বাংলা ভাষার কিছু শব্দ নিয়ে মিডিয়া এক সাম্প্রদায়িক কাণ্ড ঘটিয়েছে। ‘তারুণ্য’, ‘প্রজন্ম’, ‘তাণ্ডব’, ‘সহিংসতা’Ñ এ শব্দগুলোর ওপর প্রবল অন্যায় অত্যাচার চালিয়েছে। মাপমতো খাপ খাওয়ানোর জন্য সাত ফুটের পালোয়ানকে জোর করে তিন ফুট শরীরের জন্য তৈরি করা পোশাকের ভেতর ঢুকানো হয়েছে। অন্য দিকে তিন ফুটের বামনকে দেয়া হয়েছে সাত ফুট লম্বা শরীরের জন্য তৈরি বেমানান জুব্বা। ‘তারুণ্য’ আর ‘প্রজন্মের’ অর্থকে ভীষণ সঙ্কুচিত করা হয়েছে। শাহবাগে মোমের আলোয় যারা ‘মহিমান্বিত’ হয়েছে, কিংবা যারা স্লোগান দিয়েছে, ‘জবাই করো’, ‘ফাঁসি চাই’ এসব শব্দযুগল তাদের পদভূষণ। প্রজন্মকে জোর করে ব্র্যাকেটবন্দী করা হয়েছে শাহবাগীদের জন্য। এ প্রজন্ম ও তারুণ্যের অহঙ্কার কেবল পুলিশের নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে প্রকাশ হতে পারে!
অন্য দিকে যারা ভাত-কাপড়ের দাবি জানাবে, বিচার চাইবে, চাকরি চাইতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাবে তারা যতই তরুণ হোক ‘তারুণ্য’, বা ‘প্রজন্ম’ হতে পারবে না! সরকারের অন্যায় আচরণ যতই পৈশাচিক হোক তার প্রতিবাদ করা ‘তাণ্ডব’! সেটা যদি পুলিশের সামনে বুক পেতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা হয় তাহলেও। হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভে পুলিশের সরাসরি গুলিতে ডজন ডজন মানুষ প্রাণ হারালেও সেটা ‘সহিংসতা’! অদ্ভুত বাংলাদেশের মিডিয়ার আচরণ। তারা লাখ লাখ মানুষের বিক্ষোভকে ‘তাণ্ডব’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। বন্দর বিদ্যুৎ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাথে এদের তফাৎÑ এরা সংখ্যায় অনেক বেশি। যারা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য রাজপথে নেমে পুলিশের লাঠিপেটা, টিয়ার শেলের মুখোমুখি হয়। যত ুদ্র মিছিলই হোক না কেন, মিডিয়া এ বিক্ষোভকে মহিমান্বিত করলে দেশের মানুষ তাদের সাথে একাত্ম হয়। গ্রুপটি ছোট হলেও তাদের দাবিটি বড়। একই ধরনের নির্দোষ বিক্ষোভে পুলিশ যখন সরাসরি গুলি করে ডজন ডজন মানুষ হত্যা করছে সেটি কেবলই তাণ্ডব! কেবলই সহিসংতা! এক নির্দয় সাংবাদিকতার উদাহরণ সৃষ্টি হলো বাংলাদেশে।
শাহবাগ নিয়ে অন্ধ
‘বিচার কর’, ‘ফাঁসি চাই’, ‘হামলা কর’, ‘উৎখাত কর’ এসব নিম্নœরুচির সাম্প্রদায়িক স্লেøাগান তুলে নিজেদের নৈতিকভাবে নিঃশেষ করে দিয়েছে শাহবাগের জমায়েত। শাহবাগ হুজুগ নিয়ে মিডিয়ার যে ভূমিকা তা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। অনেক মিডিয়া গায়ের জোরে বিষয়টি উপলব্ধি করতে না চাইলেও লুকোচুরি খেলার মাধ্যমে পাঠক ও দর্শক-শ্রোতার কাছে নিজেরাই আবার জনগণের সামনে বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। ব্লগারদের নিকৃষ্ট কর্মকাণ্ড বিকল্প মাধ্যমে মানুষ জেনে গেছে। মিডিয়া ওই সব অপকর্ম প্রকাশ না করে জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। উল্টো এরা চেষ্টা করেছে ধামাচাপা দেয়ার জন্য। এর পাশাপাশি এরা চালিয়েছে পাল্টা প্রচারণা।
রাজীবসহ আরো কয়েকজন ব্লগারের ঘৃণা উদ্রেককারী কর্মকাণ্ড এখন সুদূর অতীত। শাহবাগ মঞ্চের আহ্বায়ক ডা: ইমরান এইচ সরকারের যে পরিচিতি বেরিয়ে এসেছে, অন্যতম আয়োজক বাপ্পাদিত্য বসুর অন্ধকার জীবনের যে ফিরিস্তি তাও মানুষ জেনে গেছে। মিডিয়া শুধু এসব আড়াল করছে না এখনো ব্যস্ত রয়েছে শাহবাগকে মহিমান্বিত করার কাজে। তাদের জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে উপস্থিতির হার। এখন কেউ আর চত্বরের জনসমাগমের লংশর্ট নিচ্ছে না। সবাই নিচ্ছে কোজশর্ট। কোনো কোনো টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে প্রথম দিকের পুরনো ছবি। পত্রিকা ছবি তুলছে মিছিল বা সমাবেশের সামনের অংশ থেকে। যেখানে ঘন হয়ে রয়েছে সবাই। টেলিভিশন এখন আর ফোকাস করছে না পুরো সমাবেশের ওপর। অন্য দিকে ছিটেফোঁটা ক’টি পত্রিকা যারা নিম্নরুচির কর্মকাণ্ডকে প্রকাশ করে দিয়েছ তাদের তোলা ছবিতে ‘গণজাগরণের’ আকার যে হতাশাব্যঞ্জক ছোট তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গার্মেন্ট কর্মীদের হাজির করার নির্দেশ দিয়ে ইমরান বিষয়টি আরো খোলাসা করে দিয়েছে।
মিডিয়া খবর দিচ্ছে, এক তরুণ ২২ দিন ধরে চত্বরে অবস্থান করছে। তার বাড়ি না ফেরাকে তুলনা করা হচ্ছে মক্তিযুদ্ধের সময় তরুণদের যুদ্ধে অংশ নেয়ার সাথে। মুক্তিযুদ্ধের সেই তরুণেরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে দেশ স্বাধীন করার জন্য বের হয়েছিল। সেখানে পুলিশ ছিল না নিরাপত্তার জন্য। উল্টো যেকোনো সময় পাক হানাদারদের আক্রমণে প্রাণ হারানোর ভয় ছিল। মিডিয়া বলছে, ভোলার এ তরুণ মা-বাবার নিষেধ শুনছে না। অভিভাবকের এ আদেশ না মানার মধ্যে মিডিয়া এই তরুণের মধ্যে মহান আদর্শবাদিতা দেখছে। একইভাবে মিডিয়া প্রশ্ন তুলছে না সদ্য প্রত্যন্ত দ্বীপজেলা ভোলা থেকে আসা সহায় সম্বলহীন তরুণ থাকছে কোথায়, খাচ্ছে কী, টাকা পাচ্ছে কোথা থেকে এসব নিয়ে। শাহবাগ নেতাদের কেলেঙ্কারি কিভাবে মিডিয়া ধামাচাপা দিচ্ছ তা নিচে দেখুন।
ইমরানের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়লে তাও গোপন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সর্ষের মধ্যে পাওয়া গেল ভূত। শাহবাগ বাংলাদেশকে রাজাকারমুক্ত করতে চায়। কিন্তু একটি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, এ মঞ্চের প্রধান ব্যক্তির পরিচয়টি সরাসরি রাজাকারের সাথে জড়িয়ে আছে। পত্রিকাটি জানিয়েছে, তার দাদা একজন তৎপর রাজাকার ছিলেন। এ অপরাধে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হত্যা করেছে। ইমরানের পিতা পরিচয় গোপন করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এ খবর এখন শাহবাগপন্থী মিডিয়া দিচ্ছে না। বরং তাদের রয়েছে ভিন্ন এজেন্ডা। ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি আন্দোলনের আড়ালে নানা অর্থনৈতিক সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন। কেউ এ ব্যাপারে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে এগিয়ে এলো না। মিডিয়া কি একটি মহান লক্ষ্য অর্জনের জন্য নেতা হিসেবে একজন দুর্নীতিবাজকে বেছে নিতে চায়? সেই প্রশ্নটি পাঠক-দর্শক মিডিয়াকে করতেই পারে।
শাহবাগ মঞ্চ মানবতাবিরোধী অপরাধ সমূলে উৎপাটন করতে চায়। মঞ্চের অন্যতম সংগঠক বাপ্পাদিত্য বসুর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। লাগি-বৈঠার আন্দোলনের সময় একটি লাশের ওপর নৃত্য করছেন বাপ্পাদিত্য, এমন ছবি প্রকাশ হয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত নানা সংগঠনের সাথে মিলে তিনি বেআইনি তৎপরতা চালান। বাপ্পার বিরুদ্ধে এ ধরনের ঘটনার বিবরণ যখন জানা গেল, কেউ এসব নিয়ে খুঁটিনাটি জানানোর জন্য এগিয়ে এলো না। মিডিয়া ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ নির্মূল আন্দোলনের অংশ হয়ে গেছে অনেক আগে থেকে। মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, এমন একজনকে নেতা হিসেবে রেখে সে অন্দোলন কিভাবে চালাবেন।
মঞ্চের আরেক নেতা জাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি হুসেইন আহমেদ তাফসির। তার বাবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাওলানা হাফেজ উবায়দুল্লাহ ছেলের কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত ুব্ধ। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘তাফসির নাস্তিকদের সাথে হাত মিলিয়েছে। আমার ছেলে হয়ে সে শাহবাগে ইসলামবিরোধীদের সাথে আন্দোলন করছে এ কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়। অনতিবিলম্বে সে যদি এসব নাস্তিকের পিছু না ছাড়ে, তাহলে আমার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেবো।’ অভিভাবকের অবাধ্যতা করে শাহবাগে দিনরাত অবস্থান নিলে মিডিয়া সেটি প্রকাশ করছে একটি উৎসাহজনক কাজ হিসেবে। অন্য দিকে অভিভাবক যখন বখে যাওয়া সন্তানকে নিয়ে ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন, সেটা আর এরা প্রকাশ করছে না।
টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ভারতের মদদে শাহবাগ। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন এবং দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদ শাহবাগকে প্রণোদনা দিয়েছেন। ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর শেষে দেশে ফেরার সময় সে দেশের গণমাধ্যমকে বিমান থেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি শাহবাগের বিজয় দেখতে চান। মিডিয়া এসব বিষয়ে কোনো ধরনের খবর দিতে রাজি নয়।
দ্বিচারিতা
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায়ের পর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। জনগণের অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে। তারা বলতে চাইছেন রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য সরকার অন্যায়ভাবে এই ধর্ম প্রচারককে শেষ করে দিতে চায়। জনধারণাও অনেকটা তাই। তাই তার ফাঁসির আদেশে ফুসে ওঠে ুব্ধ জনতা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের এ ক্ষোভকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। মানুষকে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ করে দিতে হবে। বিক্ষোভকারীরা যদি আইন ভঙ্গ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যায়। আমরা দেখলাম পুলিশের গুলিতে এক দিনে ৭০ জন মানুষ প্রাণ হারালো। ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক বিক্ষোভে এক দিনে পুলিশের গুলিতে এত মানুষ হত্যার নজির নেই। মিডিয়া এটিকে চিহ্নিত করল সহিংসতা হিসেবে। কার বিরদ্ধে কে সহিংস হলো? সে প্রশ্নের উত্তর প্রতিবেদনে নেই। হাজার হাজার মানুষ একজোটে হয়ে কাউকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালাচ্ছে এমন ছবি কেউ দিতে পারেনি। কারো হাতে রামদা, কিরিচ বা খুন করার মতো অন্য কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি। আরো বেমানান হলো মিডিয়া যখন খুন হওয়া মানুষদের পরিচয় দিতে চাচ্ছিল না; কিংবা তারা যখন গোপন রাখতে চাইল বুলেটে ক্ষতবিক্ষত মানুষের রাজনৈতিক সামাজিক পরিচয়। আরো রহস্যময় মনে হলো যখন তারা বলতে চাইছিল না কারা হত্যাকারী?
কারা হত্যা করেছে, কে হত্যার শিকার হলোÑ এ প্রশ্ন পাঠকের কাছে উহ্য রেখে জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার খবর ও ছবি ছাপতে শুরু করে মিডিয়া। পাঠকদের এতটা অপদার্থ ভাবা সঙ্গত হতে পারে না। মানুষের বিক্ষোভ সরকারের বিরুদ্ধে; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। বিক্ষোভকারীরা এতটা অবুঝ শিশু নয়, জাতীয় প্রতীকে হামলা চালিয়ে বা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে সরকারকে নতুন কোনো সুযোগ করে দেবে। বরং এ ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কাজ ক্ষমতাসীনেরা করছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা এ কাজ করতে গিয়ে হাতেনাতে জনগণের হাতে ধরাও পড়েছে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়, মানুষের বিক্ষোভকে দমনের অছিলা হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য ক্ষমতাসীনেরা কৌশলে এ অন্যায় কাজটি করে তা বিক্ষুব্ধ মানুষের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
বগুড়ার শেরপুরে যুবলীগ নেতা তবিবর রহমানের নেতৃত্বে স্থানীয় একটি মাদরাসায় স্থাপিত শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার বেলা ৩টার দিকে শহর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক তবিবর রহমান টিপুসহ তিন যুবক শেরপুর শহীদিয়া কামিল স্নাতকোত্তর মাদরাসা প্রাঙ্গণে ঘটনাটি ঘটায়। শহীদ মিনারের বেদিতে স্থাপিত চারটি ছোট আকারের স্টিলের খুঁটিতে একটি লাল কাপড় লাগিয়ে জোরে টানাটানি করে ভেঙে ফেলার চেষ্টা চালায়। টানাটানির একপর্যায়ে স্টিলের খুঁটির মাথায় লাগানো একটি ক্যাপ খুলে যায়। উপস্থিত জনতা ঘটনাস্থল থেকে ওই যুবলীগ নেতাকে আটক করতে পারলেও তার দুই সহযোগী পালিয়ে যায়। আটক যুবলীগ নেতাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ছেড়ে দেয়ার নাটক সাজানো হয়। এ খবরটি বেশির ভাগ মিডিয়া এড়িয়ে গেল। একইভাবে এরা এড়িয়ে গেল সাতক্ষীরার একটি আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণে একজন দলীয় নেতার হত্যার ঘটনা। এটিকে কোনো কোনো মিডিয়া আওয়ামী লীগের ওপর বোমা হামলা বলে চালিয়ে দিতে চাইল।
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কোনো ঘটনা ঘটলেই জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র হামলা বলে মিডিয়া নিজেই মন্তব্য করে বসছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করছে না। প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকে উদ্ধৃতি করে জামায়াত-শিবিরের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। কখনো বা তারা সাধারণ মানুষের নামে কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকে উদ্ধৃত করছে। অন্য দিকে জামায়াত-শিবির যখন সংখ্যালঘুদের সহায় সম্পত্তিতে হামলার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে বিবৃতি দিচ্ছে সে খবর তারা গায়েব করে দিচ্ছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যখন শাহবাগের অঙ্গুলি হেলনে ব্যাংক বীমা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলা করেছে তখন এরা হয়ে যাচ্ছে ‘জনতা’। অন্য দিকে সাধারণ মানুষ যখন সরকারের নানা অপকর্মের প্রতিবাদ জানাচ্ছে সে জনগণ হয়ে যাচ্ছে ‘জামায়াত-শিবির’। আর তাদের বিক্ষোভ হয়ে যাচ্ছে ‘তাণ্ডব’।
বিক্ষোভ কিভাবে তাণ্ডব হলো
ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ না হলেও মহাজোট সরকার এ দলটির প্রতি একটি নিষিদ্ধ দলের মতো আচরণ করছে বিগত চার বছর ধরে। তাদের অফিসে আক্রমণ করে নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে গেছে পাইকারিহারে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের অফিস সিলগালা করে দিয়েছে। ধর্মীয় বইপুস্তক যার হাতে পেয়েছে ‘জিহাদি’ বই রাখার অপরাধে তাকেই গ্রেফতার করেছে। অথচ এসব বই সরকার নিষিদ্ধ করেনি। দলটির সাথে সম্পর্ক রয়েছে এমন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে বন্ধ করে দিয়েছে তারা। এসব করার সময় মানুষের রুটি-রুজি তথা অর্থনৈতিক দিকটি বিবেচনায় নিতে চায়নি সরকার। বাংলাদেশের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম এ খবর এড়িয়ে গেছে অন্যায়ভাবে। বা কখনো পুলিশের সাথে ‘জিহাদি’ ও ‘নাশকতার’ তত্ত্বে সুর মিলিয়েছে।
সরকারি এসব বেআইনি পদক্ষেপের প্রতিবাদে সমাবেশ করতে চাইলে দলটিকে অনুমতি দেয়া হয়নি। সংবাদমাধ্যম তখন চুপ রইল। এরা যখন বিুব্ধ হয়ে রাস্তায় মিছিল বের করার চেষ্টা করেছে, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে তা পণ্ড করেছে পুলিশ। যাকে যেখানে পেয়েছে নির্যাতন চালিয়েছে, গ্রেফতার করে বাণিজ্য (ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে উৎকোচ গ্রহণ) করেছে। আশকারা পেয়ে পুলিশ আরো বেপরোয়া হয়ে সরাসরি গুলি চালাল। শরীরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করল। মিছিলে আক্রমণ করা হলো; তাজা বুলেট ছোড়া হলো; মিডিয়া সেসব গায়েব করে দিলো। মিডিয়ায় খবরের মর্যাদা পেল যখন জামায়াত-শিবির ঢিল ছুড়তে শুরু করল। কখনো বা ক্ষোভের আতিশয্যে পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো, বা পাবলিক যানবাহনে আক্রমণ করা হলো। ঘটনার পেছনের দিকটি সম্পর্কে পাঠককে অন্ধকারে রেখে প্রতিক্রিয়াকে বাড়িয়ে দেখাল মিডিয়া। এটি তখন মিডিয়ার ভাষায় ‘তাণ্ডব’।
সরকার স্পষ্টত চেয়েছে জামায়াত-শিবিরকে সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকারবঞ্চিত করে ‘জঙ্গিপনার’ দিকে ঠেলে দিতে। এ প্রক্রিয়ায় মিডিয়া সরকারের অন্যায় আচরণ প্রকাশ না করে সরাসরি সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দলটি এখনো ছাত্রলীগের মতো রামদা-কিরিচ হাতে নিয়েছে মিডিয়া তা দেখাতে পারেনি। সরকারের সাথে মিডিয়ার প্যারালাল অবস্থান দলটিকে সেপথে ঠেলে দেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করছে।
ডিজিটাল সাংবাদিকতা
মিডিয়ায় প্রায় প্রতিদিন শিবিরের নাশকতার অগ্রিম খবর দিচ্ছে। ফাঁস করে দিচ্ছে জামায়াত-শিবিরের ল্যাপটপ পাম্পটপ ষড়যন্ত্রের খবর। এর বিপরীতে মানুষ দেখছে রামদা-কিরিচসহ মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগের মহড়া। প্রকাশ্যে তারা কুপিয়ে হত্যা করছে গরিব দর্জি বিশ্বজিৎসহ আরো অনেককে। তাহলে মিডিয়ার ওপর পাঠক-দর্শক-শ্র্রোতার আস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকবে।
সারা দেশে ঘৃণা ছড়িয়েছে ‘উৎখাত কর’, ‘হত্যা কর’, ‘ফাঁসি চাই’Ñ এ ধরনের বর্বর স্লেøাগান। টেলিভিশন টানা লাইভ দেখিয়েছে ঘৃণা ছড়ানো এসব কার্যক্রম। ৯৫ শতাংশ পত্রিকা দুই সপ্তাহ ধরে ব্যানার হেডলাইন করেছে। কোনো খবর নেই, তো বিশাল করে একটি ছবি তারা ছাপিয়ে গেছে। মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানোর ছবি দিয়েছে প্রথম পাতায় পোস্টার করে। ইতিহাসের এ ধরনের উগ্র প্রচারণা কখনো দেখা যায়নি। সারা দেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যাকে এ ঘৃণা ছড়ানো কার্যক্রম থেকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। গণহত্যা সংঘটনের জন্য ভবিষ্যতে কেউ যদি মিডিয়াকে অভিযুক্ত করে তার দায় কে নেবে।
সম্প্রতি একটি হরতালে পত্রিকা খবর না দিয়ে মন্তব্য করে বসল ‘জনগণ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে’। এটি তো রাজনৈতিক বক্তব্য। জামায়াত হরতাল করলে আওয়মী লীগ বলবে। আওয়ামী লীগ হরতাল করলে বিএনপি বলবে। মিডিয়া যখন ‘জনগণ হরতাল প্রত্যাখ্যান করছে’ এ কথা বলছে তখন তো রাজনৈতিক দলের আর প্রয়োজন থাকে না। রাজনৈতিক দলগুলো সব দায়দায়িত্ব মিডিয়ার কাছে দিয়ে অবসর দিনযাপন করতে পারে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন