১১ মার্চ ২০১৩। ১৮ দলীয় জোটের পূর্বঘোষিত সমাবেশ শুরু হলো বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সম্মুখের রাস্তায় ৩টায়। ১০ সহস্রাধিক নেতাকর্মীর শান্তিপূর্ণ অবস্থানের মধ্য দিয়ে সভা শুরু হয়। বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য চলাকালে সমাবেশের খুব কাছেই কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় নেতাকর্মীদের হইচই শুরু হয়। জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় যে যেদিকে পারেন ছুটে পালালেন। জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা বিএনপির কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে বিএনপির কার্যালয়ে কয়েক শত র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযান শুরু হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত অভিযান চলে। তখন আটক করা নেতাদের মধ্যে ছিলেনÑ সাদেক হোসেন খোকা, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ জেড এম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, মোহাম্মদ শাহজাহান, রুহুল কবির রিজভী, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক প্রমুখ। রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে মিটিং শেষে বের হওয়ার পথে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধানকে। এ ছাড়া বিএনপির পল্টনের কার্যালয় থেকে দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, মহাসচিবের রুমের দরজা ভেঙে মির্জা ফখরুলকে গ্রেফতার করা হয়। সেই অফিসে নাকি ককটেল পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলো কেউই দেখেনি। একটি পার্টি অফিসে এ ধরনের নজিরবিহীন বর্বরোচিত হামলা প্রথম ঘটল এই সরকারের আমলেই।
১২ মার্চ প্রতিটি পত্রিকা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত ছাপিয়েছে। তারা বলেছেন, কোনো দলের কার্যালয়ে ঢুকে দরজা ভেঙে অফিস তছনছ করে, শার্টের কলার ধরে বন্দুকের মুখে কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতারের ঘটনা আর ঘটেনি। এ দৃশ্য অগণতান্ত্রিক ‘১/১১’ সরকারের শাসনামলকেও হার মানিয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারের চেহারা এত কুৎসিত হতে পারে না। এখন প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের বদৌলতে ঘরে বসে টিভির রিমোট কন্ট্রোল চাপলেই দেশের বহু চ্যানেল থেকে মুহূর্তের ঘটনা মুহূর্তেই জানা যাচ্ছে। ওই দিনে (১১ মার্চ) ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে কী ঘটেছিল আমরা দেখেছি। কুচক্রী মহল দ্বারা ককটেল ফাটিয়ে শান্তিপূর্ণ সভাটিকে অশান্তির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসবই পূর্বপরিকল্পিত। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ওরা হুকুমের অধীন। যেভাবে হুকুম দেয়া হয় সেভাবেই তারা অ্যাকশনের প্রস্তুতি নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে বড় বড় চাকরিতে কর্তব্যরত পরিচিতজনদের কাছ থেকে জেনেছি, ‘ওপরওয়ালা’দের পরিকল্পনায় এসব ঘটছে। পুলিশরা বলেছে, আমাদের সবাই ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে। জনগণের কাছে আমাদের খারাপ বানানোর প্রক্রিয়া চলছে। পুলিশকে জনগণের সেবক হতে হয়। তাদেরকে সেভাবেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জনগণের জানমাল নিরাপত্তা বিধানই তাদের মুখ্য কাজ। পুলিশ বাহিনী শুধু নয়, সরকারের প্রতিটি কর্মচারী এবং কর্মকর্তা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন পেয়ে থাকে। সরকার জনগণের টাকা দিয়েই প্রশাসনের ব্যয়ভার বহন করে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ২৪ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থেকে শুরু করে এই নিবন্ধ লেখার দিন ১২ মার্চ পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীর গুলিতে নিহত মানুষের সংখ্যা দেড় শ’ ছাড়িয়ে গেছে। মাত্র ১৫ দিনে এত মানুষের নিহত হওয়ার ঘটনাÑ বিশেষ করে রাজনৈতিক সহিংসতায়Ñ এদেশে নজিরবিহীন। ভাষা ও স্বাধীনতার মাসে এ ধরনের পৈশাচিক ঘটনা ইতিহাসের পাতায় কলঙ্কের অধ্যায় হিসেবে স্থান পেল। আগেই বলেছি, যে প্রশিক্ষণ ও নীতিমালা মেনে পুলিশ এই চাকরি নেয়ার সময়ে শপথ গ্রহণ করে জনগণের জানমালের রক্ষার ব্যাপারে, সেটা পুলিশ রক্ষা করতে পারে নাÑ যখন দলীয় সরকারের অধীনে চাকরি করে। ওরা পরিণত হয়ে যায় দলীয় ক্যাডার বাহিনীতে। নির্বাহী প্রধান থেকে শুরু করে সরকারের অধস্তন নেতারা এবং দলীয় ক্যাডার বাহিনী যদি বাধা না দেয়, তাহলে প্রতিটি সমাবেশই সুশৃঙ্খলভাবে শেষ হবে। বিগত বছরে বিএনপির এ ধরনের বহু সমাবেশ পল্টনের কার্যালয়ের সামনে হয়েছিল। কিন্তু সেসব সমাবেশে আজকের মতো এমন পুলিশি হামলা এবং কথায় কথায় মামলা তখন দেয়া হয়নি। দেশকে পিছিয়ে দেয়ার মতো এ ধরনের অগণতান্ত্রিক আচরণ এক কথায় জঘন্য।
কথা বলার অধিকার হরণ করে এবং গুলি করে-বেয়নেট চালিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না। এতে জনপ্রিয়তার ধস তলানিতেই ঠেকে। মহাজোট সরকারের অবস্থাটা কি আজ সে রকম নয়?
১৯৯৫ সালে জনতার মঞ্চের কারিগর আর আজকের শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের কারিগর মূলত একই। এসব কথা এখন কেউ কেউ পত্রিকায় লিখছেন। টকশোতে কেউ কেউ বলছেনÑ ওই ব্যক্তির দ্বারাই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কবর রচিত হবে। এখন এ দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা অনেকটা মুমূর্ষু। হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ারে অক্সিজেন দিয়ে রাখা রোগীর মতো বর্তমানে গণতন্ত্রের অবস্থা।
সরকার বারবার একই ভুল করছে। বলছেÑ বিরোধী দল জামায়াতের কাঁধে ভর করে এই সহিংস তাণ্ডব চালাচ্ছে, যাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিঘœ সৃষ্টি করা যায়।’ মূলত এই বক্তব্য যুক্তিতে টিকবে না। কারণ ১৮ দলীয় জোটের প্রধান শরিক, বিএনপি আগামী নির্বাচন যাতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়, এ দাবি যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়ার বহু আগ থেকেই অর্থাৎ ২০১০ সালের প্রথম দিক থেকে জানাচ্ছে। তখনই তাদের এই আন্দোলনের রূপরেখা রচিত হয়েছে। সরকার দেশের জন্য বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেছে বলে দাবি করে। তাহলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে তাদের এত ভয় কেন? এই প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আয়োজিত বিবিসির সংলাপেও প্রশ্নগুলো দর্শক সারি থেকে কেউ কেউ তুলেছেন। বিএনপি শুধু বলা নয়Ñ অঙ্গীকারও করেছে মিডিয়া সাক্ষাৎকারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের শুধু এই দাবিটি মেনে নিলে আমরা শুধু হরতাল নয়Ñ রাজনৈতিক অন্যান্য কর্মসূচি দেয়া থেকেও বিরত থাকব। উচ্চ আদালত থেকেও বলা হয়েছেÑ আরো দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে।’ আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই জনগণের দোহাই দেয়। তাহলে বিষয়টির ওপর গণভোট দিয়েও সঙ্কটের সুরাহা করা হচ্ছে না কেন? জনগণই যেখানে সব ক্ষমতার উৎস, সেখানে গণরায় নেবে না কেন? সংসদে বসে বিরোধী দলের যৌক্তিক এই দাবি মেনে নিন, বিএনপির আসারও প্রয়োজন নেই সংসদে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা মহাজোট সরকারের রয়েছে, সেহেতু তারাই পারেন পুনরায় সংশোধনী এনে সংবিধান সংশোধন করতে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সবাই চায় কি না, তা একটি বার পরীক্ষা করে দেখা হোক; অন্যথায় ‘গণতন্ত্র রক্ষা চত্বর’ কেউ না কেউ বানিয়ে ফেলতে পারে। আমরা আর গণতন্ত্রের আকাশে অশনিসঙ্কেত দেখতে চাই না। ওয়ান-ইলেভেনের মতো কোনো বিতর্কিত সরকারও দেখতে চাই না। আল্লাহ না করুনÑ এমন কোনো ঘটনা যদি পুনরায় ঘটে, তাহলে দেশের মানুষ সরকারকেই দায়ী করবে। কারণ বর্তমানে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার আসনে তারাই অধিষ্ঠিত। জাতীয় সমস্যার সুরাহা করতে হবে তাদেরকেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন