একটার পর একটা ইস্যু সৃষ্টি করে বর্তমান সরকার জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে নিজেদের শাসনমতা আরো এক মেয়াদ বলবৎ করার সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ইস্যুতে জনগণকে বিভক্ত করে চতুর্মুখী সংঘর্ষের ত্রে হিসেবে ইতোমধ্যেই প্রস্তুত করা হয়েছে সারা দেশকে। মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট দাবিদার শাসক দলটির প্রত্য মদদ এবং সরকারের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, কমিউনিস্টদের সহযোগিতায় শাহবাগে ‘তারুণ্যের’ নামে এক বিষবৃ রোপণ করে দেয়া হয়েছে। এরা নাকি জেগে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের আগামী নেতৃত্বের সম্ভাবনায়! ইসলাম ধর্মবিদ্বেষী কিছু ব্লগার যারা আল্লাহর রাসূল সা:, নামাজ, রোজা, হজ এবং ইসলামের নানা ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে সীমাহীন ব্যঙ্গ, কটূক্তি করে চলেছে, তাদের এক নেতা ব্লগার রাজীব মারা যাওয়ার পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার বাড়িতে গিয়ে ঘোষণা দিয়ে এলেন সে নাকি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ (নাউজুবিল্লাহ!)। আওয়ামী সংসদ সদস্যদের অনেকেই সেদিন তার মৃত্যুতে জাতীয় সংসদে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করতে জোর দাবি জানিয়েছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার মতে, ‘শাহবাগে এরা করা? এরা নিরপে নয়। এরা সব আওয়ামী ঘরানার আর নাস্তিক, যারা মুসলিম হিন্দু খ্রিষ্টান কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না। নাস্তিকদের নিয়ে বিচার বিচার খেলা শুরু হয়েছে। এরা বিচার মানে না, আইন মানে না। রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন করছে।’ বেগম জিয়ার দাবি, ‘সরকার ধর্মনিরপেতার নামে ধর্মহীনতার কাজ করছে। শাহবাগের তরুণেরা ফাঁসির জন্য লাফালাফি করছে, রাস্তা বন্ধ করে অপকর্ম করছে। তারা দেশের কোনো অনিয়মের কথা বলে না। দুর্নীতি-অনিয়ম-সীমান্ত সমস্যাসহ দেশের অন্য সমস্যাগুলো নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। কেবল ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই। আর এদের লালন করছে সরকার।’
আশির দশকের ১০১ ছাত্র নেতা ১৮ ফেব্র“য়ারি এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, শাহবাগ চত্বরে বিপ্লবীদের মূল চেতনা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। কিন্তু এ চেতনার সাথে ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবা ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য সংযুক্ত হলো কিভাবে? সন্ধ্যার পর সেখানে গাঁজার গন্ধে ঢোকা যায় না। গভীর রাতে সেখান থেকে পুলিশ গাড়ি ভরে হাজার হাজার ফেনসিডিলের খালি বোতল সরিয়ে নেয়। সে বিবৃতিতে দাবি করা হয়, তারা দেশপ্রেমিক এবং তাদের উদ্দেশ্য মহৎ। এটা প্রমাণ করতে তাদের অবশ্যই বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতেও তাদের কথা বলতে হবে। চার বছরে সরকার শেয়ারবাজার, কুইক রেন্টাল, পদ্মা সেতু, রেলওয়ে, হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপে-২ থেকে কয়েক ল কোটি টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করেছে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে। এসবও তাদের বলতে হবে। ওরা কস্মিনকালেও তা বলবে না। যুগে যুগে তারুণ্য সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। দুঃশাসন, অবিচার জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই তারুণ্যের সহজাত ধর্ম। রাজা-বাদশাদের হারেমে যেসব পুরুষ থাকত তারা ছিল দেখতে সুপুরুষ কিন্তু ‘খোজা’। হারেমের সুন্দরী ললনাদের পাহারা দেয়া এবং তাদের সেবায়েত হিসেবে এরা কাজ করত। রাজা বাদশারা নিশ্চিন্ত থাকতেন, এরা অন্তত তাদের রতিা নারীদের সাথে কোনো জৈবিক কাজে লিপ্ত হতে সম হবে না। শাহবাগের খোজা তারুণ্যকে কিভাবে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বযোগ্য ভাবা হচ্ছে আমরা তা বুঝতে অম।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাব
১৪ মার্চ ২০১৩ বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ইইউ পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তা শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতেই নয়, সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে তিগ্রস্ত করবে। ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে এতে বলা হয়েছে, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশী সংসদ গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং এ ধরনের অন্যান্য অপরাধের বিচারের জন্য আটক, অভিযোগ উত্থাপন ও শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট পাস করে। প্রস্তাব উত্তাপনের সময় বলা হয়Ñ মুখপাত্র ক্যাথরিন অ্যাশটোনের ২২ জানুয়ারি ২০১৩ বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রদানে উদ্বেগ, ২ মার্চ ২০১৩ এর নৈরাজ্যের পরিপ্রেেিত ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সংক্ষিপ্ত বিচার অথবা ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল প্রাণদণ্ড সম্পর্কিত জাতিসঙ্ঘ স্পেশাল রেপোটিয়ার ও বিচারক এবং আইনজীবীদের স্বাধীনতাবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের স্পেশাল রেপোটিয়ারের ৭ ফেব্র“য়ারি ২০১৩ প্রদত্ত যৌথ বিবৃতি, জাতিসঙ্ঘ সনদের নীতিমালা, ইউনিভার্সাল ডিকারেশন অন হিউম্যান রাইটস, ১৯৯৩ সালের ভিয়েনা ডিকারেশন অ্যান্ড প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন হিউম্যান রাইটস; ১৯৯৫ সালের কোপেন হেগেন ডিকারেশন অ্যান্ড প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন অন সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস, রুলস ১২২(৫) এবং ১১০(৪) এর রুলস অব প্রসিডিউর ইত্যাদি আন্তর্জাতিক আইন ইইউ’র প্রস্তাবটি পাশে বিবেচনায় নেয়া হয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে প্রস্তাবে বলা হয়েছে: ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি আইসিটি ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে আবুল কালাম আজাদকে তার অনুপস্থিতিতে বিচার করে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে। ৫ ফেব্র“য়ারি ২০১৩ আইসিটি আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলে তরুণরা আবেগতাড়িত কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে শাহবাগ মোড়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। তথাকথিত শাহবাগ আন্দোলন রায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান এবং ধর্মীয় উগ্রতা মুক্তসমাজ ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। প্রতিবাদের শুরুতেই সরকার ১৯৭৩-এর আইসিটি আইনে বাদী পকেও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ দিয়ে সংশোধনীও আনে, যাতে করে আদালত আবদুল কাদের মোল্লার প্রদত্ত রায়কে মৃত্যুদণ্ডে পরিণত করতে পারে। এ ধরনের রেট্রোস্পেকটিভ বিধান (আগে থেকে কার্যকারিতা দেয়া) স্বচ্ছ বিচার মানের লঙ্ঘন, আইসিটির বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং আন্তর্জাতিক আইনে দ্বিগুণ বিপদ (Double Jeopardy) (‘ne bis in idem’-এর নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে, যা ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের ধারা ১৪(৭)-এ উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশ এর একটি অংশীদার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধকরণ এবং দলটির সাথে সম্পৃক্ত মিডিয়া আউটলেট বন্ধে শাহবাগ আন্দোলনের দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে। ২৮ ফেব্র“য়ারি ২০১৩ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির (ভাইস প্রেসিডেন্ট) দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিগ্রহসহ নানা অভিযোগে আইসিটি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।
সর্বশেষ রায় ঘোষণার পর এর বিরুদ্ধে জামায়াতের প্রতিটি সমর্থকের প্রচণ্ড বিােভে ৬০ জনেরও বেশি লোক প্রাণ হারায়। এনজিওদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, জামায়াত সদস্য ও সমর্থকদের আক্রমণের জবাবে পুলিশ গুলি চালায় (প্রস্তাবে বলা হয়েছে লাইভ এমুনিশন)। আইসিটিতে চলমান অন্যান্য মামলায় আসামিদের অনেকেরই অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার ভয়ানক ঝুঁকি রয়েছে। জাতিসঙ্ঘের দু’জন বিশেষ প্রতিনিধি এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প থেকে ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছ বিচার ও যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পর্কে দুর্বলতার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে একটি বিচার আসামির অনুপস্থিতিতেই সম্পন্ন হয়েছে। সর্বমোট ১৪ অধ্যায়ে ইইউ’র প্রস্তাবের সমাপ্তি টানা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ১. আইসিটি রায়ের পর উদ্ভূত সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ এবং য়তির জন্য দুঃখ প্রকাশ। ২. সহিংসতার কারণে নিহত এবং আহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন। ৩. ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের বিষয়টি নিস্পত্তির জন্য ন্যায়বিচার এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব। আইসিটির এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর প্র্রদান। ৪. যেকোনো বিষয়ে এবং যেকোনো অবস্থায় মৃত্যুদণ্ডের কঠোর বিরোধিতার পে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করা। ৫. কঠোর দণ্ডের পরিবর্তে লঘুদণ্ডের বিধান এবং মৃত্যুদণ্ডের আইন পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপকে আহ্বান জানানো। ৬. আইসিটির কার্যক্রমে অনিয়মের অভিযোগ যেমন, প্রভাবান্বিত করা, অপমান ও স্বাী গুম, বিচারক ও প্রসিকিউটর ও সরকারের অবৈধ সহযোগিতার বিষয়ে অসন্তোষ। ৭. আইসিটি কর্তৃক দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিচারের মান বজায় রেখে নিরপে, প্রভাবমুক্ত এবং স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত ও আসামিদের সুরা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানানো। অধ্যায় ৮ থেকে ১৩ পর্যন্ত আরো বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাবনা রয়েছে। ১৪ নম্বরে ইইউ’র প্রেসিডেন্টকে এর কপি ইউরোপিয়ান কাউন্সিল, ইউরোপিয়ান কমিশন, ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল সার্ভিস, ভাইস প্রেসিডেন্ট অব দি কমিশন-হাই রিপ্রেজেনটেটিভ অব দি ইউনিয়ন ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসি, দি ইইউ স্পেশাল রিপ্রেজেনটেটিভ ফর হিউম্যান রাইটস, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকার এবং পার্লমেন্ট, জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল, জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ সরকার ও পার্লমেন্টকে পাঠাতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। (সম্মানিত পাঠকগণ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ওয়েবসাইট থেকে পাসকৃত প্রস্তাবাবলির হুবহু দেখতে পারেন। )
ইউরোপিয়ান পার্লমেন্ট সরাসরি ভোটে নির্বাচিত একটি ইইউ বডি, বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক সংসদ। ৫০ কোটি ইইউ নাগরিকের প্রতিনিধিত্বকারী এ পার্লমেন্টের সদস্য সংখ্যা ৭৫৪ জন। ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের ভোটারদের ভোটে এরা পাঁচ বছর অন্তর অন্তর নির্বাচিত হয়ে থাকেন। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ইইউ পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাশে বাংলাদেশ এখন বলতে পারে না তারা আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বলে বিশ্বে কিছুই নেই।
বাংলাদেশ বিশ্বায়নের যুগে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। বাংলাদেশের আইসিটির কোনো কোনো কার্যক্রমে বিশ্বজুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠলে এর গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়া অস্বাভাবিক নয়। সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে বর্তমান সরকারকেই আইসিটির ব্যাপারে আরো যতœবান হতে হবে এবং ইউরোপীয় পার্লমেন্টের পাসকৃত প্রস্তাবাবলির পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালোচনা এ মুহূর্তে খুবই জরুরি। এ দেশের প্রতিটি স্বাধীনতাকামী নাগরিকই মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী সব অপরাধের বিচার চায়, তবে সে বিচার হতে হবে স্বচ্ছ, নিরপে এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন