বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন চরম নিরাপত্তার অভাব আগে আর কখনও দেখা যায়নি। শাসনের এমন বিশৃঙ্খলাও অতীতে ঘটেনি। কর্মকান্ড দূরে থাকুক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বৈধ অফিসে বসতে পর্যন্ত পারছেন না। বিএনপির নয়া পল্টন কার্যালয় ভেঙে যেভাবে নেতা-কর্মীদের ধরে নেয়া হয়েছে, সেটা বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলেও কল্পনা করা যায়নি। সংবাদপত্রের অফিস থেকে যখন-তখন সাংবাদিকদের তুলে নেয়া হচ্ছে। সিনিয়র ফটো সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক নিবর্তনের সর্বশেষ উদাহরণ। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে যখন-তখন ধরার-মারার হুমকি দেয়া হচ্ছে। জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে সংবাদপত্রের অফিস ও গাড়ি। কর্তব্যরত সাংবাদিকদের অকাতরে পেটাচ্ছে ক্ষমতাসীন ক্যাডাররা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মানুষ মরছে নির্বিবাদে। জ্বলছে প্রতিপক্ষের অফিস, বাড়ি, দোকান। আইনের শাসনের সুরক্ষা পাচ্ছে না সংখ্যালঘুরাও। প্রমাণ পাওয়া গেছে ক্ষমতাধররা নিরীহ সংখ্যালঘুদের বসত ভিটা দখল করছে; লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করছে। চরম বিপর্যয়কে আড়াল করতে কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। রাজনৈতিক আবেগ ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক জীবনের মহান চেতনাকে হানাহানি ও প্রতিপক্ষ নিধনের কাজে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ও নেতিবাচকরূপে ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যর্থতাকে লুকানোর জন্য সাজানো হয়েছে শাহবাগ নাটক এবং একতরফা বিচার। প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠেছে গণআন্দোলন। সব দেখে মনে হচ্ছে, সাধারণ মানুষ এই মানবিক নিরাপত্তার চরম বিপর্যয়ের কবল থেকে বাঁচতে চায়। মানুষ এখন মুক্তির জন্য উতলা হয়ে গেছে। জনতার একটিই দাবি, এমন পরিস্থিতি আর চলতে পারে না। জনদাবির বিশালত্বের সামনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আর সরকার পতনের এক দফা দাবি মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে।
সকল ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও কুশাসন যখন স্পষ্ট, তখন বলা হচ্ছে আন্দোলনে শহীদ শত জনতার দায়িত্ব আমরা নেব না। ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার সব কিছু ভোগ করার পর দায়িত্ব না নেয়াটা চরম কাপুরচষোচিত কাজ। জনগণকে সুরক্ষা দেয়ার শপথ নিয়ে বিপদে ফেলে দেয়াটাও বিরাট বড় অন্যায়। সামগ্রিক পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে এমন বিপর্যয়ের পরেও চিন্তিত নন সংশিষ্টদের অনেকেই। তাদের কথা-বার্তা, কাজে-কর্মে মনে হচ্ছে, দেশে কিছুই হয়নি। শাসক শ্রেণী যখন জনগণের চাহিদা বুঝতে ব্যর্থ হন, তখন বিপদ আরও বৃদ্ধি পায়। আমরা এখন এমনই একটি অবিবেচক চক্রের খপ্পরে পড়েছি। যারা নিজের স্বার্থ, ক্ষমতা, দম্ভ ছাড়া কিছুই বোঝে না। গণতন্ত্রে যে বহুমত থাকতে হয়, সেটা মানে না। এহেন চরম স্বেচ্ছাচারের কারণে মানবিক বিপর্যয় প্রতিদিনই চরম থেকে চরমতর হচ্ছে।
হাজার মাইল দূরে থেকেও জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, উন্নয়ন সহযোগী দাতাগণ উদ্বিগ্ন হয়ে গেছেন। অনেকে পরিস্থিতিকে ‘গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে’ বলে অভিহিত করেছেন। দেশি-বিদেশি সকল মহল থেকে চলমান তীব্র সঙ্কট মোচনের জন্য আশু সংলাপ ও সমঝোতার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোথায় সংলাপ ও সমঝোতা? দিনের পর দিন নির্যাতন ও আক্রমণই ক্রমশ বেড়ে চলেছে। প্রতিপক্ষ ও বিরোধীদের সঙ্গে সম্মানজনক ও ন্যায়সঙ্গত আচরণের মাধ্যমে সংলাপ ও সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করা দূরে থাকুন; প্রতিদিনই তাদেরকে কোণঠাসা ও বিক্ষুব্ধ করা হচ্ছে। এমন অপতৎপরতায় পরিবেশ ক্রমেই অবনতির দিকে চলে যাচ্ছে।
ধারণা করতে কষ্ট হয় না, সংলাপ ও সমঝোতার প্রশ্নে যারা উদ্যোগী হবেন, তারা নিজেরাই অবুঝ-গোয়ার্তুমিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। যেন সংলাপ বা সমঝোতা করলে বিরাট পরাজয় হয়ে যাবে, নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে, এমনই হাব-ভাব ক্ষমতাসীনদের। চাটুকার, চেলা ও বশংবদদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন অতিবামগণ মিথ্যা আস্ফালন করে চিৎকার করছে, ‘এদের সঙ্গে আপস নয়’। এই ‘এরা’ কারা? আকাশ থেকে আসা বাইরের কেউ নয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামপ্রিয় মানুষ। এদেরকে অবজ্ঞা করা, দূরে ঠেলে দেয়া মোটেও ঠিক নয়। এমন বিদ্বেষ ছড়িয়ে বন্ধুবেশে যারা সরকার ও জনগণের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, উত্তেজনা ও দূরত্ব বাড়াচ্ছে, তাদের মতলব ভালো নয়। কুচক্রীদের কথা শুনলে সরকারই বেশি বিপদে পড়বে; জনবিচ্ছিন্ন হবে। তখন এহেন ষড়যন্ত্রপ্রিয় ফতুর বামরা সরকারকে জনরোষ ও জনবিচ্ছিন্নতার কবল থেকে বাঁচাতে পারবে না। যারা নিজেদেরকেই বাঁচাতে পারে না, তারা অন্যকে বাঁচাবে কি করে! উলেখ্য, অতি কট্টরপন্থী বগার, সেক্যুলার ও বামদের সমন্বয়ে যে শাহবাগ নাটক, সেটা প্রথমবারের মতো পুলিশী পাহারা থেকে বেরিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে চেয়েছিল। গন্তব্য ঠিক করেছিল বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি, তৌহিদী জনতার চট্টগ্রাম। দুষ্টচক্রের আগমনের চট্টগ্রামবাসী যখন হুঙ্কার দিল, তখন তারা কর্মসূচি বাতিল করে পালিয়ে বেঁচেছে। অতএব এইসব ভাড়া-করা মালের ওপর ভরসা করে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামই যেখানে যাওয়া সম্ভব নয়, সেখানে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ বানানোর স্বপ্ন দূর অস্ত। বরং বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে প্রয়োজন ইসলামী দল, নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সমঝোতা ও সদাচারণ। দুঃখের ব্যাপার, এই কাজে সরকার এখনও এগিয়ে আসছে না।
ইতিহাসে দেখা গেছে, যুদ্ধের ময়দানে চরম শত্রচর সঙ্গেও আলোচনা হয়। আর এখন জনগণের একটি বৃহৎ অংশের সঙ্গে আলোচনা হতে বাধা কোথায়? আলোচনায় লাভ, নাকি সংঘাতে লাভ, সেটা বোঝার মতো একটিও চিন্তাশীল মাথা কি ক্ষমতার বৃত্তে নেই? সবাই বুঝতে পারছে, পরিস্থিতি ক্রমেই আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। আলোচনা ও সমঝোতার দরজাও হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বুঝতে পারছে না তারাই, যারা আবেগ ও উত্তেজনাকে পুঁজি করে ঘোলাজলে ফায়দা লুটতে চায়। নিজেদের ক্ষুদ্র লাভের জন্য সরকারকেও বিব্রতকর বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না সরকারের আশেপাশে ঘাপটি মেরে থাকা এই সুযোগ সন্ধানী কুচক্রী উপদলটি। অতএব, সাধু সাবধান।
এহেন সুযোগ সন্ধানীরা চারিদিকে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। সরকারকেও সর্বদা কল্পিত শত্রচর ভয় দেখাচ্ছে। কোনও পরামর্শ বা গঠনমূলক সমালোচনা করা হলেই সেটাকে ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ বলে প্রচার করছে। গণতন্ত্র বিরোধী এই সাবেক বামেদের উপদল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা সারা জীবন সমাজতান্ত্রিক একদলীয় শাসনের অধীনে স্বৈরতন্ত্রের তালিম পেয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো গণতান্ত্রিক অতীতসম্পন্ন দলে এদের প্রাধান্য আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে অতি সংগোপনে কলুষিত করছে। আজকের আওয়ামী লীগকে অনেক প্রবীণ আওয়ামী লীগাররাই চিনতে পারছেন না। আওয়ামী লীগের মূলধারার নেতৃত্ব ও মৌলিক গণতান্ত্রিক মতাদর্শ বর্তমানে এই কুচক্রী স্বার্থগোষ্ঠীর হাতে জিম্মি।
আমাদের এখনও বিশ্বাস করতে এবং আস্থা রাখতে ইচ্ছে করে যে, আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্য ও অতীত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনৈতিক দল শেষ পর্যন্ত সঙ্কট দূরীকরণের একটি সর্বজনগ্রাহ্য গণতান্ত্রিক, আইনানুগ পন্থা খুঁজে পাবে। দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কুচক্রী মহল আওয়ামী লীগের কাঁধে বন্দুক রেখে ইসলামপ্রিয় মানুষ, দল ও নেতৃত্বকে খতম করতে পারবে না। আর যাই হোক, আওয়ামী লীগ জনগণের দল হিসাবে জনগণের প্রধান অংশের বিরচদ্ধে যাবে না। মাঝে মাঝে আওয়ামী লীগের বিবেচক কোনও কোনও নেতা সমঝোতা ও আলোচনা-সংলাপের ইঙ্গিতও দিয়ে থাকেন। কিন্তু কোনও এক রহস্যজনক কারণে সরকার সমঝোতা ও শান্তির পথে এগুতে পারছে না। অকারণে নির্যাতন চালিয়ে সরকারের ভেতরের একটি অংশ উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি থেকে যাচ্ছে কুচক্রীদের নিয়ন্ত্রণে।
আওয়ামী লীগ সমঝোতার দল। শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনা চালিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের পথ সন্ধান করেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টোর কারণে সমঝোতা ভেস্তে যায়। আবার স্বাধীনতার পরেও আওয়ামী লীগ সমঝোতার পথেই গেছে। পাকিস্তানে আটক লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে কৃতিত্বের সঙ্গে ফিরিয়ে এনেছে। যুদ্ধের পরে রক্তপাত বন্ধ করতে পেরেছে। পাকিস্তানের প্রায় এক লক্ষ সৈন্য এবং সেই সৈন্যদলের ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে আওয়ামী লীগের গৃহীত সিদ্ধান্ত আজ ইতিহাসের অংশ। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সে সমস্যার রক্তপাতহীন শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করেছিল। আর আজকে মূল আসামীদের রেহাই হয়ে যাওয়ার চলিশ বছর পর নতুন সঙ্কট, রক্তপাত, প্রতিহিংসার হোতা কারা? কি তাদের উদ্দেশ্য? এ নিয়ে গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশ কোনও দলের অধীনে শান্তিপূর্ণভাবে চললে জিডিপি বেড়ে যায়। উন্নয়নে গতি আসে। অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু যখন কেউ শান্তিতে চলতে পারে না, তখন অবস্থা সুখকর হয় না। অতীতে বিএনপি সরকারের শেষ বছর বা বর্তমানে আওয়ামী লীগের শেষ বছর অগ্নিগর্ভ হয়ে গেছে। শান্তিতে চললে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতো। দেশকে যারা চালাচ্ছেন, তারা এই কথাটি ভাবুন। এবং মানবিক নিরাপত্তার চরম বিপর্যয় থেকে মানুষ ও সমাজকে রেহাই দিন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন