ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ৪ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও ইনু-মেননসহ আরো অনেকের সঙ্গেই দেখা ও কথা হয়েছে তার। নড়াইলে শ্বশুরবাড়িতে গেছেন, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহের দীঘিতে নৌকায় বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগ করেছেন তিনি। খাওয়া-দাওয়াও কম করেননি। কিন্তু এতকিছুর পরও প্রণব মুখার্জি নকি খুশি হতে পারেননি বরং ফিরতি পথে বিমানে তাকে যথেষ্ট ‘ক্ষুব্ধ’ দেখেছেন ভারতের সাংবাদিকরা। কথাটা ভারতীয় পত্রপত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশেও প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণও জানানো হয়েছে। কারণ একটাইÑ বেগম খালেদা জিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি এবং পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করেছেন। প্রণব মুখার্জির প্রতিক্রিয়া জানারও আগে এ ব্যাপারে জানান দিয়েছেন এদেশের ক্ষমতাসীনরা। প্রণব মুখার্জির সফরকালেই তারা এমন এক প্রচারণা চালিয়েছেন যেন ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে খালেদা জিয়া বিরাট কোনো ‘অপরাধ’ করে ফেলেছেন! এটা নাকি ‘অশোভন’ হয়েছে এবং খালেদা জিয়া নাকি ‘কূটনৈতিক সৌজন্য’ লংঘন করেছেন! পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি থেকে আওয়ামী লীগের লন্ডন প্রবাসী সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পর্যন্ত অনেকেই নিন্দা-সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। অন্যদিকে সত্য কিন্তু মোটেও তেমন নয়। কারণ, এই সাক্ষাতের নির্ধারিত তারিখ ছিল ৪ মার্চ। সেদিন এবং তার আগেরদিন আগেই হরতাল ডেকেছিল জামায়াতে ইসলামী। ১৮ দলীয় জোটের প্রধান নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে হরতাল ভঙ্গ করা এবং গাড়িতে চড়ে সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে বসা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া গণহত্যাসহ সরকারের ফ্যাসিস্ট কর্মকা-ের কারণে তার নিরাপত্তার প্রশ্নও ছিল। এজন্যই খালেদা জিয়া অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। এতেই নাকি সরকারের ‘মহাভারত’ অশুদ্ধ হয়ে গেছে! ওদিকে ভারতীয়রাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার লিখেছে, প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করার মাধ্যমে খালেদা জিয়া নাকি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ব্যাপারে ‘সুদূরপ্রসারী বার্তা’ দিয়েছেন! রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্ধৃতি দিয়ে আনন্দবাজার আরও জানিয়েছে, খবরটি জানার পর প্রণব মুখার্জির মুখের হাসি নাকি কিছুক্ষণের জন্য ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিল!
ক্ষমতাসীনরা ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার বিষয়টিকে নিয়ে এভাবে নোংরা রাজনীতি করলেও দেশপ্রেমিকরা কিন্তু খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তকে সঠিক ও জাতীয় নেত্রীসুলভ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তারা মনে করেন, সরকার আসলে প্রণব মুখার্জিকেও নিজেদের দাবার ঘুঁটি বানিয়েছেন। না হলে এবং ভারতের রাষ্ট্রপতিকে সম্মান দেখানোর সত্যিই সদিচ্ছা থাকলে সরকার অবশ্যই জামায়াত-শিবিরের গণতন্ত্রসম্মত প্রতিবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঠিক এসময়েই এতটা ভয়ঙ্করভাবে মারমুখী হয়ে উঠতো না। তার সফরের প্রাক্কালে ডজনে-ডজনে লাশও ফেলতো না। ক্ষমতাসীনরা ঠিকই জানতেন, আন্দোলনকারীদের লাশের ওপর দিয়ে খালেদা জিয়া অন্তত প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন না। তেমন অবস্থায় তারা সহজেই খালেদা জিয়াকে ভারতবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে এবং নতুন পর্যায়ে ভারতের সমর্থন আদায় করতে পারবেন। মূলত অমন এক কূটিল কৌশল নিয়েই এগিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। তাছাড়া এমন এক অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যে প্রণব মুখার্জিরও বাংলাদেশে আসা উচিত হয়নি।
তিনি চাইলে সরকার অবশ্যই গণহত্যা বন্ধ করতো। কিন্তু সেটা তিনি করেননি বরং গণহত্যাসহ সরকারের নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের প্রতিই পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়ে গেছেন। এজন্যই দেশপ্রেমিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে ভারতপন্থীদের মতো উচ্ছ্বাস দেখানোর কিছুই থাকতে পারে না। প্রথম ‘বাঙালি’ রাষ্ট্রপতি তিনি হতেই পারেন কিন্তু সমগ্র বিষয়কে দেখা দরকার বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে। ঢাকায় দাঁড়িয়ে ‘বাঙালি-বাঙালি’ বলে চিৎকার করে গলা ফাটানো হলেও একটি তথ্য অবশ্যই স্মরণ করা দরকার। সে তথ্যটি হলো, রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রণব মুখার্জিকে তথা একজন ‘বাঙালি’ নেতাকে দীর্ঘ ৬৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাছাড়া নামে রাষ্ট্রপ্রধান হলেও ভারতে রাষ্ট্রপতিকে আসলে অলংকারের মতো রাখা হয়। সব ক্ষমতা থাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আরেক ‘বাঙালি’ নেতা জ্যোতি বসু ব্যর্থ হওয়ার পর প্রণব মুখার্জি নিজেও বহুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করে দেখেছেন। কিন্তু পারেননি।
সবশেষে রাষ্ট্রপতি বানানোর নামে প্রণব মুখার্জিকে প্রধানমন্ত্রিত্বের রেস বা দৌড় থেকেই সুকৌশলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। একথা প্রমাণিতও হয়েছে, ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে গান্ধী পরিবারের অতি বিশ্বস্ত সেবক হিসেবে ভূমিকা পালন করে এলেও প্রণব মুখার্জি কংগ্রেসের জন্য ‘বার্ডেন’ তথা বোঝা হয়ে উঠেছিলেন। সোনিয়া গান্ধী না তাকে গিলতে পারছিলেন, না পারছিলেন উগলে ফেলতে। অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে এবং সুযোগ পেলেই প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আবদার জানিয়ে বসছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে আরো একবার তৎপর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। প্রণব মুখার্জির বিরুদ্ধে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-বিরোধী তৎপরতা চালানোর অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু যতো বিশ্বস্ত সেবকই হোন না কেন, একদিকে তিনি ‘বাঙালি’ অন্যদিকে আবার চেষ্টা চলছে রাজিব ও সোনিয়া গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য। সে কারণেই কংগ্রেসের ঘাড় থেকে প্রণব নামের বোঝাটিকে ঝেড়ে ফেলে দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। সেটাই করেছে কংগ্রেস। রাষ্ট্রপতি বানানোর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ভারতের রাজনীতি থেকেই প্রণব মুখার্জিকে বিদায় করেছেন সোনিয়া গান্ধী। সুতরাং তাকে নিয়ে আনন্দে ধেই ধেই করে নেচে ওঠার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের উচিত একটু সংযম দেখানো এবং পুরো বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা।
বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রণব মুখার্জির ভূমিকার কথাও স্মরণ ও পর্যালোচনা করা দরকার। দেখা দরকার, ভারতের এই ‘বাঙালি’ রাজনীতিক বাংলাদেশের এমন কোনো উপকার করেছেন কি নাÑ যার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে হরতালের মধ্যেও গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। সঠিক ইতিহাস হলো, মাঝখানে কিছুদিনের বিরতিসহ ১৯৭৭ সাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদে ছিলেন প্রণব মুখার্জি। এ সময়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য থেকে সীমান্তে হত্যা ও পানি সমস্যাসহ কোনো একটি বিষয়েই বাংলাদেশ লাভবান হতে পারেনি। এর সহজ অর্থ, যাকে ‘বাঙালি’ হিসেবে ‘পূজনীয়’ করার চেষ্টা চলছে সেই প্রণব মুখার্জিও অন্য ভারতীয়দের মতোই ক্ষতি ছাড়া বাংলাদেশের কোনো উপকার করেননি। বিভিন্ন উপলক্ষে তাকে বরং বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা পালনেই বেশি তৎপর দেখা গেছে। উদাহরণ দেয়ার জন্য ২০০৭ সালের নবেম্বরে সিডরের আঘাতে ল-ভ- হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গে প্রণব মুখার্জির তামাশার কথা উল্লেখ করতেই হবে। তিনি তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সিডরের পর পর ‘ঝটিকার বেগে’ উড়ে এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। মনে হয়েছিল যেন ‘উদার হস্তে’ সাহায্য দেয়াই তার উদ্দেশ্য! কিন্তু পরে দেখা গেলো, তিনি আসলে ‘খেল’ দেখাতে এসেছিলেন। কারণ, পাঁচ লাখ টন চাল রফতানির অঙ্গীকার ঘোষণা করলেও তারা এমনভাবেই নতুন নতুন শর্তের বেড়াজালে বেঁধে ফেলার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হয়েছিল। প্রণব মুখার্জির আশ্বাসে মইন উ-ফখরুদ্দিনদের অসাংবিধানিক সরকার সে সময় অন্য কোনো দেশ থেকে চাল আমদানির চেষ্টা করেনি। ফলে বাংলাদেশকে প্রচ- খাদ্য ঘাটতিতে, প্রকৃতপক্ষে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে হয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘চালবাজ’ ও ‘চাউল দাদা’ নামে পরিচিতি তথা কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। এই চালবাজির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল, নামে ‘বাঙালি’ হলেও বাংলাদেশের প্রতি সামান্য মমতাও নেই প্রণব মুখার্জির।
ভারতের এই রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে তথ্যের দ্বিতীয় কিস্তি জানা যাবে পিলখানা হত্যাকা- এবং তার আগের ও পরের কিছু কথা স্মরণ করলে। এ ব্যাপারে ২০১১ সালের ২৭ মার্চ ‘উইকিলিকস’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু খবর প্রকাশ করেছে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’ এবং ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’। এখানে সে সব খবরের সারাংশ মাত্র উল্লেখ করা হলো, যেগুলোর সঙ্গে প্রণব মুখার্জি জড়িত ছিলেন : ১. পিলখানায় কথিত বিডিআর বিদ্রোহের পর ‘সাহায্য চেয়ে’ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে টেলিফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২. প্রণব মুখার্জি ‘ইতিবাচক সাড়া’ দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজন অনুযায়ী’ সহায়তা করা হবে। ৩. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেলিফোন পাওয়ার পরই প্রণব মুখার্জি বিষয়টি নিয়ে লন্ডন, বেইজিং এবং টোকিওর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ৪. ২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ হত্যাকা-ের পরদিন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শিবশংকর মেননের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নয়াদিল্লীতে নিযুক্ত মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স স্টিভেন হোয়াইট লক্ষ্য করেছিলেন, ভারত সরকার খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। ৫. ওয়াশিংটনে পাঠানো দুটি গোপনীয় তারবার্তায় মার্কিন দূত জানিয়েছিলেন, ভারতের ভয় ছিল, বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করতে এবং সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। ইসলামী জঙ্গিরা ভারতের ভেতরে ঢুকেও আক্রমণ চালাতে পারে।
‘দ্য হিন্দু’ এবং ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত খবর দুটি বিচ্ছিন্নভাবে পড়লে মনে হতে পারে যেন পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যাকা-ে ভারতের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অন্যদিকে ঘটনাপ্রবাহে কিন্তু বিপরীত তথ্যই প্রাধান্যে এসেছিল। উইকিলিকস ভারতের ‘সাহায্য’ চেয়ে প্রণব মুখার্জির কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধ জানানোর কথা ফাঁস করলেও জানায়নি, ‘সাহায্য’ করার জন্য ভারত ঠিক কোন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। প্রকাশিত তথ্যগুলো পড়লে বরং মনে হতে পারে যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার এবং মুখে মুখে ‘ইতিবাচক সাড়া’ দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন প্রণব মুখার্জি। বাস্তবে সাহায্যের জন্য ‘সুনির্দিষ্ট অনুরোধ’ যাওয়ার পর রাতারাতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাস্যুট রেজিমেন্টকে আগ্রা থেকে পশ্চিম বঙ্গের কালাইকুন্ডে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এই রেজিমেন্টের সেনাদেরই বিমানযোগে বাংলাদেশে নামানো হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশ ছিল তাদের ‘নখদর্পণে’। ওদিকে আসামেও ‘প্রস্তুত’ ছিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর বোমারু বিমান। এসব খবর সে সময় ভারতের সংবাদ মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারকে ‘সাহায্য’ করার জন্য ভারত রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল আর এসব কর্মকা-ের নেতৃত্বে ছিলেন হবু রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি।
এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে অন্য একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। তথ্যটি হলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পর এবং পিলখানা হত্যাকা-ের ঠিক প্রাক্কালে, ২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ১০ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। ওই সফরকালে বিরোধী দলের নেত্রী এবং তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করলেও প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ’র সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠক নিয়ে সে সময় জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হয়েছে, এর ক’দিনের মধ্যে সংঘটিত পিলখানা হত্যাকা-কে বিবেচনায় নেয়া হলে নাকি প্রণব মুখার্জির সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে!
প্রণব মুখার্জির অন্য একটি সফর নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ২০১০ সালের ৭ আগস্ট অর্থমন্ত্রী হিসেবে ঘণ্টা পাঁচেকের এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। তার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল রাত আটটায়। কিন্তু দেড় ঘণ্টা দেরি হয়েছিল আওয়ামী লীগের তিন নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর সঙ্গে রুদ্ধ™^ার বৈঠকের কারণে।
প্রণব মুখার্জির অন্য একটি সফর নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ২০১০ সালের ৭ আগস্ট অর্থমন্ত্রী হিসেবে ঘণ্টা পাঁচেকের এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। তার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল রাত আটটায়। কিন্তু দেড় ঘণ্টা দেরি হয়েছিল আওয়ামী লীগের তিন নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর সঙ্গে রুদ্ধ™^ার বৈঠকের কারণে।
বৈঠকটি প্রণবের ঘোষিত সফরসূচিতে ছিল বলে পর্যবেক্ষকরা একে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য ‘ধমক’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছিলেন, প্রণব মুখার্জি বুঝিয়ে গেছেন, ঢাকায় আওয়ামী লীগের ভেতরেই ভারতের ‘সেকেন্ড লাইন’ রয়েছে। কথাটা পরিষ্কার হয়েছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির বক্তব্যেও। পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে দীপু মনি স্বীকার করেছিলেন, বৈঠক সম্পর্কে তিনি জেনেছেন পত্রিকা থেকে। আগে জানতেন না। উল্লেখ্য, প্রণব মুখার্জি যে তিনজনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, আবদুর রাজ্জাকসহ সে তিনজন ‘র্যাটস’ নামে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। তিনজনের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর সঙ্গে প্রণব মুখার্জির বিশেষ সম্পর্ক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক রটনা রয়েছে। বলা হয়েছে, উদ্দিন সাহেবদের দিনগুলোতে কলকাতার ঢাকুরিয়া এলাকায় অবস্থিত প্রণব মুখার্জির অ্যাপার্টমেন্টে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর আসা-যাওয়া ও অবস্থান ছিল রহস্যঘেরা। কারণ, একান্ত ব্যক্তিগত ওই অ্যাপার্টমেন্টে প্রণব মুখার্জি সাধারণত অতি ঘনিষ্ঠজনদের ছাড়া কাউকে যেতে দেন না।
অন্যদিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নাকি সেখানে মাঝে-মধ্যেই যেতেন। ঘনিষ্ঠতার এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিন নেতার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর বলা হয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করার চেষ্টা চালানোর অনস্বীকার্য অভিযোগ রয়েছে সে তাদের সঙ্গে বৈঠকের মধ্যদিয়ে প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রীকে আসলে কড়া একটি ‘ধমক’ দিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, রোডম্যাপের শর্ত অনুসারে সাধারণভাবে ভারতের স্বার্থে ভূমিকা পালন করলেও কোনো কোনো বিষয়ে শেখ হাসিনা নাকি ঘাড় বাঁকানোরও চেষ্টা করছিলেন। এজন্যই তাকে ‘বাগে’ আনার দায়িত্ব চেপেছিল ‘দাদা’ প্রণব মুখার্জির ওপর। তিনি তাই ‘র্যাটস’-এর আমু-তোফায়েল ও সুরঞ্জিতের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা যদি কোনো কারণে ‘অবাধ্য’ হওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে ভারত তার ‘সেকেন্ড লাইন’কে কাজে লাগাবে। তেমন অবস্থায় শেখ হাসিনাকে বিদায় নিতে হবে, নেতৃত্বে চলে আসবেন ‘র্যাটস’ নামে পরিচিত চার নেতা। বাংলাদেশের রাজনীতিকে কিভাবে দিকভ্রান্ত করতে হয় এবং বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকদের কিভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়Ñ এসবই ছিল ভারতের নখদর্পণে। ক্ষমতার লোভে শেখ হাসিনা নিজেও ভারতের হয়েই কাজ করেছিলেন বলে প্রণব মুখার্জির ‘চাল’ ফলপ্রসূ হয়েছিল। শেখ হাসিনা আর এদিক-সেদিক করার সাহস দেখাননি। সুবোধ বালিকার মতো দিল¬ীর হুকুম তামিল করেছেন। এখনো তামিল করে চলেছেন।
এভাবে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায়ও দেখা যাবে, প্রণব মুখার্জির ভূমিকা কোনো পর্যায়েই বাংলাদেশের পক্ষে আসেনি। এ সম্পর্কে জানার জন্য ইন্দিরা ও রাজিব গান্ধী বা নরসীমা রাও-এর আমলসহ বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার পড়ে না। ড. মনমোহন সিং-এর সরকারের আমলেও প্রণব মুখার্জিই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে এসেছেন। বাংলাদেশ কি পেয়েছে বা আদৌ কিছু পেয়েছে কি না পাঠকরা তা ভেবে দেখতে পারেন। এজন্যই এমন আশাবাদ মোটেও ঠিক নয় যে, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের জন্য ‘স্বর্গের সিঁড়ি’ নির্মাণ করে দেবেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তেমন ক্ষমতাই তার নেই। এবারের সফরকালেও তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তির মতো বিষয়গুলোতে তিনি কিন্তু ‘চেষ্টা করবেন’ ধরনের আশ্বাসের বাইরে একটি কথাও বলেননি। তিনি বরং শাহবাগের নাস্তিক ও ফ্যাসিস্টদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে গেছেন। অর্থাৎ মনোভাবের দিক থেকেও বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের কোনো প্রমাণই তিনি দিতে পারেননি। সুতরাং বেগম খালেদা জিয়াও প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে কোনো ‘অশোভন’ কিছু করেননি। তিনি বরং প্রকৃত দেশপ্রেমিক জাতীয় নেত্রীর অবস্থানই বজায় রেখেছেন। সে কারণে সমালোচনার পরিবর্তে খালেদা জিয়াকে বরং সমর্থন জানানো দরকার।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন