গণতন্ত্র সম্পর্কে লিঙ্কনের বিখ্যাত উক্তি Ôthat government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the earthÕ পৃথিবীর প্রায় সব শিক্ষিত মানুষেরই জানা আছে। যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেকজন প্রেসিডেন্ট উইলসন আহ্বান জানিয়েছেন ÔThe world must be made safe for democracy.Õ কেন এই আহ্বান? কারণ এর বিপরীত অবস্থাটি হলো ফ্যাসিবাদ বা একনায়কতন্ত্র। Winston Churchill একনায়কতন্ত্রের বর্ণনাটি দিয়েছেন Dictatorship– a fetish worship of one man– is a passing phase. A state of society where men may not speak their minds, where children denounce their parents to the police… such a state of society cannot long endure. একনায়কত্বের পরিণতি সম্পর্কে আরেকজন মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট বলেন Ôthe ultimate failures of dictatorship cost humanity far more than any temporary failure of democracy.Õ বাংলাদেশের জনগণ বিষয়টি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ও সচেতন রয়েছেন।
পাকিস্তানি শাসনামলে এ দেশের মানুষ একনায়কত্বের যন্ত্রণা ভোগ করেছেন দীর্ঘ দিন। প্রধানত সে কারণেই বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। গণতান্ত্রিক একটি সমাজব্যবস্থাÑ গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য। পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের মানুষের সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাধা আসছে বারবার। ১৯৭৫-এ বাকশালরূপী একনায়কত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল এ দেশের মানুষের ওপর। শৃঙ্খল ভেঙে গণতন্ত্র নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দেশের। একনায়কত্বের ভূতকে সম্পূর্ণ বিতাড়িত করা সম্ভব হয়নি। দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৮২ সালে আবার একনায়কত্বের দানব চেপে বসল আমাদের ঘাড়ে। কিন্তু মানুষ আবার সক্রিয় হলো। ভূত বিতাড়িত হলো। কিন্তু ফ্যাসিবাদের অপচ্ছায়া আমাদের পিছু ছাড়ছে না। বহুল আলোচিত ১/১১-তে আমরা এর উত্থানচেষ্টা দেখেছি। কিন্তু পুরোপুরি সফল হতে পারেনি সে অপচেষ্টা। দেশের এক পত্রিকাসম্পাদক দাবি করেছিলেন, ১/১১ নাকি তাদের আন্দোলনের ফসল! সেই আন্দোলনে যে বিদেশী চক্রের হাত ছিল তা তো এখন সর্বজনবিদিত। এভাবেই চলছে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত বাংলাদেশকে নিয়ে। স্বাধীনতা অর্জনের পর ৪১ বছর ধরে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান নিশ্চিতভাবেই অনেক সন্তোষজনক মানে থাকত। কিন্তু তা হয়নি। বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিঘিœত হওয়ার কারণে।
অতিসম্প্রতি কিছু কিছু লোকের মুখে আবার শোনা যাচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার দাবি। কোনো দল নিষিদ্ধ করা কখনোই গণতান্ত্রিক কার্যক্রম হতে পারে না। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই হচ্ছে সব মতবাদ প্রচার করতে দেয়া। কোন মতবাদ গ্রহণীয় আর কোনটি বর্জনীয়, তা বিচার করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। এর ব্যত্যয় ঘটলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। জামায়াতে ইসলামী একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। ধর্মভিত্তিক দল বর্তমান পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। পশ্চিম ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। জার্মানির একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নাম ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে হিন্দু মহাসভা, শিবসেনা, রাষ্ট্রীয় সেবক সঙ্ঘ, মুসলিম লীগ প্রভৃতি রাজনৈতিক দল রয়েছে। ধর্মভিত্তিক দল যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় থাকতেই পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ ধর্মবিশ্বাসী। জামায়াতে ইসলামীকে আইন করে অথবা আইন প্রয়োগ করে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হলে তা হবে ফ্যাসিবাদী কাজ। এ প্রয়াস প্রমাণ করবে, জনগণকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে জনগণের ওপর আস্থা স্থাপন করা হচ্ছে না। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কোনো রাজনৈতিক দলকে এভাবে নিষিদ্ধ করা যায় না এবং তা করা সমীচীন নয়। এ ধরনের পদক্ষেপ গণতন্ত্রকে অকার্যকর করবে।
শুধু একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার কথাই নয়, একটি দলের কিছু অনুসারী এবং শাহবাগ মোড়ে সমবেত কিছু তরুণ দেশের একটি প্রধান বাংলা দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া এবং পত্রিকাটির সম্পাদককে গ্রেফতার করার দাবি করছে। এ সবই হচ্ছে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক দাবি। পরিতাপের বিষয়, এসব দাবির মাধ্যমে মূলত আবার ফ্যাসিবাদী শাসন প্রবর্তনের ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। অবাধে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হতে পারে না। এ কথাটি যারা জানে না বা জেনেও না জানার ভান করছে, তারা কখনোই গণতন্ত্র চায় নাÑ গণতন্ত্র তাদের কাম্য নয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত এ দেশের মানুষের দাবি ছিল গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এ দাবি থেকে বাংলাদেশের মানুষ কখনোই পিছপা হয়নি, হবে না। গণতন্ত্রের ওপর আঘাত প্রতিহত করতে মানুষ প্রস্তুত থাকবে।
১৯৭২-১৯৭৫ সময়ের শাসনামলে এ দেশে তখনকার সরকারের স্বীকারোক্তি মোতাবেক দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করেছিল ২৭ হাজার মানুষ। কিন্তু বাস্তবে মৃত্যুবরণ করেছিল লক্ষাধিক মানুষ। আর রক্ষীবাহিনী নামক খুনি বাহিনীকে দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল প্রায় ৪০ হাজার যুবককে, যাদের বেশির ভাগই মুক্তিযোদ্ধা এবং জাসদ নামক একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক। পরবর্তীকালে সামরিক শাসকের আমলে সেলিম, দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়াসহ অনেক তরুণকে হত্যা করা হয়। ডা: মিলনকেও হত্যা করা হয় সে সময়েই। এখন আবার ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে হত্যা করা হয়েছে অনেক তরুণকে। এ সবই স্বৈরাচারের বহিঃপ্রকাশ।
বলা হয়ে থাকে গণতন্ত্র একটি নিকৃষ্ট সরকারব্যবস্থা, কিন্তু গণতন্ত্র ছাড়া অন্য যেকোনো ব্যবস্থা নিকৃষ্টতর। বাংলাদেশে গত ৪১ বছরে আমরা কথাটির সত্যতা উপলব্ধি করেছি। এর পরও যারা রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার কথা বলছেন, পত্রিকা বন্ধ করা এবং সম্পাদককে গ্রেফতার করার কথা বলছেন তারা কখনোই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক, বিকাশ লাভ করুক তা চাইছেন না। অর্থাৎ তারা স্বীকার করুন বা না করুন তারা প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদের পক্ষের লোক। অন্য কথায় তারা বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতি বিশ্বস্ত নন। এ দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। যারা এ কথা অস্বীকার করে, তারা বাংলাদেশে বিশ্বাসী নয়। এ দেশের মানুষ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে। গণতন্ত্রই এ দেশকে তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে নিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন