অত্যাচারী জালেম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা উত্তম জিহাদ’-আল হাদিস। সম্প্রতি বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার কয়েকটি বক্তব্য বিভিন্ন মহলে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া দু’টি রায়কে কেন্দ্র করে এক দিকে শাহবাগের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ এবং অপর দিকে জামায়াত-শিবিরের প্রতিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেেিত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ঠিক এ সময় সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসে বিরোধীদলীয় নেতা ও ১৮ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে ‘সময়ের এক সাহসী উচ্চারণ’ করেন। তিনি বলেন, সরকার প্রতিবাদী জনগণের ওপর ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে। আবার যদি একটি গুলি চলে তাহলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। বেগম জিয়ার সেদিনের বক্তব্য ছিল নিরাপত্তাহীন জনগণের জন্য এক কঠোর প্রতিশ্র“তির প্রকাশ।
সাম্প্রতিক গণহত্যা
বেগম খালেদা জিয়ার প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহলে কয়েক দিন ধরে বেশ আলোচনা চলছে। সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকারের হাতে এতগুলো মানুষের জীবনহানির ঘটনা আর নেই। দেশ তো সব েেত্রই দ্বিধাবিভক্ত। সুতরাং সরকারপ বলছে, বেগম জিয়া একে ‘গণহত্যা’ বলে ১৯৭১ সালের ‘গণহত্যা’কে ছোট করে ফেলছেন। এমনকি সরকার যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এক দিনে ৬০ জন মানুষ হত্যা করেছে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তার কোনো প্রতিবাদ না করে বেগম জিয়ার ‘গণহত্যা’ পরিভাষা ব্যবহারের সমালোচনা করেছেন। টেলিভিশনের বিভিন্ন আলোচক ও উপস্থাপকও পুলিশের মানুষ হত্যার সমালোচনা না করে বেগম জিয়ার পরিভাষা নিয়ে সমালোচনা শুরু করেন। সরকারবিরোধীরা বলছেন, বেগম জিয়া যথার্থই বলেছেন যে, সরকার ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে। ফরহাদ মজহার ‘গণহত্যা’র আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, বেগম জিয়া একটুও ভুল বলেননি। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশ ও বিজিবি ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিবাদী মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, সরকার একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দমননীতি চালাচ্ছে। পুলিশের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি মহাসচিব, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও হত্যাকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন ও কাবা শরিফের ইমামও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদলীয় নেতার অভিযোগের কোনো সন্তোষজনক জবাব আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য বেগম জিয়াই দায়ী। তার এ মন্তব্য মানবতার সাথে উপহাস ছাড়া আর কিছু নয়। কয়েক দিন পর বেগম জিয়া তার স্বভাবসুলভ আপসহীন কণ্ঠে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, তিনি মতায় যেতে পারলে সাম্প্রতিক ‘গণহত্যা’র জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ দায়ী ব্যক্তিদের ট্রাইব্যুনালে বিচার করবেন। বলার অপো রাখে না যে, প্রতিটি মানুষের জীবনের সমান মূল্য রয়েছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া। কেউ বিনা বিচারে কোনো মানুষ হত্যার অধিকার রাখে না। এমনকি সরকারও নয়। সুতরাং আজকে যাদের বিনা বিচারে হত্যা করা হলো, তাদের স্বজনদের বিচার চাওয়ার অধিকার রয়েছে। বেগম জিয়া অভিযোগ করেছেন যে, নিহত ব্যক্তিদের লাশের ময়নাতদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। কারণ সরকার পুলিশের বেআইনি হত্যাকাণ্ডের আলামত নষ্ট করেছে। কিন্তু সত্য হয়তো এক দিন বেরিয়ে আসবেই। পঁচিশ বছর পরে যদি শেখ মুজিব হত্যার এবং ৪০ বছর পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সঙ্ঘটিত অপরাধের বিচার হতে পারে তা হলে ১৫০ জন নাগরিক হত্যার বিচারও এক দিন হতে হবে। রক্তের দাগ হাতে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতেই হবে।
শাহবাগীদের আন্দোলন
বেগম জিয়ার বহুল আলোচিত দ্বিতীয় রূঢ় সত্য কথাটি ছিল শাহবাগে তরুণদের আন্দোলন নিয়ে। যখন দেশব্যাপী ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ আলোড়ন তুলল, হাজার হাজার মানুষ তাতে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় জড়ো হতে লাগল; অনেকেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না সেখানে কী হতে যাচ্ছে; মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে বেগম জিয়া সত্যের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সরকারের মুখোশ উন্মোচন করে দিলেন। তিনি বললেন, নাস্তিক ব্লগার ও আওয়ামী লীগাররা শাহবাগে জড়ো হয়ে সেখানে অপকর্ম করছে। বেগম জিয়ার এই মন্তব্য নিয়ে এখনো চলছে বহু আলোচনা-সমালোচনা। বিষয়টিকে বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের সমর্থকেরা বলেন, শাহবাগে মুক্তযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত তরুণরা সমবেত হয়েছে। তরুণদের এই উচ্ছ্বাসকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, শাহবাগের তরুণরা হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ, ১৪ দলীয় মহাজোটের অন্যান্য দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ও জোটের বাইরের আরো কিছু বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী। তাদের উৎসাহ ও সহযোগিতা দিয়েছে সেকুলার তথা আওয়ামী-বামজোটের সাংস্কৃতিক জোটের নেতাকর্মীরা। আরো ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বাম ও সেকুলার শিক। এসব তরুণকে আকাশে তুলে ধরেছে বেশকিছু মিডিয়া। মিডিয়ার কোনো কোনো প্রতিবেদকের ভাষায় কোটি কোটি(?) তরুণ নাকি শাহবাগে হাজির হয়েছিল। চ্যানেলগুলো এত ব্যয়বহুল লাইভ কাভারেজ কীভাবে করল এখন অনেকেই সে প্রশ্ন তুলেছেন। সরকার শাহবাগীদেরকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, কয়েক সপ্তাহ ধরে বিরিয়ানি-মিনারেল ওয়াটার, খরচাপাতি, মোবাইল টয়লেট আরো কত কিছু সরবরাহ দেয়া হয়েছে নিরবচ্ছিন্নভাবে! আওয়ামী লীগ নেতারা অতি উৎসাহে একে বললেন ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শাহবাগে যে তরুণেরা জড়ো হয়েছিল তারা কি দেশের সব তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করে? তাদের চিন্তাচেতনা কি সব তরুণ ধারণ করে? মোটেই না। আজকে যাদের বিরুদ্ধে সরকার ‘সর্বাত্মক ীপ্রতার সাথে’ অভিযান চালাচ্ছে সেই ছাত্রশিবিরের সবাই তো তরুণ। তাদের প্রতিবাদী তৎপরতা সামলাতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই একবার বলেছিলেন যে, ‘ছাত্রশিবিরের তরুণরা কেন জামায়াতের ১৯৭১ সালের ভূমিকার দায়ভার নেবে, তা যেন তারা ভেবে দেখে।’ আবার জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তো দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠন বলে পরিচিত। সংগঠনটির সবাই তরুণ। তারাও শাহবাগ মঞ্চে যায়নি। তারাও শাহবাগীদের সাথে একই চেতনায় বিশ্বাসী নয়। এ ছাড়া রয়েছে লাখ লাখ তরুণ যারা কোনো দল বা সংগঠন করে না। দেশের মাদরাসাগুলোর লাখ লাখ ছাত্র রয়েছে যারা অবশ্যই তরুণ এবং তারা কেউই শাহবাগে যায়নি। এমন তথ্যও তো রয়েছে যে, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করা হয়েছে শাহবাগে যেতে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, দেশের তরুণদের একটি বিরাট অংশ শাহবাগে তো যায়নি; বরং তারা তাদের চেতনার সাথেও একমত নয়। এটা আজ আর কারো বুঝতে বাকি নেই যে, শাহবাগে তরুণদের সমাবেশের নামে কৃত্রিম নাটকের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাধারণত তরুণদের উচ্ছ্বাস ঘটে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু সচেতন তরুণেরা সবিস্ময়ে ল করল যে, এরা বর্তমান সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করল না। তারা আদালতের একটি রায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে: ‘সব রাজাকারের ফাঁসি চাই দিতে হবে’। শিশুদের বুলি শেখানো হলো ‘ফাঁসি চাই, জবাই করো’- যারা এর অর্থ বোঝে না। ‘ভালোবাসার’ পরিবর্তে তাদের শেখানো হলো ‘ঘৃণা ও প্রতিহিংসা’। কিছু অবিবেচক অভিভাবক তাদের শিশুদের নিয়ে সেখানে হাজির হলো। চলতে লাগল নাচ-গান। কলকাতা থেকেও এলো অনেকে। শোনা যায় শাহবাগে দেদার চলেছে মাদকের বাজার। রাতেও অবস্থান করল তরুণীরা। দু’টি কিশোর তো ফাঁসি খেলা খেলতে গিয়ে জীবন দিলো। দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের অনেকেই শাহবাগকে তুলে ধরলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণদের জাগরণ হিসেবে। কেউ কেউ মিসরের তাহরির স্কয়ারের সাথে তুলনা করলেন। ভারতীয় পত্রিকা বলল ‘এটা বাংলাবসন্ত’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে উচ্ছ্বসিত ও আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, তিনি শাহবাগের তরুণদের সাথে হৃদয় দিয়ে একমত পোষণ করেন এবং তিনি স্পষ্টতই তরুণদের আবেগের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে রায় দেয়ার জন্য বিচারকদের নসিহত করলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য সুস্পষ্টভাবে আদালতের ওপর হস্তপে বলে আইনজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
এরই মধ্যে তাদের অন্যতম সংগঠক নাস্তিক রাজীব (থাবা বাবা) খুন হয়ে গেল। হঠাৎ করে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। সরকারের নেতারা দিশেহারা হয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী আগ-পাছ না ভেবে ছুটে গেলেন রাজীবের বাসায় শোক প্রকাশ করতে। সংসদে সরকারি দলের এমপিরা আলোচনার তুমুল ঝড় তুললেন। তোফায়েল আহমেদের মতো সিনিয়র নেতা রাজীবকে বললেন ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ’। শাহবাগীদের সব কেরামতি ফাঁস হয়ে গেল যখন দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক আমার দেশ শাহবাগী ব্লগারদের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রকাশ করল। ভারতীয় পত্রিকা জানাল ভারতের মদদেই শাহবাগ আন্দোলন চলছে। সবাই তখন কান খাড়া করল। দেখা গেল রাজীবের নামাজে জানাজায় ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করা হলো না। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো নেতা এর তীব্র সমালোচনা করলেন। তিনি অবশ্য সাথে সাথে পুরস্কারও পেলেন; তাকে শাহবাগী তরুণরা ‘রাজাকার’ বলে অভিহিত করল। ডা: ইমরান সরকারের নেতৃত্বে সেকুলার, বাম ও নাস্তিক তরুণদের নেতৃত্বে শাহবাগ থেকে সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে একটি বাক্য তো উচ্চারণ হলোই না; উল্টো যেসব মিডিয়া সরকারের সমালোচনা করে তাদের নিষিদ্ধ করা এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের দাবি তোলা হলো। আরো আগ বাড়িয়ে তারা ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করে তা দখল বা বাজেয়াপ্তের দাবি জানাল। অনেক স্থানে ইসলামী ব্যাংকে হামলা হলো। এরূপ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের পরিস্থিতিতে বেগম জিয়া বললেন, শাহবাগীরা ধর্মদ্রোহী, নাস্তিক। তারা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না। তারা একটি দলের হয়ে কাজ করছে। তিনি আরেকবার বলেছেন, ওরা নাস্তিক ও আওয়ামী লীগার।
শাহবাগের যে তরুণেরা জাগরণ মঞ্চের নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের অনেকেই নাস্তিক বলে পরিচিত। এদের কারো কারো নাম পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। যারা এদের সহযোগিতা করেছে তাদের মধ্যে ধর্মানুরাগী কোনো ব্যক্তি নেই। তবে কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের নেতারা সেখানে ছিলেন। যারা এ দেশে মঙ্গল প্রদীপ সংস্কৃতি চালু করতে সক্রিয় তারা প্রায় সবাই ছিলেন। যারা কথায় কথায় ধর্মকে কটা করতে আনন্দ পান, তারাও ছিলেন। আসলে যারা আল্লাহ, রাসূল সা: ও ইসলাম সম্পর্কে অশ্লীল কটূক্তি করে তাদের সাথে কোনো ঈমানদার লোক থাকতে পারে না। কোনো নাস্তিককে কোনো মুসলমান সহযোগিতা করতে পারে না, তাহলে সে আর ঈমানদার থাকে না। বেগম জিয়া তাদেরই নাস্তিক বলেছেন যারা ইসলামকে নিয়ে অবমাননাকর কর্মকাণ্ড করে। শুধু বেগম জিয়া কেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদও শাহবাগীদের প্রচণ্ড সমালোচনা করেছেন। দেশের বিশিষ্ট আলেমসমাজ প্রচণ্ড ােভে ফেটে পড়ছেন।
যারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানতে চায় না, সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার স্বাধীনতা ও সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, যারা অন্যের বৈধ সম্পত্তি দখলে নিতে চায়, যারা সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা না করে বরং আড়াল করতে চায়, যারা ধর্মীয় দলকে নিষিদ্ধ করতে চায় অর্থাৎ বিরুদ্ধ মতের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারে না, যারা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের বিপরীতে জাতিকে চালাতে চায়, যারা ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতিকে বিভক্ত করে প্রতিহিংসার বিষবাষ্প ছড়াতে চায় তাদের চিনতে অন্যেরা দেরি করলেও বেগম জিয়া ঠিকই দ্রুত তাদের চিনে ফেলেছেন। আর এতে ফলও পাওয়া গেছে; শাহবাগীদের হুঙ্কার বেলুনের মতো চুপসে গেছে। দেশের সব প্রান্ত থেকে জনগণ তাদের প্রতিরোধ করতে শুরু করেছে। সরকারের উদ্যোগে মঞ্চস্থ নাটকের প্রায় যবনিকাপাত ঘটছে দর্শকের অভাবে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিপ্লব বা গণজাগরণ ঘটে এমন কথা কেউ কি কোনো দিন শুনেছে? সুতরাং বেগম জিয়া শাহবাগীদের ব্যাপারে যেন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন, যা সরকারি দলের জন্য বিরাট মনোবেদনার কারণ হয়ে উঠেছে।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু নাস্তিক ও প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রকাশের জন্য বেগম জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জবাবে বলতে হয় : রতনে রতন চেনে। ইনু সাহেবরাই তো ভালো জানেন কারা নাস্তিক। কারণ তারা তো ধর্মের প্রতি আস্থাশীল নন। তাদের নেতা কার্ল মার্কস তো ধর্মকে আফিম বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের কোনো ধর্মপ্রাণ মানুষকে তো তারা পছন্দ করেন না। নাটকে হোক আর রাজনৈতিক স্লোগানে হোক, ধর্মকে বিশেষত ইসলাম ধর্মকে কটা করাই তো তাদের প্রধান কাজ। ধর্মীয় দলকে নিষিদ্ধ করার জন্য তারা জিগির তুলেছেন। আবার মাঝে-মধ্যে ইসলামের জন্য দরদও দেখান। যখন দেখতে পান যে, জনগণ তাদের ধর্মহীনতায় বীতশ্রদ্ধ তখন তারা হঠাৎ ভালো মুসলমান সেজে যান। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘কিছু লোক এমন আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি, অথচ আসলে তারা মুমিন নয়। তারা আল্লাহর সাথে ও যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে ধোঁকাবাজি করছে। কিন্তু আসলে তারা নিজেদেরই প্রতারণা করছে, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়। তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে রোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। যখই তাদের বলা হয়েছে, জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা এ কথাই বলেছে, আমরা তো সংস্কারবাদী। সাবধান! এরাই ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।’ (সূরা বাকারা : আয়াত-৮-১২)
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা
তৃতীয় বিষয়টি হলো দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতন প্রসঙ্গে। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলে সুপরিচিত। তা সত্ত্বেও একটি মহল সুযোগ বুঝে রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার মতলবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন করে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের বেশির ভাগ ভোট পেয়ে থাকে; অবশ্য বিএনপি-জামায়াতও যে তাদের ভোট পায় না তা বলা যাবে না। বিভিন্ন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় তাদের প্রার্থীরা জয়লাভ করে থাকে। দুর্ভাগ্যজনক যে, বর্তমান সেকুলার সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। সরকার গৎবাঁধা বুলি আওড়ে বলে চলেছে যে, এগুলো বিএনপি-জামায়াতের কাজ। বিএনপি-জামায়াত তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ করেছে। ঘটনার সূত্রপাত সেই কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধমন্দিরে অগ্নিসংযোগ থেকে। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে, সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তব্যে অবহেলারও অভিযোগ উঠেছে। দ্বিতীয় কথা হলো : কারা এসব ঘটিয়েছে? সরকার তদন্তের আগেই বিএনপি-জামায়াতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেও বিভিন্ন মিডিয়ার তথ্যচিত্র থেকে এটা যথেষ্টভাবে প্রমাণিত যে, সরকারি দলের লোকেরাই এর সাথে জড়িত ছিল। তৃতীয়ত, যুক্তি কী বলে। বিএনপি-জামায়াত তো সংখ্যালঘুদের ভোট তেমন একটা পায় না, তাহলে তারা তাদের ওপর আক্রমণ করলে তো ভোট আরো কমবে। অপর দিকে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীন করে তাদের বলতে পারে যে, দ্যাখো বিএনপি-জামায়াত নয়; আওয়ামী লীগই তোমাদের একমাত্র ভরসা। এ ছাড়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘিœত হলে ভারতকে এই মেসেজ দেয়া যায় যে, আওয়ামী লীগকে মতায় না রাখলে সংখ্যালঘুরা নিরাপদে থাকবে না। এভাবে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের নিয়ে নির্মম রাজনৈতিক খেলা খেলে থাকে। কয়েক দিন আগে এ বিষয়ে তথ্য ফাঁস করেছেন, বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক রাফিউর রাব্বী, যার কিশোর ছেলে ত্বকী ক’দিন আগে নির্মমভাবে অপহরণ ও খুন হয়েছে। তিনি জনসমাবেশে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন যে, আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের লোকেরা তার ছেলেকে খুন করেছে। এ সময় তিনি আরো বলেন, বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে শামীম ওসমান মন্দিরে মূর্তি ভেঙে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তাকে ভোট না দিলে মন্দির রা হবে না। (দৈনিক নয়া দিগন্ত : ১৬ মার্চ ২০১৩)
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সংখ্যালঘু পরিবারে জন্মগ্রহণকারী মিনা ফারাহ লিখেছেন : ‘সাম্প্রতিককালের গণহত্যা আর প্রশাসনিক ব্যর্থতা আড়াল করতেই একটি গোষ্ঠী আর দলের নামে মন্দির ও গির্জা (প্যাগোডা) পোড়ানোর উৎসব শুরু করেছে। জামায়াত সরাসরি অস্বীকার করেছে মন্দির পোড়ানোর অভিযোগ, আমি একমত।’ মিনা ফারাহ আরো লিখেছেন : ‘… অক্সিজেনের ওপর বেঁচে থাকা সরকার নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। টার্গেট জামায়াতের সম্পত্তি। এটা ভাঙলে দুর্গ ভাঙবে। এর একটি প্যারালাল খুঁজে পাওয়া যাবে ’৭৫ সালের অর্পিত সম্পত্তির সাথে। (তখন) বিল পাস হলেই শুরু হলো লুটপাট আর মূলত লাভবান হলো আওয়ামী লীগ। … ইসলামি সংগঠনগুলোর প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির দিকে এবার লোলুপ দৃষ্টি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এভাবেই অন্যের সম্পত্তি দখলের ক্যান্সার ছড়িয়ে দিলো আওয়ামী লীগ।’ তিনি আরো লেখেন : হিন্দুরা প্রতিবাদ না করে পালিয়ে গেলেও জামায়াত-শিবির রুখে দাঁড়িয়েছে। ৬ মার্চের পত্রিকাগুলোর রিপোর্ট, দুষ্কৃতকারী যুবলীগের ছেলেরা হাতেনাতে গ্রেফতার। এবারের ঘটনাগুলো উদ্বেগজনক হওয়ার কারণ, বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে সরকার তুরুপের তাস কাজে লাগাচ্ছে। (দৈনিক নয়া দিগন্ত : ১৬ মার্চ ২০১৩)
এ প্রসঙ্গে প্রেস কাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ লিখেছেন : ‘সরকারের অস্তিত্বের জন্য শেষ ফন্দি ছিল সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের জিগির তোলা। দুনিয়াকে বিশেষ করে ভারতকে দেখানো যে জামায়াতের লোকেরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন করছে। আওয়ামী লীগই বেশির ভাগ েেত্র করেছে। পুলিশ নিশ্চুপ থাকছে; রামুর দাঙ্গার সময় যেমন উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে জেগেও ঘুমিয়েছিল। বেশ কিছু হিন্দু পরিবার স্থানীয় আওয়ামী লীগারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে নিরাপত্তাহীনতার জন্য থানায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। সবাই বিশ্বাস করেন, সরকারের প্রত্য মদদ এবং পরো ইন্ধন ছাড়া বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না।’ (দৈনিক আমার দেশ : ১৯ মার্চ্চ ২০১৩) আরো মজার খবর হলো, সম্প্রতি ভারতের আউটলুক পত্রিকায় পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত অভিনেত্রী শ্রীলা মজুমদারের স্বামী এস এন এম আবেদী লিখেছেন : ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো তারা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কোনো হিন্দুকে হত্যা করে না। সততার সাথে বলতে হয়, ভারতে হিন্দুত্ববাদী কিছু সংগঠনের হাতে যেভাবে মুসলমানেরা নিয়মিত টার্গেটে পরিণত হচ্ছে সেখানে জামায়াত নিষ্ক্রিয়ই। এ দলটি সম্পর্কে এটিই সরল সোজা কথা।’ (মাসুমুর রহমান খলিলী, দৈনিক নয়া দিগন্ত : ১৫ মার্চ ২০১৩) দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সিনিয়র সহসম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী লিখেছেন : ‘কারা কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এ অবস্থায় ফেলেছে, তাদের চিহ্নিত করে প্রতিহত করা জাতীয় স্বার্থে জরুরি। এই কর্তব্য পালনের পরিবর্তে জামায়াত-শিবির আর বিএনপির ঘাড়ে দায় চাপিয়ে এ থেকে ফায়দা লোটার চেষ্টা চালাতে থাকলে বিপদ আরো ভয়ঙ্ক রূপ নিতে পারে। —— এমন এমন জায়গায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে, যেখানে স্বাধীনতা পরে শক্তির দাপটে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে পানি খায়। পান্তরে সাতকানিয়ার একজন তিগ্রস্ত হিন্দু আমাকে বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় সদস্যরা চাঁদা তুলে তাদের অর্থ সাহায্য দিয়েছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন।’ সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, সরকারি দলের লোকেরাই সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে বিরোধী দলের বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ওপর দোষ চাপানোর অপকৌশল নিয়েছে। আর এটা বুঝতে পেরেই বেগম খালেদা জিয়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রার ওপর বিশেষ তাগিদ দিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন এবং নিজে মুন্সীগঞ্জে ছুটে গেছেন।
এক দফার আন্দোলন
বেগম জিয়া এখন এক দফার আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন : এ সরকার রক্তপিপাসু। তাদের সাথে আলোচনা করে কোনো লাভ হবে না। এ সরকারকে বিদায় দিতে আরো জোরালো আন্দোলন করতে হবে। যে সরকার গণতন্ত্রের আবরণে মতায় এসে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার পদদলিত করে, যারা প্রতিবাদী নাগরিকদের নির্বিচারে গণহত্যা করে, যারা বিচার বিভাগকে নির্লজ্জভাবে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে, যারা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, যারা নিরপে নির্বাচন চায় নাÑ সেই সরকারকে আর বেশি দিন মতায় থাকার সুযোগ দিলে তারা জাতির বিরাট তিসাধন করে ফেলবে। সুতরাং গণবিরোধী এই শক্তিকে আর বেশি দিন সময় দেয়া যায় না। বেগম জিয়ার এই উচ্চারণ ‘অত্যাচারী জালেম শাসকের সামনে সত্য কথা বলাই যে উত্তম জিহাদ’ ছিল তা ইতিহাসে লেখা থাকবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন