বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখন চলছে শোক আর কান্নার মাতম। দেশটি এখন একটি পুলিশি রাষ্ট্র। পুলিশ ছাড়া সরকারের অস্তিত্ব কল্পনা করা যাচ্ছে না। পুলিশই সব। তারা জনগণের নিরাপত্তার নামে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। টেলিভিশনের পর্দা আর পত্রিকার পাতা দেখলে সহজেই দেখা যাচ্ছে, পুলিশ যেন যুদ্ধের ময়দানে শত্র“র বিরুদ্ধে ল্যভেদী আধুনিক বন্দুকের গুলি ছুড়ছে। বিপরীত দিকে দেখা যাচ্ছে, কেবল নিরস্ত্র জনতা যাদের হাতে বড়জোর বাঁশের লাঠি বা ইটের গুঁড়ি। আবার কোনো কোনো েেত্র মহিলাদের হাতে ঝাড়– বা জুতা। আর এই নিরস্ত্র জনতাকে সরকার মোকাবেলা করছে বন্দুকের গুলি দিয়ে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বা বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন কোনোটাতেই নিরস্ত্র জনগণকে এভাবে হত্যা করার কোনো এখতিয়ার সরকারকে দেয়নি। বিশ্বব্যাপী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে। তা সত্ত্বেও সরকার তা আদৌ আমলে নিচ্ছে না। বরং আরো বেপরোয়া হচ্ছে।
অনেকেই বলছেন দেশে এখন চলছে প্রতিবাদী মানুষের ওপর নির্বিচার গণহত্যা। এ ছাড়া হাজার হাজার বিরোধী মতাবলম্বী কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নির্যাতন ভোগ করছে। লাখ লাখ মানুষ নানাভাবে নিপীড়িত হচ্ছে সরকারদলীয় ক্যাডারদের হাতে। এ পর্যন্ত নারী-শিশুসহ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে যার বেশির ভাগই জামায়াত-শিবির কর্মী-সমর্থক এবং সাধারণ মানুষ। পুলিশও নিহত হয়েছে কয়েকজন। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতা ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দিনে এত লোকের হত্যাকাণ্ড আর ঘটেনি। মাওলানা সাঈদী যে জনমানুষের কাছে এতটা জনপ্রিয় তা হয়তো সরকারও বুঝতে পারেনি। কিন্তু সরকার প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠকে যেভাবে অস্ত্রের ভাষায় স্তব্ধ করে দিতে চাইছে তা যেমন এক দিকে আইনের দৃষ্টিতে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং অপর দিকে গণতান্ত্রিক মূলবোধের সাথেও একেবারে সাংঘর্ষিক। এই গণহত্যার জন্য এক দিন সরকারকে নিশ্চয়ই জবাবদিহি করতে হবে।
সারা দেশে যখন নির্বিচারে গণহত্যা চলছে, তখন বেশির ভাগ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া পরিস্থিতির সঠিক চিত্র তুল ধরছে না। তারা বরং সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বিরূপ প্রচারণা চালাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তারা সরকারবিরোধী শক্তি বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে মিডিয়া লড়াই শুরু করেছে। শাহবাগ চত্বরের সমাবেশকে তারা যে বিশেষ কারো এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বিরতিহীনভাবে সরাসরি প্রচার করছে তা একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে। এক সময় যখন শুধু বিটিভি ছিল তখন কড়া হরতালের দিনেও বিটিভি বলত জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও গণ-অভ্যুত্থান ঠেকানো যায়নি। এখনো অনেকটা সে রকমই বলা হচ্ছে কোনো কোনো চ্যানেল থেকে। সরকার পরিচালিত নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে পুলিশের ভূমিকা জনগণ ছবিতে দেখছে অথচ তারা বলছে ওগুলো জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবে হচ্ছে। ভাবখানা এমন যে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা লাঠি হাতে নিজেদের লোকদের হত্যা করছে। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও নির্বিকার। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনকে লোকেরা বলছে আওয়ামী মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান ‘গণহত্যা’ পরিভাষা নিয়ে উদ্বিগ্ন; নির্বিচার মানুষ হত্যা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। কারণ যারা নিহত হচ্ছে তারা মানুষ নয়; ওরা তো ‘জামায়াত-শিবির’। কাজ ও চিন্তার সব েেত্রই যেন জাতি দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, যে জনতা ফুঁসে উঠেছে তারা মিডিয়ার অপপ্রচার দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। তাদের নিজস্ব বিবেচনাবোধ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক, মূল্যবোধগত বিভাজন ও সঙ্ঘাত যেন প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। দেশে একটি মঞ্চ থেকে দেশের শীর্ষ ইসলামি চিন্তাবিদ ও নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য উগ্র ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করা হচ্ছে; তরুণ প্রজন্মের দাবিদার বলে একটি শ্রেণী আরেক শ্রেণীর তরুণদের জবাই করার জন্য হুঙ্কার ছাড়ছে। এক দিকে ফাঁসির খবরে লাখ লাখ টাকার মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে; আরেক দিকে প্রতিবাদে গর্জে উঠছে জনতা, তারা হাসিমুখে জীবন দিচ্ছে পুলিশের বুলেটের মুখে। এক দিকে একজন নাস্তিককে ‘শহীদ’ বলে ঘোষণা করা হচ্ছে; আরেক দিকে নাস্তিকদের ফাঁসি দাবি করে লাখো জনতা রাজপথে নেমে এসেছে। এসব ঘটনাকে নিছক ‘রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব’ বলে সরলীকরণ করা সঠিক হবে না। এর শিকড় অনেক গভীরে।
১৯৭১ সালে রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলে নতুন দেশ কোন নীতি ও মূল্যবোধ নিয়ে পরিচালিত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে ‘গণতন্ত্র’কে গ্রহণ করার বিষয়ে কারো কোনো মতপার্থক্য ছিল না এবং আজো নেই। তবে ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে বাকশালের আবরণে বন্দী করা হয়। এ দেশের জনগণ তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেন। জেনারেল এরশাদ আবার সামরিক শাসনের যাঁতাকলে গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করেন। বেগম খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্রকে সাংবিধানিক রূপদান করেন। জামায়াতে ইসলামীর উদ্ভাবিত নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পদ্ধতি সব দলের গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা এগিয়ে চলছিল। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবার বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে আমরা গণতন্ত্রের ব্যাপারে সবাই একমত হলেও মতালিপ্সু একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর জন্য গণতন্ত্র এখন চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিবাদী জনতাকে যেভাবে নির্মমভাবে বুলেটের আঘাতে তবিত করছে তাকে কেবল হিটলারের ফ্যাসিবাদী আচরণের সাথেই তুলনা করা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ যে গণতন্ত্রের খোলসে একটি ফ্যাসিস্ট পার্টি তা আর নতুন করে প্রমাণ করতে হবে না।
১৯৭২ সালে অর্থনৈতিক েেত্র সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করা একটি আধুনিকতার ফ্যাশন হিসেবে গণ্য করা হতো। আওয়ামী লীগ ছিল বরাবরই একটি বুর্জোয়া পার্টি। দলটির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতান্ত্রিক ছিলেন না। একজন উদার গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। তার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মার্কিন বলয়ের বন্ধু। মওলানা ভাসানী চীনা সমাজতন্ত্রের অনুসারী হয়ে উঠলে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে যায় এবং মুজিব পুঁজিবাদী নীতির পে থেকে যান। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহযোগিতা করলে দেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি অনুরাগী হন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করেন। কিন্তু তার দলের নেতাকর্মীরা সমাজতান্ত্রিক
চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ না থাকায় দেশের অর্থনীতি পুরো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভি তার বড় প্রমাণ। ব্যর্থতা এড়াতে সমাজতন্ত্রীদের কুপরামর্শে বাকশাল নামে একদলীয় স্বৈরশাসন চালু করেও বিপর্যয় ঠেকানো যায়নি। মুজিব বেঁচে থাকতেই সমাজতান্ত্রিক নীতি থেকে সরে আসতে শুরু করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ব্লকের পতনের পর এ নীতির প্রতিও আর কারো মোহ নেই। আজকের আওয়ামী লীগও সমাজতন্ত্রের ধারে কাছে নেই। দলটি তার জন্মলগ্নের মতোই পুরোপুরি বুর্জোয়া নীতি অনুসরণ করে চলেছে। মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশের কট্টর বামপন্থী তথা সমাজতান্ত্রিক দলগুলো কখনোই জনগণের মন জয় করতে না পেরে এখন বুর্জোয়া আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় আদর্শের নীতি বিসর্জন দিয়ে গলাবাজির রাজনীতি করছে। তারা আজীবন দুর্নীতি, অপশাসন, শোষণ-নিপীড়ন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্লেøাগান দিলেও এখন এসবের প্রতিভূ আওয়ামী লীগের দোসর হয়ে রাজনীতি করছে। এখন তাদের রাজনীতির প্রধান উপজীব্য হচ্ছে ইসলামি রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা। আওয়ামী লীগের সাথে তাদের মিল ও সখ্য এখানেই।
তৃতীয় বিষয়টি হলো ‘জাতীয়তাবাদ’। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশের নাগরিকদের ‘বাঙালি’ পরিচয় দেয়ার মাধ্যমে দেশের অনেক উপজাতি বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে অস্বীকার করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবিধানে বাংলাদেশের নাগরিকদের ‘বাংলাদেশী’ পরিচয় দেয়ার মাধ্যমে সবাইকে একই জাতিসত্তায় পরিচিত করেন। আওয়ামী লীগ ৪০ বছর পরে তাদের ভুল বুঝতে পেরে এবারে সংশোধনী আনল যে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা ‘বাংলাদেশী’ বলে পরিচিত হবে; তবে জাতি হিসেবে ‘বাঙালি’ বলে পরিচিত হবে। আবার বলা হয়েছে দেশের ুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোকে সমান মর্যাদা দেয়া হবে। এর মানে হলো আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমানের ‘বাংলাদেশী’ তত্ত্বকে পরোভাবে হলেও মেনে নিয়েছে। এটাও রাষ্ট্রধর্মের ইস্যুর মতোই ‘জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে আওয়ামী লীগের আরেকটি রাজনৈতিক কূটকৌশল বা আত্ম-সাংঘর্ষিক বিষয়।
আরেকটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেতা নিয়ে আছে বিরাট বিতর্ক। মূলত এটা নিয়েই যত বিপত্তি। ১৯৭২ সালে সংবিধানে সন্নিবেশিত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ ‘ধর্মনিরপেতা’র কথা বলেনি। বরং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে দলটি ইয়াহিয়া খানের দেয়া ‘লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ (যাতে পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের জন্য সংবিধান রচনার শর্ত ছিল) মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং জনগণ ভোট দিয়ে তাদের বিজয়ী করেছিল। সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেতা’ সন্নিবেশিত করার জন্য আওয়ামী লীগ কখনো জনগণের ম্যান্ডেট নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা বা অন্য কোনো দলিলপত্রেও ‘ধর্মনিরপেতা’র কথা বলা হয়নি। হঠাৎ করেই ১৯৭২ সালে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেতা’কে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অনেকে বলে থাকেন যে, ভারতের পরামর্শে এটা করা হয়েছে। ‘ধর্মনিরপেতা’ পরিভাষাটির ব্যবহারও বিভ্রান্তিকর। বাংলা একাডেমীর অভিধানে ‘সেকুলারিজম’-এর অর্থ ‘ধর্মনিরপেতা’ লেখা হয়নি। ফরাসি শব্দ ‘লায়েসিজম’ থেকে ‘সেকুলারিজম’-এর উদ্ভব যাকে তুরস্কের মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ‘লায়েসিজম’ বা ‘সেকুলারিজম’-এর অর্থ ‘ইহজাগতিকতা’ বা ‘ইহলৌকিকতা’। এর মানে হচ্ছে রাষ্ট্র শুধু ইহজাগতিক বিষয় নিয়েই কাজ করবে। পারলৌকিক বা আধ্যাত্মিক বিষয়ে রাষ্ট্র নাক গলাবে না। সুতরাং ‘ধর্মনিরপেতা’ শব্দটি আওয়ামী লীগ নিজস্ব রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ইসলামি পণ্ডিতেরা মনে করেন যে, একজন মুসলমান রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ধর্মনিরপে হতে পারেন না। কারণ আল কুরআনে রাজনীতির যেমন কথা আছে; তেমনি মহানবী সা:-এর জীবন ‘ইহলৌকিক’ ও ‘পারলৌকিক’ বিষয়সহ রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিপূর্ণ। বিষয়টি উপলদ্ধি করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেতা’ বিলুপ্ত করে ‘আল্লাহর উপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা’ সন্নিবেশিত করেছিলেন। প্রায় ৩৫ বছর পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট সরকার ও পার্লামেন্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর ওপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা’ বাদ দিয়ে ‘ধর্মনিরপেতা’কে আবার সন্নিবেশিত করে। তবে দু’টি বিষয় লণীয়: এক. ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু এবারে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তা করা হয়নি। দুই. ১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বলে কিছু ছিল না। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ কর্তৃক সংবিধানে সংযোজিত ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বহাল রাখা হয়। অবশ্য এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলামের প্রাধান্যকে মেনে নেয় এবং ধর্ম প্রসঙ্গে আগের অবস্থান থেকে সরে আসে। বিষয়টি যে আদর্শিক বিচারে সাংঘর্ষিক তা নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকেই বলা হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে ‘ধর্মনিরপেতা’ পরিভাষাটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি প্রচণ্ড বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেশ বিভক্ত হয়ে পড়েছে দুই ভাগে। রাজনৈতিক প হিসেবে জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং বৃহত্তম ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামীসহ সব ইসলামি দলের আদর্শিক ভিত্তিই হচ্ছে ইসলাম। এরা সবাই সমাজ ও রাজনীতিতে সক্রিয়। অপর দিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বলা হয়েছিল যে, তারা কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করবে না। বলাই বাহুল্য, আওয়ামী লীগের ইসলাম ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক কৌশল সব সময়ই রহস্যময়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে শাহবাগে পরিচালিত ‘গণজাগরণ’ মঞ্চের ভূমিকা ও তার প্রতি আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের ঘোষিত অবস্থান বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে সরকার সম্পর্কে প্রচণ্ড ােভ সঞ্চারিত হয়েছে। জনমানসে এ ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সরকার ইসলামের অবমাননাকারীদের প নিয়েছে এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করছে। অপর দিকে তারা ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ বলে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। শাহবাগের তথাকথিত তরুণেরা ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি’ দাবি করলেও ক্রমান্বয়ে তা ধর্মীয় দল নিষিদ্ধকরণ, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার, নয়া দিগন্ত ও দিগন্ত টিভি বন্ধ করা, ইসলামী ব্যাংক দখল প্রভৃতি গণতন্ত্রবিরোধী দাবি-দাওয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। ‘গণজাগরণ’ মঞ্চ থেকে যে ভাষায় স্লোগান দেয়া ও কথা বলা হয়েছে তা সভ্য সমাজের জন্য উদ্বেগের বিষয়। শিশুদেরকে পর্যন্ত প্রতিপরে প্রতি ঘৃণা প্রকাশ, জবাই করা ও ফাঁসি দেয়ার সংস্কৃতি যেভাবে অনুশীলন করানো হয়েছে তাতে বিবেকবান অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না। অবশেষে শাহবাগী তরুণদের স্বরূপ প্রকাশিত হলো ‘থাবা বাবা’র হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। প্রকাশিত হলো যে, শাহবাগী ব্লগারদের অনেকেই নাস্তিক এবং ইসলামবিরোধী অশ্লীল প্রচারণায় তারা লিপ্ত। এটা আরো মুখ ব্যাদান করল যখন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ‘থাবা বাবা’র বাসায় গেলেন এবং শাহবাগী তরুণদের শপথের সাথে পূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করলেন। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের জনমানুষের আবেগের প্রতি তাকিয়ে রায় দিতে বললেন। দেশের বিশিষ্টজনেরা বললেন, প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বিচার বিভাগের প্রতি হস্তপে করেছেন এবং এরূপ বলার পরে আর কোনো বিচারকের পে সুবিচার করা সম্ভব নয়। ঘটেছেও তাই। প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা শাহবাগী তরুণদের দাবির প্রতিফলন বলে অনেকের বিশ্বাস। এতে স্বাভাবিকভাবেই সাঈদীর ভক্ত ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা গর্জে উঠেছে। সরকার ও তার দোসররা হয়তো ভাবছে, দেশের লাখো-কোটি প্রতিবাদী কণ্ঠকে ফুৎকারে নিভিয়ে দেয়া যাবে; চিরতরে নির্মূল করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অনেক কঠিন।
পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের কোনো উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। বরং সরকারি দলের নেতারা প্রতিদিন হুঙ্কার ছাড়ছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকেও তারা বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছে না। যে বিদেশী দূতাবাসগুলো ২০০৬ সালে এক-এগারো ঘটাতে কুশীলবের ভূমিকায় নেমেছিল তাদের কোনো তৎপরতা পরিলতি হচ্ছে না। ফলে দেশটি কোথায় যাচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদ বলেছেন, ‘দেশ গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে’। মনে হচ্ছে বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ময়দানে মতপার্থক্যের লড়াই জোরেশোরেই হয়ে গেছে। এর শেষ কোথায় কে জানে?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন