শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০১৩

আমরা আইন বুঝি না বলেই, আইনের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন



প্রতিনিয়ত আমরা যে কথাগুলো শুনে আসছি তা হলো, আইন সবার জন্য সমান, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আইন কাউকে খাতির করবে না। আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছি, সন্ত্রাসী যে দলেরই হোক তাদেরকে আইনের কাছে হস্তান্তর করা হবে, সন্ত্রাসীদের কোন দল নেই আরো কত কথা। আদালতের বিরচদ্ধে কথা বলা যাবে না, বিচারপতিগণ নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত এবং চাপেরমুখে নতি স্বীকার করবেন না ইত্যাদি। পুলিশ বাহিনী শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। তারা কারো শত্রচ নয় বরং সকলেরই বন্ধু। জনগণ, পুলিশ ও সরকার মিলে সম্মিলিতভাবে একটি সুন্দর দেশ গঠন করবো, বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো। উপযুক্ত কথাগুলো শুনতে কার না ভালো লাগে। এ ভালো লাগা কথাগুলো কল্পনা করছিলাম গাজীপুরের টঙ্গীর পাগাড় নামক স্থানের পাগাড় মডেল স্কুল এন্ড কলেজের সামনে বসে। এরই মধ্যে স্কুলের কিছু ছাত্র-ছাত্রী রাস্তায় বেরিয়ে আসলো এবং ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস পালনের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছিলো। মহড়ার এক পর্যায়ে জাতীয় সঙ্গীত শুরচ হলো এটাও ছিলো গ্রচপ বাছাইয়ের মহড়া। একটি গ্রচপে তিনজন ছিলো- নাফিসা আহমদ দোল ৭ম শ্রেণী. মুজাহিদুল ইসলাম ৫ম শ্রেণী, অন্যজনের নাম স্মরণ নেই। তারা যে মনের মাধুরী মিশিয়ে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করলো আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। মোবাইলে রেকর্ডও করলাম। এর পর বার বার তা বাজিয়ে শুনছি। আমি বুঝাতে পারবো না তাদের কণ্ঠ কতটা সুন্দর। ওদের গান শুনে চলে গেলাম কল্পনার জগতে এই সোনার বাংলাই তো চেয়েছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বলেছেন-‘‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।’’ মনে হয় একথা বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে সুবিশালভাবে বাসা বেঁধেছিলো। এ কারণেই হয়তো তিনি রূপক অর্থে মা অর্থ দেশ আর দেশের সংকটে চোখের পানি আসার কথাটা অত্যন্ত প্রিয় বাক্য মনে করেছেন এবং বিশ্বাস করতে প্রত্যেকটি নাগরিকই দেশের সংকট দেখলে চোখের জলে ভাসবে। তাই তিনি বলেছিলেন আসুন সবাই মিলে দেশটাকে গঠন করি। আমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে হবে আজ কি দেশ গঠন হচ্ছে? বিশ্বের দরবারে কি আমাদের মাথা উঁচু হচ্ছে, না কি আমরা আজ বিশ্বের একশ্রেণীর শাসকদের নিকট অপরিপক্ক রাজনীতিবিদ আর অন্যশ্রেণী অর্থাৎ মুসলিম দেশগুলোর নিকট পরিচিত হচ্ছি ইসলামবিরোধী সরকার হিসেবে। এতে কি আমাদের সম্মান বৃদ্ধি পাচ্ছে? পক্ষে হলে হ্যাঁ বলুন আর বিপক্ষে হলে না বলুন। আজ তুরস্কে লক্ষাধিক লোক বিক্ষোভ করছে বাংলাদেশ সরকারের বিরচদ্ধে। তারাও কি রাজাকার? বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বিশ্বের এ প্রতিক্রিয়া অবশ্যই গুরচত্বের সাথে দেখতেন। রাজনীতিতে শিশু যারা তারা এসবের কেয়ারই করেন না। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তাই আক্ষেপ করে তার নেতার কাছে চিঠি লিখেন- ‘‘পিতাকে পুত্রের চিঠি’’ এ ভাষায়। পত্রিকার পাতায় এ শিরোনামে লিখা প্রবন্ধ খুবই জনপ্রিয়। তিনি বলেন, ‘‘পিতা তুমি যদি আজ তোমার মেয়ের কার্যক্রম দেখতা তাহলে বলতে এটা আমার তৈরি সেই আওয়ামী লীগ না। আজ তোমার মেয়ের কাছে মুরচববীদের কোন সম্মান নেই’’। যাই হোক আমরা যে সোনার বাংলা কল্পনা করি সত্যিকার অর্থে যদি তা করতে চাই তবে জাতীয় ঐক্য, রাজনৈতিক সহনশীলতা দেশরক্ষা, দেশগঠন ও বিশ্বের কাছে সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত হতে হলে সকলে মিলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশকে গড়তে হবে। দেশ কোন একটি দলের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। আইনের দোহাই দিয়ে অন্যকে ঘায়েল করার পরও পার পেয়ে যাচ্ছেন কারণ দেশের সাধারণ জনগণ আইন বুঝে না। আমরা যখন শুনি সব কিছুই আইন সম্মতভাবে করা হবে তখন নিশ্চিন্তে নিন্দ্রা যাই। করারই বা কি আছে? আইনের দোহাই দিয়ে আইন বিরোধী কাজ করলেও কিছু বলা যাবে না কারণ কোর্টের বিরচদ্ধে কথা বলার অপরাধে অপরাধী হতে হবে। অথচ আমাদের মহান সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকার এর অধ্যায়ে বলা হয়েছে ‘‘প্রত্যেক নাগরিক-এর সভা, সমিতি, মিটিং, মিছিল করার অধিকার থাকবে।’’ বর্তমানে কি তা হচ্ছে? বলতে হবে হচ্ছে। সাথে একটা না লাগালে কোর্টের বিরচদ্ধে বা সংবিধান বিরোধী বক্তব্য হয়ে যাবে সে ভয়ে আমি না লাগালাম না। সংবিধানের ৯৪-৪/৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে ‘‘প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতিগণ তাদের বিচারাধীন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করবেন কেউ হস্তক্ষেপ করবে না।’’ আমরা কি তাই দেখছি বিচারপতিগণ কি তাই করছেন? কোন প্রকার চাপ নেই, প্রেসার নেই, হুমকি নেই, লোভ বা অন্য কোন কিছুর নিকট তারা বন্দী নন, কেবল মুক্ত মনে নিরপেক্ষ রায় দিয়ে যাচ্ছেন যেমনটি দিয়েছেন বিচারপতি খাইরচল হক তাই না। এ ব্যাপারে কিছু বলবো না তা হলে আদালত অবমাননা হবে। তবে বিচার পতি মোঃ নিজামুল হক পদত্যাগ করেছেন কি বলে সে চিঠি আমার দেখার কথাও না আবার প্রয়োজনও নেই যা দেখলাম ইন্টারনেটে এবং পত্রপত্রিকায় সেখানে তিনি বলেছেন ‘‘গভর্মেন্ট চায় একটা রায়। গভর্মেন্ট গেছে পাগল হয়ে।’’ এ থেকে কি আমরা বুঝতে পারি দলীয় সরকারের আমলে বিচারপতিগণ নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেন যা পারছেন। কোন বিচারপতিকে অপসারণ বা অব্যাহতি দেয়ার কোন বিধান নেই অনুচ্ছেদ ৯৬ (২) তবে ৯৬-৫(ক) এখানে বলা আছে শারীরিক অক্ষমতা ও অসদাচারণ প্রমাণিত হলে নিজে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারবেন এবং অসদাচারণের দরচন অপসারণের ব্যবস্থা রয়েছে তা আবার ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ২ জন সিনিয়র বিচারপতির মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে হবে। মজার ব্যাপার হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য আবেদন করবেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিবর্গ। অথচ প্রতিষ্ঠিত সরকার কি এ আবেদন গ্রহণ করবেন না কি আবেদন পাওয়ার সাথে সাথে খারিজ করে দেন? এ মন্তব্যও পাঠকগণ করবেন। মন্তব্য করে আইন ভঙ্গ করতে চাইলে ট্রাইব্যুনালে একজন বিচারপতি বলেছিলেন ‘‘আমাদের কাছে জাস্টিস পাবেন না আমরা এখানে জাস্টিস করতে বসিনি।’’ এ বক্তব্য কি আইন সঙ্গত হল? না হলে কি তার বিরচদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের আবেদন করতে কেউ সাহস করেছে? যদি আইন আইনের গতিতে চলে তবে কেউ আইনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বললে যদি তিনি বিচারপতি হন তা হলে ৯৬(৬) ধারা অনুযায়ী তার বিরচদ্ধে তদন্তের উদ্দেশ্যে পরোয়ানা জারি করা যাবে। অপরাধী প্রমাণিত হলে ৯৬-৫ (গ) অনুযায়ী তাকে অপসারণ করা যাবে অথবা ৯৬(৭) ধারায় স্বেচ্ছায় পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে সসম্মানে তিনি পদত্যাগও করতে পারেন। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় তা কি হচ্ছে? এরপরও আমরা বলছি বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা রয়েছে। প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছিলেন ‘‘বিচারকগণ রায় দেন আইনজীবীকে তা দেখে আবার আইনজীবীরাও কোন কোর্টে গেলে পক্ষে রায় পাবেন সেভাবে কোর্ট নির্বাচন করেন।’’ এ বক্তব্যের দরচন কিন্তু ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে আইন বা কোর্টের বিরচদ্ধে কথা বলেছেন বলে অভিযোগ করা হয়নি। অতএব কথা বলার অধিকার আমাদেরও রয়েছে। হতে পারে কিছু ত্রচটি বিচ্যুতি কারণ আমরা সাধারণ জনগণ আইন বুঝি না এটা শিরোনামেই বলেছি। আমাদের কোর্টে একটি মামলা চলাকালীন এ মামলাটি অন্যকোর্টে বা বেঞ্চে স্থানান্তরের জন্য আবেদন করার বিধান রয়েছে। আর এ সুযোগেই কোন আইনজীবীর সাথে কোন বিচারক বা দফতরিক কর্মীর সম্পর্ক ভালো সে দিকে লক্ষ্য রেখেও মামলা স্থানান্তর করা হয়ে থাকে, সারাজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে বলেই ব্যারিস্টার রফিক উল হক সাহেব এ কথাটা বলেছেন। শেষ করতে চাই ভিন্ন একটি কথা দিয়ে জনাব আব্দুল কাদের মোল­vর সারাজীবন জেলের রায় হওয়ার পর শাহবাগে আন্দোলনকারীরা বললো এ রায় মানি না আবার জামায়াতের লোকেরাও বললো এ রায় মানি না। তবে আদালত অবমাননার অপরাধে জামায়াত নেতারা অপরাধী হবে অন্যদিকে শাহবাগপন্থীরা অপরাধী হবে না এটাই আইনের নিরপেক্ষতা? আন্তর্জাতিক পত্রিকা দ্যা ইকোনোমিস্ট বললো ‘‘বাংলাদেশে একটি আদালত বসানো হয়েছে তার নাম দিয়েছে তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অথচ তারা বিচার করছে দেশীয় আইনে’’ এ কথার জন্য তারা অপরাধী হলো না, জামায়াত নেতারা কিছু বললেই ট্রাইব্যুনালের বিরচদ্ধে কথা বলা হয়। বিচারপতি নিজামুল হক যে বল্লেন, ‘‘সরকারের গেছে মাথা খারাপ হয়ে তারা কেবল একটা রায় চায়’’। একজন বিচারপতি হয়ে সরকারের এমন ভাবমূর্তির হানি ঘটালেন এ জন্য তার বিরচদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হল না। সব দোষ জামায়াত নেতাদের। পুলিশ শান্ত মাথায় শিবির নেতা-কর্মীদের ধরার পর ঠান্ডা মাথায় গুলী করে। পল্টনে একটি বিল্ডিং-এর ছাদ থেকে পড়ে মারা যায় একটি ছেলে। জানা যায়, ছেলেটি শিবিরের সদস্য এবং মেধাবী ছাত্র। সে নাকি ছাদ থেকে লাফ দিবে তা আবার ৬ তলা। এখানেও শিবির বলছে পুলিশ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। এর পরও কোন অপরাধ হয় না- সব অপরাধ কেবল শিবির নেতা-কর্মীদের। আজ শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সব জায়গার অবস্থা একটাই তা হল কেবল জামায়াত-শিবির, বিএনপি, মাহমুদুর রহমান এদের অপরাধই অপরাধ আর সরকার দলীয় উপর-নিচ, শাহবাগ আন্দোলন, সরকারি ইসলামিক মুখপাত্র মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ও মেসবাহুর রহমান যা বলে আর যা করে সব জায়েজ কেবল সরকারের সমালোচকগণ যা বলে আর করে সব নাজায়েজ। এ হলো আমাদের বর্তমান অবস্থা। এমন একটি সংকটাপন্ন অবস্থায় মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগ, যে বিচার বিভাগ প্রধানমন্ত্রীকেও ছাড় দেয়ার কথা নয়। অথচ আজ আমরা দেখছি কোন্ চিত্র। এরপরও কোনো কথা বলা যাবে না যদি হও সরকার বিরোধী। সবই বলা যাবে যদি হয় সরকারের পক্ষে। এমন অবস্থার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। তবুও সবই আইনমতো হচ্ছে বলে সাধারণ জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে অন্ধ বানিয়ে রাখছেন। কারণ আমরা সাধারণ জনগণ আইন বুঝি না বলেই আইনের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads