদান করেছিলেন জয়বাংলা  পত্রিকা প্রকাশনার জন্য, এই জয়বাংলা  পত্রিকার অফিস ঘরের সাথে লাগোয়া একটা ছোট ঘরে বাস করতেন জিল্লুর রহমান। জয়বাংলা পত্রিকার অফিস ছিল কলকাতার পার্ক সার্কাস নামক এলাকার বালু হক্কাক লেনে। এখানে আসতেন আওয়ামী লীগের অনেক এমএনএ। আলোচনা হতো নানা বিষয়ে। এমন এক আলোচনার কথা মনে পড়ছে আমার। ১৯৭১ সালের ৮ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারি হেনরি কিসিঞ্জার এসেছিলেন রাওয়ালপিন্ডি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছিল আলোচনার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। রাওয়ালপিন্ডি থেকে কোনো একভাবে জিল্লুর রহমান সাহেবের কাছে এই বার্তা এসে পৌঁছেছিল। তিনি চাচ্ছিলেন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। কিন্তু তাজউদ্দীন এতে রাজি ছিলেন না। বেশ কিছু এমএনএ কলকাতা ছেড়ে চলে আসতে চান ঢাকায়। কিন্তু ভারত সরকার তাদের আসতে দেয়নি। জিল্লুর রহমান সাহেবও কার্যত হয়ে পড়েন নজরবন্দী। আমি এসব কথা বলছি এই কারণে যে, শেখ হাসিনা বলছেন, জিল্লুর রহমান সাহেব ছিলেন তার একজন উপদেষ্টা। জিল্লুর রহমান সাহেবকে চিহ্নিত করা চলে না একজন চরমপন্থী নেতা হিসেবে। মনে হয়, শেখ হাসিনার নীতি আজ দেশকে এনে ফেলেছে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। আমার মনে হয় না, মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ হাসিনাকে এভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। একটি দেশে উদার গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য আইন পরিষদ, প্রশাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে থাকতে হয় ক্ষমতার ভারসাম্য। কিন্তু বর্তমানে আমারা বিচার বিভাগের ওপর যেন চাচ্ছি অনেক বেশি গুরুত্ব প্রদান করতে। এটা হয়ে উঠতে চাচ্ছে উদার গণতন্ত্রের পরিপন্থী। আমরা ভাবছি আইনের সার্বভৌমত্ব (Legal Sovereignty) নিয়ে। কিন্তু রাজনীতি শাস্ত্রে লোকায়ত সার্বভৌমত্ব (Popular Sovereignty) বলেও একটি কথা আছে, যা শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে চায় একটি দেশের রাজনীতির ধারাকে। আদালতের রায় গণসার্বভৌমত্বকে অতিক্রম করতে পারে না।

দেশে হরতাল হচ্ছে। হরতালকে বলা চলে গণযুদ্ধ। যুদ্ধ ভালো জিনিস নয়। যুদ্ধে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তবুও যুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আমাদের দেশেও যাচ্ছে না। আইন করে এই সমস্যার সমাধান আসতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। কোনোখানে পড়েছিলামÑ ধর্মঘট অর্থনীতির ক্ষতি সাধন করে। কিন্তু যে ধর্মঘট অর্থনীতির কোনো ক্ষতি সাধন করে না, তা পেতে পারে না সাফল্য। ধর্মঘটের সাথে তার ক্ষতিকারিতা অনিবার্যভাবে জড়িত। যে ধর্মঘট অধিক ক্ষতিসাধনের ক্ষমতা রাখে,  সেটাই পেতে পারে অধিক সাফল্য। আমরা এখন মানবাধিকার নিয়ে যথেষ্ট কথা বলছি। ১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে লিখিতভাবে মানবাধিকারের যে দলিল ঘোষিত হয়, (declaration des droits de l`homme et du citoyen) তাতে বলা হয়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পবিত্র অধিকার জনগণের আছে। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর জনগণের জন্য শান্তি ((Gverre Aux Tyrans. Paix Aux Peuples), এগুলো মানবাধিকারের সাথে একত্রে গ্রথিত। অত্যাচারীকে প্রশ্রয় দিয়ে শান্তি বজায় রাখার প্রয়াস মানবাধিকারের পরিপন্থী। মানবাধিকারকে আমাদের দেশে তথাকথিত সুশীলসমাজ করছেন অপব্যাখ্যা। অত্যাচারীকে প্রশ্রয় দিলে কেবল হতে পারে অত্যাচারের সম্প্রসারণ, যা শেষ পর্যন্ত মানবাধিকারকে খর্ব করে। পত্রিকার খবরে দেখলাম, মরহুম জিল্লুর রহমান তার ছাত্রজীবনে ১৯৪৭ সালে গিয়েছিলেন সাবেক সিলেটে। তিনি সেখানে সিলেটের গণভোটে জনমত সৃষ্টিতে নিয়েছিলেন অংশ। সিলেটে এই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাবেক সিলেট জেলা ভারতের আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত থাকবে না যুক্ত হবে পাকিস্তানের সাথে, সেটা ঠিক করার জন্য। জিল্লুর রহমান চেয়েছিলেন সিলেট জেলার পাকিস্তানভুক্তি। অর্থাৎ এ সময় তিনি ছিলেন বিশেষভাবেই পাকিস্তানপন্থী। সিলেট জেলায় বেশ কিছু দেওবন্দি মাওলানা ছিলেন। দেওবন্দ হলো ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি জায়গা। এখানে আছে একটি বিরাট ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র। এই শিক্ষাকেন্দ্র থেকে সনদপ্রাপ্ত মাওলানাদের বলা হয় দেওবন্দি। দেওবন্দি মাওলানারা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধী। তারা ছিলেন কংগ্রেস দলের পক্ষে। সিলেটে গণভোট হয়েছিল থানাকে একক ধরে। সিলেটে করিমগঞ্জ থানায় ছিল দেওবন্দি মাওলানাদের বিশেষ প্রভাব। এই প্রভাবের কারণেই করিমগঞ্জের বেশির ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন ভারতে যাওয়ার পক্ষে। করিমগঞ্জ থানা যুক্ত হয় আসামের কাছাড় জেলার সাথে। বিষয়টি এখন মনে রাখা আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। কারণ, দেওবন্দের ঐতিহ্যবাহী মাওলানারা এখন বাংলাদেশে করছেন হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনের বিরোধিতা। দেওবন্দি মাওলানারা জিন্নাহ সাহেবকে পছন্দ করতেন না। কারণ, জিন্নাহ ছিলেন শিয়া। দেওবন্দি মাওলানারা মনে করতেন, মুসলিম লীগ হলো শিয়া পরিচালিত একটি দল। তাই এই দলকে উচিত নয় সুন্নি মুসলমানদের সমর্থন দেয়া। চট্টগ্রামের সুন্নি জামাত বলে পরিচিত সংস্থার মাওলানারা সবাই করছেন ভারতঘেঁষা আওয়ামী লীগের সমর্থন। এ বিষয়ে আমাদের হুঁশিয়ার হতে হবে। কারণ এসব মাওলানা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে পুরোপুরি আস্থাশীল নন। এদের আনুগত্য হলো মূলত ভারতমুখী।
দেশে এখন হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়ছে। ভাঙছে হিন্দু দেবমন্দির ও তাতে রক্ষিত বিগ্রহ। এটা কারা করছে আমরা তা জানি না। তবে হতে পারে এটা ভারতের পক্ষের শক্তির দ্বারা পরিচালিত। এর দ্বারা মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে বিদেশি সৈন্য পাঠানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করার চেষ্টা হচ্ছে। হয়তো বলা হবে, বাংলাদেশে হিন্দু নিধন বন্ধের জন্য সৈন্য প্রেরণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাইরের সৈন্য এভাবে বাংলাদেশে পাঠাতে চাইলে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারবে না। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠছে। বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীকে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছেন; কিন্তু সেটা সত্য নয়। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জাতির প্রতি তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন।
আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে। কিন্তু ১৯৭১ আর বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি আদৌ এক নয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশ বলে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু এখন আছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সদাপ্রস্তুত থাকতে হবে। কোনো জাতির জীবনে একটা যুদ্ধ শেষ যুদ্ধ নয়। একটা জাতির জীবনে অনেক যুদ্ধই করতে হতে পারে। শান্তি কামনা করতে যুদ্ধের জন্য সব জাতিকেই প্রস্তুত থাকতে হয়। আমাদেরও থাকতে হবে। অহিংসার আদর্শ খুবই মহৎ। কিন্তু এখনো বিশ্ব পরিস্থিতিতে তা সত্য হয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দেশে যারা অহিংস হওয়ার কথা বলছেন, তারা আসলে সেটা বলছেন জাতি হিসেবে আমাদের দুর্বল করে তোলারই লক্ষ্যে, যেটাকে আমরা অনুমোদন দিতে পারি না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads