মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০১৩

যত দোষ নন্দঘোষ



 প্রবাদ-প্রবচন সব দেশের জন্যই একটি গুরচত্বপূর্ণ বিষয়। প্রবাদে-প্রবচনে মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ জন্যই সমাজবিজ্ঞানীরা প্রবাদ-প্রবচনকে বিশেষ গুরচত্ব দিয়ে থাকেন। বর্তমান সময়ে আমাদের যে সমাজচিত্র, তাতে দু’একটি প্রবাদের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। যেমন ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’ কিংবা ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। এখন যে কোন নাগরিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তৃতা-বিবৃতিতে চিহ্নিত করার প্রবণতায় সহজেই ‘নন্দ ঘোষ’-এর দেখা পেয়ে যাবেন। এই নন্দ ঘোষের রাজনৈতিক নাম হলো ‘জামায়াত-শিবির’। যে কোনো ঘটনায় সত্য-মিথ্যা বিবেচনা না করে এবং তথ্য-প্রমাণ কিংবা তদন্ত-অনুসন্ধান ছাড়াই মুহূর্তেই এখন দোষ চাপানো হয় জামায়াত-শিবিরের ঘাড়ে। বিগত চার বছরে সরকারের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার সাথে যুক্ত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং যুদ্ধাপরাধ ইস্যু। এই দু’টি ইস্যুতেও সরকারের ভূমিকা সৃষ্টি করেছে নানা বিতর্ক। এমন অবস্থায় ডুবন্ত ইমেজকে পুনরচদ্ধারের জন্য এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সরকার এবং সরকারি ঘরানার লোকজন জামায়াত-শিবিরকে নন্দঘোষ বানাবার কৌশল গ্রহণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনায় এবং কোনো কোনো ব্যক্তির নিহত হওয়ার ঘটনায় বিনা তথ্য-প্রমাণে ও তদন্তে জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করা হচ্ছে। অথচ বাস্তব অবস্থা সাক্ষী দিচ্ছে অন্যরকম। প্রসঙ্গত এখানে টাঙ্গাইলের ঘটনা উলে­খ করা যায়, টাঙ্গাইলের গোপালপুর পৌরসভার চন্দবাড়ি গ্রামের সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা এখন আওয়ামী সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজের হাতে জিম্মি। সরকারি দলের প্রতাপে নানা অত্যাচার-নির্যাতনের পর সংখ্যালঘুদের গ্রামছাড়া করার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা গত রোববার সন্ধ্যায় দলবেঁধে থানায় হাজির হয়ে জানমালের নিরাপত্তা চেয়ে এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের দাবিতে লিখিত অভিযোগ করেন। গ্রামের সংখ্যালঘু নেতা রঙ্গলাল চন্দ্র পাল অভিযোগ করেন, সরকারি দলের দাপট দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। চাঁদা না দিলে ভাঙচুর, লুটপাট ও মারধর করা হয়। গত শনিবার সন্ত্রাসীরা পাড়ায় চড়াও হয়ে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। ১০ ঘণ্টার মধ্যে চাঁদা না দিলে বৌ-ঝিদের উঠিয়ে নিয়ে সবাইকে গ্রামছাড়া করার হুমকি দেয়া হয়। টাঙ্গাইলের ঘটনা তো একটি উদাহরণ মাত্র। সরকার ও প্রশাসনের প্রশ্রয়ে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন সংখ্যালঘুসহ সাধারণ নাগরিকদের উপর একের পর এক জুলুম-নির্যাতন ও হামলা চালালেও তাদের বিরচদ্ধে কোনো আইনী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অপকর্মের দায়ভার জামায়াত-শিবিরের উপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়। এমনি এক ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই মিরাজ আহমেদের রহস্যজনক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। মৃত্যুর ঘটনার পরপরই দায়ী করা হলো জামায়াতে ইসলামী ও সাবেক আমীর গোলাম আযমকে। ট্রাইব্যুনালে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হওয়ায় তার ছোট ভাইকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। অথচ আহমেদ মিরাজের সুরতহাল রিপোর্টে নারীঘটিত বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর র্যাথব-পুলিশ এখনও চারটি কারণ সামনে রেখে হত্যাকান্ডের তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কত সহজেই না জামায়াতকে আবার নন্দঘোষ বানাবার প্রচেষ্টা চালানো হলো। একশ্রেণীর মিডিয়া ঘটনাটিকে ফেনানোর চেষ্টা করলো। ঘটনাকে ফেনানো যেতে পারে কিন্তু তাতে কখনো সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ এর যে সংস্কৃতি দেশে এখন অটুট রয়েছে, তাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর বড় প্রমাণ নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর তানভীর মোহাম্মদ ত্বকীর হত্যাকান্ড। নারায়ণগঞ্জে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সংস্কৃতিসেবীসহ সব মহল তানভীর হত্যাকান্ডের জন্য নারায়ণগঞ্জের একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিবারের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তুললেও প্রশাসন সেপথে হাঁটছে না। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ ও র্যাপব জানায়, উপরের নির্দেশ ছাড়া এ পরিবারকে সন্দেহের তালিকায় আনা সম্ভব নয়। উলে­খ্য যে, নিহত তানভীরের বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাফিউর রাবিব সরকারি দলের সংসদ সারাহ বেগম কবরীসহ জেলার গুরচত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিদেরই ধারণা, নারায়ণগঞ্জের একটি বিশেষ পরিবার এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি তারা পুলিশ-র্যা বকেও জানিয়েছেন। কিন্তু এই পরিবারের কর্তারা প্রভাবশালী দলের রাজনীতিক হওয়ায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ইশারা ছাড়া পরিবারটিকে সন্দেহের তালিকায় আনতে পারছে না প্রশাসন। অতএব সংখ্যালঘু নির্যাতন কিংবা কোনো নাগরিকের হত্যাকান্ডের ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের বিরচদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে যখন ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন তো জনগণকে বুঝ দেয়ার অন্য পুলিশকে কিছু একটা করতে হয়, সরকারকেও কিছু একটা বলতে হয়। এসব আচরণে জনমনে ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’ কিংবা ‘যত দোষ নন্দঘোষ’ প্রবাদ বাক্যগুলোই জেগে ওঠে। এমন পরিস্থিতি জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক। কারণ প্রকৃত সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের বিচার না হলে তারা যেমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তেমনি নির্দোষ মানুষের উপর দোষ চাপানোর কারণে তারাও হয়ে ওঠে ক্ষুব্ধ। এমন পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সাথে সাথে মজলুম মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মাত্রাও যায় বেড়ে। অনাকাঙিক্ষত এমন অবস্থায় কোনো দেশ শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। বিষয়টি সংশ্লি­ষ্ট সবাই উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads