ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করা কিংবা পূর্বাভাস দেয়া এখনো কিছুটা কঠিন। দেশের জনগণের ওপর এখনো কোনো রাজনৈতিক শক্তির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেই। বেশির ভাগ মানুষ দলনিরপেক্ষ অবস্থানে থেকেই পরিবর্তনকামী হয়ে উঠেছে। সরকারি দলের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে, অপরপক্ষে বিরোধী দলের ডাকে মানুষ সাড়া দিতে শুরু করেছে। এই অবস্থাকে একটি অনিবার্য পরিবর্তন, গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে দেখা হয়। সেই পট পরিবর্তন কখন কিভাবে হবে, সেটা বলা যেমন সহজ নয়; তেমনি গুণগত পরিবর্তনের বিবেচনায় কতটা আদর্শিক ও গুণগত পরিবর্তন হবে সেটাও আগাম মন্তব্য করা অসম্ভব। এখন প্রশ্ন উঠতে পারেÑ কী ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। একটা পরিবর্তন হতে পারে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনার নিরিখে। সেই সমঝোতা হতে পারে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থা করে কিংবা সকল বিরোধী দলের দাবি মেনে নেয়ার মধ্য দিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিরোধী জোট কার্যত সমঝোতা কিংবা নো রিটার্ন অবস্থায় পৌঁছে গেছে। বিরোধী ১৮ দলীয় মোর্চা এক দফার আন্দোলন অর্থাৎ সরকার পতনের ডাক দিয়ে জনগণকে রাজপথে নামার আহ্বান জানিয়ে নিজেরাও রাজপথে নেমে পড়েছে। সব নেতার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার প্রেক্ষাপটে তাদের আর কী-ই বা করার আছে। সরকার যদিও শিকড়বিহীন কোনো গাছ নয়, যে হেঁচকা টান দিলেই উপড়ে ফেলা যাবে। আবার এতটা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যে, সরকার কোণঠাসা হতে হতে নিজস্ব ব্যর্থতার ভারে পড়ে গেলে জনগণ রক্ষা করতে আর এগিয়েও আসবে না। নিয়মতান্ত্রিক এ প্রক্রিয়া কাজ না করলে দেশবাসী না চাইলেও একটি অনিবার্য ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করবে। সে ক্ষেত্রে সামাজিক শক্তির যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে দেয়ার দায় ছিল সেটা তারা অংশত পূরণ করেছে। বিশেষত আলেম-ওলামারা নিজেদের কর্তব্যকর্মে কোনো আপস করেননি। তারা রাজনীতির পঙ্কিল পথে যাবেন না, ঈমানের ব্যাপারে ছাড়ও দেবেন না। সুশীলসমাজ এবার কোনো ভূমিকা রাখেনি, রাখবে না। এই শূন্যতা পূরণে অবশিষ্ট থাকে তৃতীয় শক্তির অভ্যুদয়।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের প্রধান নৈতিক শক্তির উৎস জনগণের সমর্থন। যেকোনো দল ও সরকারের রাজনৈতিক শক্তি বিশ্বাসযোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চাদরে ঢাকা গণমুখী রাজনীতি। অর্থনৈতিক শক্তির দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রমাণ, উন্নয়ন ও অগ্রগতির অব্যাহত বেগবান ধারা। সামাজিক শক্তির প্রমাণÑ সামগ্রিক নিরাপত্তা, আইনের শাসন, ন্যায়-ইনসাফ ও বিচার বিভাগের ওপর নির্ভরতা; যা ৯০ ভাগ অনুপস্থিত। কূটনৈতিক শক্তির প্রমাণ বহুমুখী বন্ধুত্ব এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও ফোরামের সমর্থন। এ ক্ষেত্রে সরকার নিন্দিত, সমালোচিত, অসহায় ও বন্ধুহীন। তা ছাড়া বর্তমানে সরকার এসব শক্তির সবটুকু সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। সাংবিধানিক কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপরই সরকারের সামগ্রিক অর্থে কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাধীনও নয়। অতি নিয়ন্ত্রণের কারণে সেসব প্রতিষ্ঠান এতটা আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করার অবস্থানে নেই। একমাত্র কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীটি এখনো টিকে আছে। তারা মনে করে, সরকার টিকে থাকার ওপরই তাদের ভাগ্য নির্ভর করছে। সরকারের পতন মানে তাদের ভাগ্যের পতন। সুযোগ-সুবিধা হারানোর ভয় থেকে তারা শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষপুটে থাকতে চাইবে। যদিও কোনো কোনো অতি উৎসাহী লোকজন পিছুটান দিতে শুরু করেছে। বিদেশে গা-ঢাকা দেয়ার খবরও রটছে।
এ পর্যন্ত আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর করার একটি দুঃস্বপ্ন বাস্তবায়নের জবরদস্তি থেকে শুরু করে সর্বশেষ শাহবাগ মঞ্চ হয়ে শাপলা চত্বর মহড়া পর্যন্ত সব নাটকের স্ক্রিপ্ট জনগণের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। প্রমোটরদের পরিচিতিও আড়ালে নেই। পদ্মা সেতু নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নের খোশগল্প কেলেঙ্কারি আড়াল করেনি। জনগণকে প্রবোদ দেয়ার নাটুকেপনাও জনগণের কাছে লুকোনো নেই। যদিও সরকার কাকের মতো আচরণ করছে। কাক খাদ্য লুকোয় চোখ বন্ধ করে। মনে করে কেউ দেখছে না। বাস্তবে সবাই দেখতে পায়। শুধু দেখতে পায় না যে কাকটি খাদ্যটি লুকিয়েছে।
শাহবাগ নাটকটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য সরকারের দিক থেকে প্রচুর কসরৎ করার চেষ্টা-তদবির ছিল। অনেক সন্তর্পণে দূর থেকে সমর্থনও নিশ্চিতভাবে এসে পড়েছিল। দিল্লি-কলকাতাও পাশে দাঁড়িয়েছিল। মঞ্চের নট-নটিরাও ভালোই করছিল। প্রমোটরদের আড়ালে রাখার চেষ্টায় তারাও কম ত্রুটি করেনি। বিধিবাম। রাখে আল্লাহ মারে কে। কিংবা মারে তো আল্লাহ ঠেকায় কে। শেষ পর্যন্ত সবাই ধরা পড়ে গেছে। জনগণ প্রতারিত হওয়ার ক্ষোভ প্রশমনের একটা পথ খুঁজে নিয়েছে। বয়স্কদের অনুতাপ, নতুন প্রজন্মকে কী গল্পই না সরকার শোনাল। নতুন প্রজন্মের যে অংশটি নিখাদ দেশপ্রেম থেকে মাথায় পট্টি বেঁধে কোরাসে অংশ নিয়েছে, তারা বিশ্বাসহন্তাদের ড্রাকুলার চেয়েও ঘৃণার চোখে দেখছে। নতুন প্রজন্ম জানল সরকার কত রঙ্গ জানে, সর্বত্র জাল ফেলে কোথায় বসে টানে।
একজন জ্ঞানপাপীকে দিয়ে শাপলা চত্বরে সাজানো নাটকটাও মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনায় কোনো খাদ ছিল না। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, নিñিদ্র নিরাপত্তা, লোক সরবরাহের প্রস্তুতিতেও কোনো কমতি ছিল না। এখানেও বিধিবাম। এমনটি হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। দেশের মূল ধারার সব আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখ চিহ্নিত জ্ঞানপাপীর স্বরূপ জানতেন। তারা শুধু বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিহত করার জন্য রাস্তায় নামতে হয়নি। জনগণ ঘৃণার থুথু ও অবজ্ঞার বিষ্ঠা ছিটিয়ে পুরো নাটকের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছে। তার পরও খলের ছলের অভাব হয় না। শয়তান যেমন বহুরূপী সেজে বারবার পাপ-পঙ্কিলতার দিকে মানুষকে টানতে চায়, ওইসব জ্ঞানপাপীও দরবারি আলেম নামের কলঙ্কদের মানুষ ওয়াক থু বলে প্রত্যাখ্যানের পরও আবার তাদেরকে অন্য কোথাও ভিন্ন রূপে ছদ্মবেশে প্রত্যক্ষ করা যাবে। এসব জ্ঞানপাপী ও বকধার্মিকদের এজিদি ধারার মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে হয় না, আবদুল্লাহ বিন ওবাইর মতো মুনাফেক সরদার বলে গালিও দিতে হয় না। গ্রহণযোগ্য আলেম-ওলামারা জনগণকে সতর্ক করে দেয়াই যথেষ্ট, যা আমরা এবার প্রত্যক্ষ করলাম। এটাই সঠিক ও মূল ধারার আলেমদের কারিশমা ও গ্রহণযোগ্যতার বড় দলিল ও প্রমাণ।
এবার সরকার প্রথমেই মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাণিজ্যের বেসাতি করার চেষ্টা করেছে। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের বৃন্তচ্যুত পথে টানার একটা অনৈতিক ও নোংরা রাজনৈতিক খেলায় মাতিয়ে তুলতে চেয়েছে, জাতির কপাল ভালো মুক্তিযোদ্ধাদের যে অংশটি এখনো বিবেক বিক্রি করেনি, আত্মপ্রবর্তক সাজেনি। তারা ঘৃণা ছড়ানো ও জাতিকে বিভক্ত করে দেয়ার বিষয়টি মানতে পারেননি। ফলে রাজাকার বলে ধিক্কার দেয়াকে সহ্য করেও পুরো ইস্যুটিকে ভণ্ডুল করতে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। পাপ যেমন বাপকেও ছাড়ে না, তেমনি গ্রহণযোগ্য আলেম-ওলামারা ছাড়েননি এই মাটির রূপ-রস ও গন্ধমাখা মানুষের ঈমানি চেতনাকেÑ পাহারা দেয়ার মহান কর্তব্যকর্মটিকেও ইবাদত ভেবেছেন। অথচ এসব আলেমের কেউ রাজনীতির বরপুত্র নন। কিন্তু সামাজিক শক্তি হিসেবে অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী। তারা বিপদে-আপদে, সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে আবহমানকাল থেকে জনগণের পাশে এসে দাঁড়ান। এবারো যেমনটি দাঁড়িয়েছেন। তারা সব ষড়যন্ত্র রুখে দিলেন।
এক সময় খানজাহান আলীর কাহিনী পড়েছি। পড়েছি বারো আওলিয়ার লোকগাথাও। শাহজালালের ইতিহাসও জানার চেষ্টায় ত্রুটি করিনি। বুঝতে চেয়েছি শাহ মখদুমের জীবনকথাও। ইতিহাস পড়ার তাগিদেই এ দেশের সব জাতীয় বীরদের স্মৃতি তর্পণের একটা সুযোগও মিলেছে। নবাব সলিমুল্লাহ, সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, ওসমানী, জিয়াসহ এ জনপদের সব সাহসী মানুষের জীবনকথা জানার চেষ্টা করেছি। বুঝতে চেয়েছি তিতুমীর থেকে ুদিরাম, প্রীতিলতা থেকে রোকেয়া, শামসুন্নাহার মাহমুদদের জীবনচরিত। লালন-আব্বাস-জসীমউদ্দীন, আবদুল আলীম, নজরুল-ফররুখ, মুন্সি মেহেরউল্লাহ, হাজী শরিয়ত উল্লাহর কথাও আড়ালে রাখিনি। সব সময় মনে হয়েছে, এই জনপদের মাটির নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষদের স্বভাবধর্মে শহীদ-গাজীর রক্তধারা প্রবহমান। সেই বৈশিষ্ট্যের গুণাগুণ ধারণ করেই এই মানচিত্রের মানুষদের রাজনৈতিক স্বভাবধর্মও গড়ে উঠেছে। যে শাসকেরা সেটা বোঝার চেষ্টা করেনি, বরং ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতি গ্রহণ করেছে; তারা টেকেনি। সেনদের না টেকার কারণ এই মাটি ও মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। পালরা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল মানুষের স্বভাবধর্মের প্রতি সহমর্মী ছিল বলেই। সুলতান-নবাবেরাও টিকে ছিলেন এই মাটিকে পাটি পাতা জায়নামাজের মতো পবিত্র জ্ঞান করার জন্যই। বর্গি-হার্মাদরা টিকতে পারেনি পাঞ্জাবি শাসনের মতো আচরণের জন্য এবং দস্যুবৃত্তিকে ঠাঁই দেয়ার কারণে। ইংরেজরা টেকেনি এই মাটি ও মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে টিকে থাকতে চাইবার বদখাসলতের কারণে। ইংরেজদের সাথে সভ্যতা ছিল, ইউরোপীয় মূল্যবোধ ছিল; কিন্তু মুসলিমবিদ্বেষ ও দ্বিমুখী নীতির কারণে জাতিকে ভাগ করে তারা নিজেদের পতন ত্বরান্বিত করেছে।
আজ ইংরেজ শাসকদের ভাগ করো শাসন করো নীতির কী বিষাক্ত ছোবলই না প্রত্যক্ষ করছি! কালনাগীনের জন্য যারা বিষের বাঁশি বাজাচ্ছে, তারা যতক্ষণ না দংশনে ও বিষের হলাহলে নিঃশেষ না হবে তত দিন মানুষের ওপর গজবের মতো শাসন-শোষণ চলবে। গুলি করে হত্যা করবে মানুষ, প্রজাতন্ত্রের সন্তানতুল্য নাগরিকদের সাজাবে জামায়াত-শিবির, মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, জঙ্গি, তালেবান; আরো বেশি মাত্রায় বিষ ছড়াবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে দেয়ার জন্য। দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কী মারণ খেলাই না শুরু করা হয়েছে। আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের উত্থান ও প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য সংখ্যালঘু ইস্যু যে খাড়া করা হয়েছে, তা বোকাও টের পেয়েছে। যে নাটক শাহবাগে ব্যর্থ হয়েছে, যে মহড়া শাপলা চত্বরে ভণ্ডুল হয়েছে; একইভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট ও বিষবাষ্প ছড়িয়ে ফায়দা তোলা এবং রাজনীতি করার খায়েশও ভণ্ডুল হতে বাধ্য। শুধু সময়ের অপেক্ষা। সর্বপ্রকার হঠকারিতা পরিহার করে দায়িত্বশীলতা প্রদর্শনে সক্ষম হলে সময় মজলুমের জন্যই হাতছানি হয়ে আসবে। জালিমের ওপর মজলুমের, দুর্বিনীত শাসকের মোকাবেলায় শাসিতের, অসত্যের বিপরীতে সত্যের জয় অবধারিত।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন