শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০১৩

পদ্মা সেতু নিয়ে ঢেঁকুর আবারও



এদেশে ‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা’ বলে একটি প্রবাদ রয়েছে। প্রবাদটির অর্থ এতই সহজ যে, তা কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। কথা উঠেছে মানুষের মুখস্থ হয়ে যাওয়া পদ্মা সেতু নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের দৌড়ঝাঁপের পরিপ্রেক্ষিতে। বাস্তব ক্ষেত্রে শুরচ থেকে হাওয়ার রাজ্যে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকলেও এই একটি সেতুকে ঘিরে ক্ষমতাসীনদের গালগল্পের যেন শেষই হতে চাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তিকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের পুনরচলে­খে যাওয়ার পরিবর্তে বর্তমান পর্যায়ে নতুন একটি চমকের কথা জানানো যাক। সরকারের ব্যবস্থাপনায় এই চমক দেখানোর জন্য সম্প্রতি দৃশ্যপটে এসেছেন এস সামি ভেলু নামের এক রহস্যপুরচষ। তাকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর অবকাঠামো বিষয়ক ‘বিশেষ দূত’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার নয়, গত ১৫ মার্চ এস সামি ভেলু নিজেই এক সংবাদ সম্মেলনে ‘সুখবর’ জানানোর মাধ্যমে চমকটি দেখাতে চেয়েছেন। বলেছেন, তারা নাকি বিশ্বব্যাংকের অনুমোদিত ডিজাইনেই মাত্র তিন বছরে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেবেন! তবে বিশ্বব্যাংকের মতো ২৯০ কোটি নয়, তারা বিনিয়োগ করবেন আরো কম- ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্য কিছু আগাম তথ্যও জানিয়ে রেখেছেন মিস্টার ভেলু। যেমন, প্রথম পাঁচ বছর বাংলাদেশকে কোনো টাকা দেয়া হবে না। পরিবর্তে ২৬ বছরের মধ্যে তারা টোলের আয় থেকে আগে নিজেদের বিনিয়োগের পুরো অর্থ উঠিয়ে নেবেন। এ সময় পদ্মা সেতুর নিট আয় হবে ৭৪৯ কোটি ডলার। আয়ের ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ৫২০ কোটি ডলার মিস্টার ভেলুরা নিয়ে যাবেন, বাকি ৩০ শতাংশ বা ২১৯ কোটি ডলার দেবেন বাংলাদেশকে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে নাকি আলোচনা হয়েছে, সরকার নাকি সম্মতিও জানিয়েছে। বাকি রয়েছে চুক্তি স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা। চুক্তি স্বাক্ষর হলেই শুরচ হয়ে যাবে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ।
সাধারণভাবে শুনতে মন্দ না লাগলেও এই সুখবর এবং চমকটি কিন্তু জনমনে কোনো আস্থা তৈরি করতে পারেনি। এর কারণও দু-চারটি মাত্র নয়। একটি প্রধান কারণ মিস্টার এস সামি ভেলুর প্রকৃত পরিচিতি। তাকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ দূত’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলেও তিনি আদৌ মালয়েশিয়ার নাগরিক নাকি মূলত একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ১৫ মার্চের সংবাদ সম্মেলনটি রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পর্যায়ে আয়োজিত হয়নি। সেখানে মালয়েশিয়ার বা বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। তৃতীয়ত, মালয়েশিয়াকে টেনে আনা হলেও মিস্টার ভেলুর নাকি দুবাইভিত্তিক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্তা হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। এর আগে, গত বছরের ফেব্রচয়ারিসহ বিভিন্ন উপলক্ষে শুধু মিস্টার ভেলুর নামই শোনা যায়নি, একই সঙ্গে এদেশেরই কারো কারো সংশি­ষ্টতার কথাও শোনা গিয়েছিল- যাদের সঙ্গে ‘সর্বোচ্চ’ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। উলে­খ্য, পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতিতে ‘সর্বোচ্চ’ পর্যায়ের সংশি­ষ্টতার অভিযোগেই বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। সে কারণেও মালয়েশিয়ার আড়ালে নতুন পর্যায়ে সর্বাত্মক দুর্নীতির আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
প্রসঙ্গক্রমে অন্য কিছু তথ্যের উলে­খ করা দরকার। এরকম একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য হলো, পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে হঠাৎ মালয়েশিয়াকে টেনে আনার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে সে সময় আলোচনা জমে উঠতে শুরচ করেছিল। এ বিষয়ে খুবই গুরচত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরচল ইসলাম আলমগীর। গত বছরের ১২ ফেব্রচয়ারি রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়ার যে কোম্পানি পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেবে বলে ক্ষমতাসীনরা হৈচৈ করে বেড়াচ্ছিলেন মির্জা আলমগীর সেই কোম্পানিটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানানোর দাবি জানিয়েছিলেন। মির্জা আলমগীর জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের শেয়ার বাজার থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে যাওয়া এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা থেকেই মালয়েশিয়ার কোম্পানির আড়াল নিয়ে বিনিয়োগ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে কি না। সবকিছু খোলাসা করে না বললেও মির্জা আলমগীরের দাবি ও জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সে সময় বেশজোরে শোরেই গুঞ্জন উঠেছিল। এসেছিল নানারকমের ব্যাখ্যাও। যেমন বলা হয়েছিল, মির্জা আলমগীর সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন, মালয়েশিয়ার এমন কোনো কোম্পানিকেই সামনে আনার চেষ্টা চলছে- যে কোম্পানির আসলে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো বিরাট প্রকল্পে বিনিয়োগ করার আর্থিক অবস্থা এবং অভিজ্ঞতার কোনোটাই নেই। অমন ধারণার ভিত্তিতেই মির্জা আলমগীর বলেছিলেন, শেয়ার বাজার থেকে যারা লক্ষ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে তারাই এখন মালয়েশীয় কোম্পানির আড়ালে টাকাটা বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘হালাল’ করতে চাচ্ছে। এরা যে ক্ষমতাসীন দলেরই লোকজন সে কথাটা বলতেও ভুল হয়নি মির্জা আলমগীরের। বিশেষ কারো কারো ব্যাপারে ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন তিনি। বলতে চেয়েছিলেন, ‘আকেলমান্দকে লিয়ে ইশারা কাফি হ্যায়!’
মির্জা আলমগীরের এসব কথার পিঠে সে সময় কথাও কম বাড়েনি। বিচিত্র অনেক তথ্যও তখন জানা গিয়েছিল। যেমন দৈনিক আমার দেশ এক রিপোর্টে জানিয়েছিল (১৪ ফেব্রচয়ারি, ২০১২), কোনো বিশেষ কোম্পানি একা নয়, মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত একটি কোম্পানিকে সামনে রেখে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে দুবাইভিত্তিক কয়েকটি কোম্পানির এক কনসোর্টিয়াম। তারা নাকি ২৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। কিন্তু শর্ত হলো, অর্থের ‘উৎস’ সম্পর্কে বাংলাদেশ বা মালয়েশিয়ার সরকার কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। অর্থাৎ এত বিপুল পরিমাণ টাকা আসলেও বাংলাদেশের শেয়ার বাজার থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে যাওয়া টাকার অংশ কি-না, এত টাকা যারা খাটাতে চাচ্ছিল তারা আসলে কারা এবং বাস্তবে এত বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করার সামর্থ্য তাদের রয়েছে কি না- এ ধরনের কোনো প্রশ্নই করা চলবে না। প্রাসঙ্গিক অন্য একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য হলো, সে সময়ও একই এস সামি ভেলুকেই পুরো বিষয়টির সমন্বয় করতে দেখা গিয়েছিল। তখন অবশ্য তার নামের আগে দাতো সেরি শব্দ দুটিও ছিল। বলা হয়েছিল, দাতো সেরি এস সামি ভেলু এখন মালয়েশিয়ার নাগরিক হলেও জন্মগতভাবে তিনি ভারতীয়। তার কাছ থেকেও দুটি বিশেষ তথ্য জানা গিয়েছিল। প্রথম তথ্যটি ছিল, অর্থের ‘উৎস’ সম্পর্কে প্রশ্ন করা যাবে না মর্মে শর্তটি এসেছিল ঢাকা থেকে- কুয়ালালামপুর বা দুবাই থেকে নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের যে মহলটি পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক প্রক্রিয়া ও কর্মকান্ডে জড়িত তারাই শর্তটি চাপিয়েছিল, যাতে বিনিয়োগকারীদের প্রকৃত পরিচিতি অন্ধকারেই থেকে যায়। দ্বিতীয় তথ্যটি পদ্মা সেতু নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর সংক্রান্ত। কথা ছিল, গত বছরের ২১ ফেব্রচয়ারি সরকারের সঙ্গে ‘ইউনাইটেড ইঞ্জিনিয়ার্স মালয়েশিয়া’ নামের একটি কোম্পানি চুক্তিটি স্বাক্ষর করবে। স্মরণ করা দরকার, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি মন্তব্য নিয়েও সে সময় অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছিল, জমে উঠেছিল রসাত্মক আলোচনা। কারণ, এর কিছুদিন আগে, ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে মিস্টার জয় ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাদের হাতে’ এখন ‘প্রচুর টাকা’। পদ্মা সেতু ‘আমরা’ নিজেরাই নির্মাণ করতে পারবো। মালয়েশীয় কোম্পানির পাশাপাশি দুবাইভিত্তিক অজ্ঞাত সূত্র থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে বলে রটিয়ে দেয়া খবরের সঙ্গে মিস্টার জয়ের কথাটাকে অনেকেই মিলিয়ে দেখেছিলেন। কথাটা তাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণও মনে হয়েছিল। অনেকেতো একথা পর্যন্ত বলেছিলেন যে, মির্জা আলমগীরও সেদিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন! অমন অনুমান সত্য হলে এ অভিযোগও অনস্বীকার্য হয়ে পড়ে যে, শেয়ার বাজারের এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার পুরোটাই লন্ডন-ওয়াশিংটনে যায়নি। একটা বড় অংশ সম্ভবত দুবাইয়ের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রয়েছে এবং মালয়েশীয় কোম্পানির আড়াল নিয়ে সে টাকাটাই বাংলাদেশে আসি-আসি করছে।
এতদিন পর এসে কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়ার পেছনে বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে। প্রধান বা আশু কারণ তৈরি করেছেন দাতো সেরি এস সামি ভেলু নামের ওই রহস্যপুরচষ। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, গত বছর ২০১২ সালের ৩০ জুন ঘুষ-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করার পর মুহূর্তেই ক্ষমতাসীনরা চমক দেখানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে প্রথমে দৃশ্যপটে এসেছিলেন নিজেদের ‘আন্দোলনের ফসল’ হিসেবে বর্ণিত জেনারেল মইন উ’দের অসাংবিধানিক সরকারের আমলে ‘কারাগারের পাঠশালায়’ বহু কিছু শিখে আসা যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২ জুলাই তিনি বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের মতো কোনো সংস্থার অর্থায়নে নয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে পিপিপি তথা সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। মন্ত্রী প্রসঙ্গক্রমে মালয়েশিয়ার নাম উলে­খ করে বলেছিলেন, দেশটি নাকি পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে অংশ নিতে আগ্রহী। অন্য দু-একটি রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠানও নাকি পদ্মা সেতুর নির্মাণে বিনিয়োগের জন্য দশ কদম এগিয়ে রয়েছে। দরকার শুধু সরকারের দিক থেকে সম্মতি জানানো এবং অনুমোদন দেয়া। তাহলেই নাকি বিনিয়োগের জোয়ার বইতে শুরচ করবে! অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও সে সময় যথেষ্টই শুনিয়েছিলেন। পহেলা জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে এবং তার পরদিন জাতীয় সংসদে এমনভাবেই সব দোষ তিনি বিশ^ব্যাংকের ওপর চাপিয়েছিলেন, যা শুনে মনে হচ্ছিল যেন বিশ^ব্যাংক বিএনপি বা জামায়াতের মতো বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল, যার বিরচদ্ধে যখন-তখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই বলা ও ব্যবস্থা নেয়া যায়! দেখা গেছে, বিশ্বব্যাংকের ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ অর্থমন্ত্রী রাগই সামাল দিতে পারছিলেন না। চুক্তি বাতিল করে যাওয়া বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিককেও তিনি এমন কঠোর ভাষায় তুলোধুনো করেছিলেন, যা শুনে মনে হচ্ছিল যেন ওই একজন মাত্র ব্যক্তির কারণেই ‘স্বপ্নের’ পদ্মা সেতু হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! মিস্টার মুহিত শুধু এটুকু বলতেই বাকি রেখেছিলেন যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক তাদের কাছে দু-চার লাখ ডলার ঘুষ চেয়েছিলেন কিন্তু তারা রাজি হননি বলেই বিদায়ের ঠিক প্রাক্কালে লোকটি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত ঋণচুক্তি বাতিল করে গেছেন!
এদিকে মন্ত্রীদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান বা অস্বীকার করার জন্য বিশ্বব্যাংককে এগিয়ে আসতে হয়নি। খোদ সরকারের আমলারাই একহাত নিয়েছিলেন। দিন-তারিখসহ চমক দেখানোর কথা বলে ওবায়দুল কাদের তাক লাগিয়ে দিলেও বাংলাদেশেরই সেতু বিভাগ কিন্তু দু’দিনের ব্যবধানে জানিয়েছিল, মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের কোনো প্রস্ত্ততি তখনও নেয়া হয়নি। ওদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বলেছিলেন, মালয়েশিয়ার কোনো কোম্পানিকে দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে তিনি নাকি কিছুই জানেন না! অর্থাৎ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তখন আসলে সত্য বলেননি। উলে­খ্য, মিস্টার মুহিত প্রসঙ্গক্রমে কঠোর একটি সত্যও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, অন্য কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করাতে হলে প্রথমে বিশ্বব্যাংকসহ সংশি­ষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করতে হবে। কথা শুধু এটুকুই নয়। বাংলাদেশ তথা আওয়ামী লীগ সরকার চাইলেই চলবে না, বিশ্বব্যাংক এবং অন্য সংস্থাগুলোকেও সম্মত হতে হবে। বিষয়টি মোটেও সহজ নয়। কারণ, নিজেদের অযোগ্যতা, অব্যবস্থাপনা এবং ঘুষ-দুর্নীতির কারণে সরকার আন্তর্জাতিক সব সংস্থার কাছে এমনভাবেই বাঁধা পড়ে আছে যে, চুক্তি বাতিল এবং অন্য কোনো রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সম্মতি পাওয়া সহজে সম্ভব হওয়ার কথা নয়। মাঝখানে চুক্তি বাতিল করার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংক এবং তার পর পর জাইকা ও আইডিবি অবশ্য সরকারের জন্য পরিস্থিতিকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও একদিকে বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর উত্থাপিত অভিযোগের এখনো মীমাংসা হয়নি, অন্যদিকে এসএনসি-লাভালিন নামের কানাডীয় যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে ঋণচুক্তি বাতিল হয়েছে সে প্রতিষ্ঠানের বিরচদ্ধে কানাডায় এখনো মামলা চলমান রয়েছে। বাংলাদেশেও দুদকের পক্ষ থেকে তদন্তের নামে নাটক কম মঞ্চায়িত হচ্ছে না। সুতরাং বিশ্বব্যাংকের মতো প্রভাবশালী সংস্থা এবং কানাডার মতো রাষ্ট্রের সঙ্গে সবকিছু ফয়সালা না করে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শুরচ করাটা সহজ হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া যতো ‘দন্তহীন ব্যাঘ্র’ই বলা হোক না কেন, ঘটনাপ্রবাহে দুদকও জড়িয়ে পড়েছে। দুদকের কার্যক্রমের প্রতি আবার বিশ্বব্যাংকসহ গোটা বিশ্বই নজর রাখছে। সে কারণে সরকার চাইলেই দুদককে রাতারাতি থামিয়ে দিতে পারবে না। এমন অবস্থায় মালয়েশিয়ার পক্ষেও পদ্মা সেতু নির্মাণে বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে না।
অন্য একটি বিষয়ও যথেষ্ট গুরচত্বের সঙ্গেই আলোচিত হচ্ছে- বিশেষ করে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ থেকে লাভের অংশ ভাগাভাগি পর্যন্ত তথ্য-পরিসংখ্যানগুলো মোটেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনি। ২৯০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি প্রকল্প কিভাবে ২৩০ কোটি ডলারে সম্পন্ন করা সম্ভব সে কথা যেমন জানানো হয়নি, তেমনি জানানো হয়নি সুদের প্রকৃত পরিমাণ সম্পর্কেও। কোনোকিছু তাই বলে আবার গোপনও রাখা যায়নি। যেমন প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, সামি ভেলু নামের রহস্যপুরচষকে সামনে রেখে চমক দেখানোর চেষ্টা করা হলেও সে প্রস্তাব ও তার হিসাবের মধ্যে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। সামি ভেলু যেখানে মালয়েশিয়া বিনিয়োগ করবে শুনিয়েছেন সেখানে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভীতিকর এক তথ্য। মালয়েশিয়ার সরকার বা কোনো ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানই আসলে বিনিয়োগ করবে না। বিনিয়োগ করার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে চীনের একটি কোম্পানির কাছে। সেটাও এখনো চূড়ান্ত হয়নি- এসব বিষয়ে চেষ্টা ও দেন-দরবার কেবল শুরচ হয়েছে। সামি ভেলুরা চেষ্টা করছেন চীন ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানির সমন্বয়ে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করার জন্য- যে চেষ্টা এর আগে দুবাইভিত্তিক কনসোর্টিয়ামের জন্য করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চীন-মালয়েশিয়া যদি কনসোর্টিয়াম গঠনও করে তথাপি কেবল সুদ হিসেবেই বাংলাদেশকে গচ্চা বা লোকসান দিতে হবে অন্তত ৪১ হাজার কোটি টাকা। অথচ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সেতু নির্মিত হলে সুদের পরিমাণ হতো মাত্র ২৫০ কোটি টাকা। প্রকাশিত রিপোর্টে সুদ ও আয়সহ বিভিন্ন খাতের বিস্তারিত পরিসংখ্যান রয়েছে। এতে দেখা গেছে, সামি ভেলু নামের মূলত ভারতীয় ব্যবসায়ীকে দিয়ে যে চমক দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, সে অনুযায়ী সত্যিই যদি পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরচ করা হয় তাহলে বাংলাদেশকে সবদিক থেকেই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। প্রবল আশংকা ও অনিশ্চয়তা থাকবে সেতুর আয়ুষ্কাল নিয়েও। বাংলাদেশ কোনোদিক থেকেই লাভবান হতে পারবে না। একই কারণে দেশপ্রেমিকদের মধ্যে আপত্তি ও প্রতিবাদ উঠেছে জোরেশোরে। ঠিক এ সময়ে এসেই আরো একবার পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে ঢেঁকুর তোলার পেছনে অন্য একটি উদ্দেশ্যও দেখতে পেয়েছেন অনেকে। বলা হচ্ছে, ভারতপন্থী নাস্তিকদের দিয়ে সাজানো ‘শাহবাগ নাটক’ ব্যর্থ হওয়ার এবং নাটকের উদ্দেশ্য ধরা পড়ে যাওয়ার পর জনগণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্য নিয়েই ক্ষমতাসীনরা নতুন করে গালগল্প শোনাতে শুরচ করেছেন। তারাই ভাড়া করে এনেছেন সামি ভেলু নামের ভারতীয় রহস্যপুরচষকে। কিন্তু এই পর্যায়েও ধরা পড়ে গেছেন তারা। একই কারণে ‘চুরি বিদ্যা’ সম্পর্কিত প্রবাদবাক্যটিকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তথ্যাভিজ্ঞরা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads