অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক কর্তৃক সোনালী ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও ব্যাংকারদের সাম্প্রতিক মতামতকে রাবিশ ও বোগাস বলে মন্তব্য করেছেন বলে জানা গেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরানুযায়ী গত ২৯ মার্চ সিলেট মহানগরীর মদিনা মার্কেটে রূপালী ব্যাংকের ৫১৩তম শাখা উদ্বোধনকালে তিনি এই মন্তব্য করেছেন। বর্তমান সময়ে দেশের অর্থনীতি ইতিহাসের সবচেয়ে ভাল সময় অতিক্রম করছে বলে উলেখ করে অর্থমন্ত্রী আরো বলেছেন, সারা পৃথিবীতে ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি হয়, বাংলাদেশেও হয়েছে। তবে এটা ভয়ঙ্কর কিছু নয়।
অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে আমরা দেশের অর্থখাত বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির সুস্থ বিকাশের পথে একটি ধ্বংসাত্মক ও ভয়ংকর অবস্থান বলে মনে করি। হলমার্কের কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার পর থেকে তার প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমূহ পর্যালোচনা করলে তিনি ও তার সরকারের যে অবস্থানটি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে তা হচ্ছে তাদের প্রতারণা ও জালিয়াতিবান্ধব একটি অবস্থান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্টে সর্বপ্রথম এই জালিয়াতিটি যখন ধরা পড়ে তখন তারা বিষয়টি সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছিল। অর্থমন্ত্রণালয় এই তথ্যের ভিত্তিতে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঐ সময় এই তথ্যটিও প্রকাশিত হয়ে পড়ে যে এই কেলেঙ্কারির সাথে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সম্পৃক্তি রয়েছে। সরকার এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও তদন্ত করেননি কিংবা সংশিষ্টদের বিরচদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থাও গ্রহণ করেননি। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে একটি প্রস্তাব পাঠায়। অর্থমন্ত্রী এই পত্র পাবার পর প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন যে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়ার প্রস্তাব করে আইন ও ক্ষমতাবহির্ভূত কাজ করেছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রস্তাবে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের সংশিষ্ট ধারা উলেখ করেই প্রস্তাবটি করেছিল। এই অবস্থায় অর্থমন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপরীতমুখী অবস্থান পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটায়। দুর্নীতিবাজ ও জালিয়াতরা উৎসাহিত হয়ে পড়ে। এই জালিয়াতির সাথে অর্থমন্ত্রণালয় ও সরকারের শীর্ষ মহলের সম্পৃক্তি এতই নিবিড়ভাবে ধরা পড়ে যে সোনালী ব্যাংক এবং হলমার্কের সংশিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরচদ্ধে মামলা করা হবে কিনা তা নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। দুদক এর দায়ভার সোনালী ব্যাংকের দিকে ঠেলে দেয়, আবার সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা কর্তৃপক্ষ এর দায়িত্ব তার নয় বলে ঘোষণা করেন। আবার সরকারের পক্ষ থেকে কেউ কেউ এ কথাও বলতে থাকেন যে মামলা সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, সরকার অর্থ আদায়ের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছেন। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে এই মর্মে মন্তব্য করেন যে সোনালী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা একটি সামান্য ব্যাপার মাত্র। ৪০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের মধ্যে এটি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার মাত্র। তার এই ঘোষণা দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং সংসদ অধিবেশনে তার অর্থাৎ সরকার দলীয় সাংসদরা অর্থমন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। তার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি পান। পরবর্তীকালে তিনি বেশকিছু কাল এ ব্যাপারে চুপ ছিলেন এবং এক পর্যায়ে দুই মাসের মধ্যে হলমার্কের কাছ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা আদায় হয়ে যাবে বলে জাতিকে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। হলমার্কসহ দুর্নীতি ও জালিয়াতির আরো অসংখ্য ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য সরকার বিভিন্ন ইস্যুর সৃষ্টি করে মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন এবং সোনালী ব্যাংক ও হলমার্কের কিছু কর্মকর্তার বিরচদ্ধে সরকারকর্তৃক মামলার নাটক করে প্রতারণার নতুন কৌশলের আশ্রয় নেয়ারও প্রশ্ন উঠেছে। অর্থমন্ত্রী এখন নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি বলছেন যে, হলমার্ককে নতুনভাবে ঋণ দেয়া প্রয়োজন এবং হলমার্ক নিয়ে যেসব ব্যাংকার ও বুদ্ধিজীবী পত্রপত্রিকার প্রকাশিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং টেলিভিশন চ্যানেলের টকশো’তে বিরূপ মন্তব্য করছেন তারা দেশের শত্রচ, তাদের মন্তব্য রাবিশ ও বোগাস। যারা জালিয়াতি-দুর্নীতির বিরচদ্ধে কথা বলেন এবং এর অবসান চান তারা যদি দেশের শত্রচ হন তা হলে বন্ধু কারা আমরা জানি না। তবে অর্থমন্ত্রী যে তার আচার আচরণ ও দেশের অর্থনীতি পরিচালনায় যে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন তাতে তিনি ও তার সরকার দুর্নীতি ও জালিয়াতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলেই মনে হয়। এই অবস্থান দেশের বন্ধু হবার অবস্থান হতে পারে না। অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য এবং পদক্ষেপ অর্থখাতকে ধ্বংস করবে বলেই আমরা মনে করি। এই দুর্নীতির বিচার না হলে দাবানলের ন্যায় তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে যা কারচরই কাম্য নয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন