আজ ২৬ মার্চ। বাংলাদেশের ৪৩তম স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সৈনিক ও রণাঙ্গনের নেতা সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তার এই স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের নিষ্ঠুর সেনা শাসনের বিরচদ্ধে মুক্তিকামী বাংলাদেশের আপামর জনতার সংগ্রাম শুরচ হয় এবং দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস যুদ্ধ ও সংগ্রামের মাধ্যমে ঐ বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় লাভ করি। বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পূর্তির এই দিনে আমি সকল দেশবাসী দৈনিক সংগ্রামের পাঠক-পাঠিকা ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং স্বাধীনতা-সংগ্রামে নিহত, আহত ও সম্ভ্রমহারা সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
স্বাধীনতা প্রতিটি জাতির কাঙিক্ষত একটি বাসনা। স্বাধীনতা মানুষের মানবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা দেয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা, মতামতের স্বাধীনতা, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার এবং চাকরি-বাকরিসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধার সমান ও ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির অবাধ ও নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে সরকার নির্বাচনের অধিকার প্রভৃতি হচ্ছে স্বাধীন একটি দেশের যেকোন নাগরিকের অলঙ্ঘনীয় মৌলিক অধিকার। ১৯৪৭ সালে সর্বপ্রথম আমরা বৃটিশ শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাই। তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং আসামের সিলেট জেলা ও করিমগঞ্জ মহকুমার অংশবিশেষ গণভোটে বিপুলহারে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়ে পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তান আমলে উপরোক্ত মৌলিক অধিকারগুলো থেকে আমরা বঞ্চিত হই। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ে নির্বাচিত বিজয়ী দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক সরকার এ দেশের মানুষকে নির্মূল করার অভিযান শুরচ করে এবং এর ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়। আজকে স্বাধীনতার এই ৪৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা যখন আমাদের অবস্থা পর্যালোচনা করি তখন অত্যন্ত পরিতাপের সাথে দেখতে পাই যে, পাকিস্তান আমলের তুলনায় আমাদের অবস্থার অনেক বেশি অবনতি ঘটেছে। বাংলাদেশ এখন টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চলছে। সরকার তাদের বিরচদ্ধে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে নির্মূল অভিযান চালাচ্ছেন। এই দেশে এখন কারো মান-ইজ্জতের নিরাপত্তা নাই, জীবনের নিরাপত্তা নাই। সরকারি দল ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরা পুলিশের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে। যে কোন সময় যে কোন লোককে তারা ধরে অপমান, নির্যাতন ও লাঠিপেটা করে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। মানুষ গুম হচ্ছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য, অনৈতিক কর্মকান্ড, নারী নির্যাতন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। একে একে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। বিচার বিভাগকে সরকারের আজ্ঞাবহে পরিণত করার লক্ষ্যে এই বিভাগের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গুরচত্বপূর্ণ মামলায় সরকার তার অনুকূলে রায় দেবার জন্য রায়ের আগে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে সংশিষ্ট বিচারকদের বিপুল পরিমাণ অর্থপ্রদানের অভিযোগ উঠছে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নাই বললেই চলে। দাড়ি-টুপিধারী ধার্মিক ব্যক্তিরা সরকারের রোষানলে পড়ছে। পুলিশ দাড়ি দেখে মুসলxদের মুখে লাথি মারছে। পছন্দ অনুযায়ী মুসলxরা মসজিদে নামায পড়তে পারছেন না। সরকারের পুলিশ বাহিনী সেখানে তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছে এবং তলvশির নামে হয়রানি করছে। দেশের বরেণ্য আলেমদের বিরচদ্ধে একদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মিথ্যা অভিযোগ তুলে পাতানো মামলায় ফাঁসির ব্যবস্থা করা হচ্ছে অন্যদিকে আলেম-ওলামা এবং ধর্মপরায়ণ মুসলমানদের সন্ত্রাসী, জঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে এবং কুরআন-হাদীস ও ইসলামী বই-পুস্তককে সরকার ও পুলিশ বাহিনী ‘জেহাদী বই’ হিসেবে অভিহিত করার মাধ্যমে অবমাননা করে বাজেয়াপ্ত করছে। আলvহ তার প্রিয় রাসূল (সঃ), কুরআন-হাদিস, সাহাবায়ে কেরাম ও ইসলামের এবাদতসমূহকে অশxল ভাষায় অবমাননা করা হচ্ছে এবং সরকার এই অবমাননাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সরকার স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির নামে দেশকে বিভক্ত করে ফেলেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহত্তর একটি অংশকেও তারা স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। তাদের একটা অংশ পুলিশ, র্যাব ও দলীয় বাহিনীর রোষানলে পড়ে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। আরেকটা অংশ অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসাহীন অবস্থায় কালাতিপাত করছেন। এদেশের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অত্যাচার নির্যাতন উপহার দিয়ে সরকার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশীদের সম্মাননা দিচ্ছেন। এর মধ্যে আমি বাংলাপ্রবচন দেশী ঠাকুর মাড়িয়ে বিদেশী কুকুরকে প্রণাম করার গন্ধ পাই। দেশের বিদ্যমান এই অবস্থায় আমাদের স্বাধীনতার ৪৩তম বর্ষপূর্তির এই দিনে সরকারের উৎসাহব্যঞ্জক কোন কৃতিত্বের লক্ষণ আমি দেখতে পাচ্ছি না বলে দুঃখিত।
গ্রেফতার নির্যাতন ও ঘুষ বাণিজ্যের রেকর্ড
দেশে এখন হামলা, মামলা, গ্রেফতার নির্যাতনের একটি উন্মাদনা চলছে বলে মনে হয়। শুধু রাজধানী নয় সর্বত্র এখন পুলিশ বিশেষ করে গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সহায়তায় বাড়ি ঘর, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলের অফিস, সংবাদপত্রের অফিস এমনকি দেশের বেসরকারি খাতের শ্রেষ্ঠ স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তলvশি চালাচ্ছে। ব্যবসায়িক কর্মকান্ড, পারিবারিক সলাপরামর্শ, শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয় নিয়েও কেউ এখন একত্রে বসে কোনপ্রকার আলাপ-আলোচনা করতে পারেন না। জামায়াত-শিবির, ইসলামী দলগুলো এমনকি দেশের সর্ববৃহৎ বিরোধী দল বিএনপির নেতা-কর্মীরাও একত্রে এখন কোথাও বসতে পারেন না। পর্দানশীন মহিলা, ছাত্রী শিশুরাও নিরাপদ নন। পুলিশ ও ডিবির লোকেরা তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রেফতারের পর সংশিষ্ট ব্যক্তিদের অবস্থান সম্পর্কে কোন তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আটককৃত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। আর অর্থ না দিলে মারাত্মক অপরাধের জন্য দায়ী করে তাদের কোর্টে চালান দেয়া হচ্ছে। সরকারদলীয় নেতারা এবং পুলিশ বিভিন্ন মামলায় অজ্ঞাত আসামী নিয়ে আটক ও মুক্তি বাণিজ্যে জড়িত হয়ে পড়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিগত শত্রচতার বদলাও নেয়া হচ্ছে। প্রথম অবস্থায় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা এর শিকার হলেও বর্তমানে তাদের সাথে বিএনপি নেতাদেরও পাইকারি হারে এই অমানবিক নির্যাতনের শিকার বানানো হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপি অফিসে তলvশির নামে পুলিশী তান্ডব এবং ১৫৪ জন নেতা-কর্মীর আটকের ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সিএমএম আদালত গত ২০ মার্চ তারিখে পুলিশের দায়ের করা দু’টি মামলায় পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেফতারকৃত ১৫১ জন বিএনপি নেতা-কর্মীর বিরচদ্ধে ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এই বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এখন ডান্ডাবেড়ি ও হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় হাজতে আছেন। এদের অর্ধেক বসতে পারলে বাকিদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এবং এই হাজতখানায় ১১৯ জনের জন্য আছে মাত্র দুটি টয়লেট। রিমান্ডে নির্যাতনের কথা বাদ দিলেও হাজতখানায় এই অবস্থা আমাদের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সরকার কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছেন তা সহজে অনুমেয়। এ ধরনের ঘটনা পাকিস্তান আমলে হয়নি। ব্রিটিশ আমলের পৌনে দুশ’ বছরের গোলামী যুগেও হয়েছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। দেশের সিনিয়র আইনজীবী এবং রাজনৈতিক বিশেষকরা এই ঘটনাকে শুধু বেআইনী নয়, অভূতপূর্ব রাজনৈতিক নির্যাতন বলেও অভিহিত করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একটি স্বাধীন দেশের সরকার যদি এটাই করবেন তাহলে পরাধীন দেশের সাথে আমাদের পার্থক্য কোথায়? জামায়াত-শিবির, বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের দশ লক্ষাধিক নেতা-কর্মী এখন ৪০ সহস্রাধিক মামলার আসামী।
আমরা এই গ্রেফতার নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানাই। এই রিমান্ডের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা তা আমরা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা রিমান্ড মঞ্জুরের প্রাক্কালে এর যৌক্তিকতা রেকর্ড করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে এবং কেন করছেন না তারা নিজেরাই তা ভালো জানেন। ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত আমাদের বিচার ব্যবস্থার একটা অপরিহার্য অংশ। আদালতের কাজ হচ্ছে মানুষকে মিথ্যা মামলা এবং নির্যাতন ও অবিচার থেকে রক্ষা করা। আদালত যদি এর নিশ্চয়তা দিতে না পারেন তাহলে অন্তত নির্যাতনের জন্য আসামীদের পুলিশ কাস্টডিতে দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যবস্থা করা যায়। এ ব্যাপারে যথাযথ নির্দেশনা প্রদানের জন্য আমরা উচ্চতর আদালতকে অনুরোধ করব। পুলিশী বাড়াবাড়ির ব্যাপারে পুলিশের মহাপরিদর্শকেরও গুরচত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সাধারণ মানুষের খাজনায় তাদের বেতন-ভাতা হয় এবং এ প্রেক্ষিতে কর্মচারী হয়ে দেশের মালিকদের পিঠে আঘাত করা, মারপিট করা বা গুলী করে পঙ্গু ও হত্যা করার অধিকার তাদের নেই। আরেকটি বিষয় বিবেচনা করার জন্য আমরা সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব। স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। কারারচদ্ধ হওয়া মানে এ অধিকারের পরিসমাপ্তি এবং একটি অবিচার। অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগে জেলে রাখা স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী। এ প্রেক্ষিতে কারারচদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে যখনি জামিনের আবেদন করা হয় তখনি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তার শুনানি এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে গড়িমসি অথবা সপ্তাহ, পক্ষ বা মাসাধিককাল পরে শুনানির তারিখ নির্ধারণ ইনসাফ সম্মত নয়। এটা অন্যায়ভাবে একজন মানুষের স্বাধীনতা হরণের শামিল। জেলা আদালত ও হাইকোর্টে বিচারাধীন জামিন সংক্রান্ত মামলাগুলোর ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। উচ্চ আদালত, সাবেক প্রধান বিচারপতিগণ, পুলিশের মহা পরিদর্শক এবং অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সবাইকে আমরা দেশে ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করব। বাংলাদেশ বর্তমানে যে পথে এগিয়ে যাচ্ছে তা দ্রচত বর্বর একটি দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং মানসম্মান নিয়ে এদেশে বসবাস করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।
৫৪ ধারার অপপ্রয়োগ ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা
এই উপমহাদেশে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমন করার জন্য ১৮৯৮ সালে ইংরেজ শাসকরা সর্ব প্রথম নিবর্তনমূলক ফৌজদারী আইন জারি করেন এবং এই আইনেরই ৫৪ ধারায় পুলিশকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা পরোয়ানা ছাড়া যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। তবে এখনকার মতো এই ক্ষমতার প্রয়োগ কখনো শর্তহীন ছিল না। আইন অনুযায়ী ৯টি কারণে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় এ ধরনের গ্রেফতারের ক্ষমতা রাখেন। এই কারণগুলো হচ্ছে : (১) কোনও ব্যক্তি আমলযোগ্য কোন অপরাধের সাথে জড়িত থাকলে, (২) যদি কোনও ব্যক্তি বেআইনীভাবে নাশকতা সৃষ্টি বা ঘরবাড়ি ভাঙ্গার লক্ষ্যে কোনও যন্ত্রপাতি রাখেন এবং এ সম্পর্কে পুলিশের কাছে নিশ্চিত তথ্য থাকে, (৩) সরকার কাউকে অপরাধী ঘোষণা করে আদশে জারি করলে, (৪) কেউ চোরাই মাল রাখলে, (৫) কেউ পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে, (৬) কেউ যদি প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে পালিয়ে যান, (৭) জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি জামিনের শর্ত ভঙ্গ করলে, (৮) শাস্তিযোগ্য অপরাধের সাথে জড়িত কোন ব্যক্তির সন্ধান পেলে এবং (৯) কোন ব্যক্তিকে যদি অন্য থানার পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারের জন্য অনুরোধ করে তাকে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার করতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের কাজে সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় পুলিশ বাহিনী ৫৪ ধারার ব্যাপক অপব্যবহার করছেন। আমি উপরে যে ৯টি কারণের কথা উলেখ করেছি এর কোনটি বিদ্যমান না থাকলেও নিতান্ত সন্দেহের বশে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ অত্যন্ত অমানবিকভাবে তাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, নিমণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের বেশিরভাগই আইনে বর্ণিত এই কারণগুলোর খোঁজখবর না নিয়েই পুলিশের কথা অনুযায়ী আসামীদের রিমান্ডে দিচ্ছেন এবং তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে যেন, তারা পুলিশের আজ্ঞাবহ। আগেই বলেছি ফৌজদারী দন্ডবিধির ৫৪ নং ধারাটি উপনিবেশিক আমলে প্রণীত এবং পরাধীন একটি দেশের নাগরিকদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমানোর জন্যই তা ব্যবহার করা হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে এটি চলতে পারে না। এই ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের যেমন পরিপন্থী তেমনি জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদেরও পরিপন্থী। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ নং অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এমন কোন পদক্ষেপ রাষ্ট্র বা তার কোন এজেন্সী গ্রহণ করতে পারবেন না। ৩২ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তিকে আইনানুগ প্রক্রিয়া ছাড়া তার জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সংবিধানের এই অনুচ্ছেদগুলো এবং এর তৃতীয়ভাগে বিধৃত মৌলিক অধিকারের :ধারাগুলোকে প্রতিনিয়তই লংঘন করে যাচ্ছেন। অবশ্য আওয়ামী লীগ দলটির জন্য এটি নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর গঠিত তাদের প্রথম সরকারের আমলেও তারা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনের জন্য এগুলো লংঘন করেছেন এবং নতুন নতুন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করে তা প্রয়োগ করেছেন। দলীয় বাহিনী, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত লাখ লাখ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ঐ সময়ে জীবন ও সম্পত্তি হারিয়েছেন, এদের অনেকেই পঙ্গু হয়েছেন। অনেকে বাস্ত্তচ্যুত হয়ে পথের কাঙ্গালে পরিণত হয়েছেন। এবং এর সবকিছুই করা হয়েছিল বিরোধী দল, মত ও কণ্ঠকে স্তব্ধ করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করে ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্ত করার জন্য। দলটি দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেও একই পন্থা অনুসরণ করেছিল এবং ৫৪ ধারার অপব্যবহার ঐ সময়ে নতুন মাত্রা পেয়েছিল। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শামীম রেজা রচবেলকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে তার ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায় এবং মিন্টু রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে রচবেল মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনা ঐ সময় সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং হত্যার অভিযোগে সংশিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরচদ্ধে মামলা হয়। জনমতের চাপে সরকার অপরাধীদের গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। মামলায় অপরাধীর যাবজ্জীবন শাস্তি হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে অপরাধী পুলিশ কর্মকর্তাকে ক্ষমা করে দেয় এবং এর ফলে অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তারাও ৫৪ ধারার অপব্যবহারে আরো বেশি উৎসাহিত হয়ে পড়ে। তাদের বর্তমান কর্মকান্ডে তারই প্রতিফলন ঘটছে।
বলাবাহুল্য ১৯৯৮ সালের ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট এই ধারার অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন পেশ করেছিল এবং আদালত এ প্রেক্ষিতে সরকারের ওপর রচল জারি করেন। রচলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট এই ব্যাপারে সরকারকে কয়েক দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। এই নির্দেশনাগুলো হচ্ছে: (১) আটকাদেশ দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না; (২) কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে; (৩) গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে এর কারণ জানাতে হবে; (৪) বাসা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে; (৫) গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে; (৬) ওই ব্যক্তিকে আবার জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাঁচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন; (৭) জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে, (৮) পুলিশী হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এই যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার আদালতের এই নির্দেশানাগুলোর কোনটিই মানছেন না। এবং তারা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য দল এবং দেশের খ্যাতনামা আলেম-ওলামা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহকে নির্মূলের লক্ষ্যে আইনের অপব্যবহার এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনাসমূহকে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে উপেক্ষা করে চলেছেন। একদিকে আইন ও আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা অন্যদিকে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা ও দলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন- এই এক বিস্ময়কর বৈপরীত্য বটে। এর আশু অবসান হওয়া প্রয়োজন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন