জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র হলেও কদাচিৎ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে স্থান পায় দেশটি। এখন শুধু বিশ্ব মিডিয়াতেই বাংলাদেশ স্থান লাভ করেনি, একই সাথে বিশ্ব নেতৃবৃন্দও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন থেকে শুরু করে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) মহাসচিব একমেলুদ্দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্ঘাত ও সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সরকার ও বিরোধী পক্ষের বিরোধ মেটাতে কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া হলে জীবন ক্ষয় ও রক্তপাত গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে চলে যেতে পারে বলেও নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ তাদের শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি কোন দিকে এগোচ্ছে, এ নিয়ে বিশ্লেষণ প্রকাশ হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে। বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ইকোনমিস্ট বলেছে, বাংলাদেশ স্পষ্টত এক বিভাজনের মধ্যে এসে পড়েছে। এ বিভাজন দেখা দিয়েছে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী বিচারের বিতর্কিত উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে ঘিরে। ভারতের গণমাধ্যমেও বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দেয়া হচ্ছে মিশ্র বক্তব্য। একটি পক্ষ বলছে, বাংলাদেশে এখন যে বিভক্তি-বিভাজন তা ১৯৭১ সালের পরিস্থিতির সাথে তুল্য। ১৯৭১ সালে যেমন বাংলাদেশের পাশে সব কিছু নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, একইভাবে নয়াদিল্লির দাঁড়ানো উচিত শেখ হাসিনা সরকারের পেছনে। ইসরাইলের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক জেরুসালেম পোস্টে বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত এক বিরাট প্রতিবেদনেও একই কথা বলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে জগদিশ এস নাথ লিখেছেন, ‘ভারতের নাগরিকদের বাংলাদেশের ইসলামিস্টরা যাতে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সুযোগ নিতে না পারে তার জন্য সম্ভব সব ধরনের উপায় ব্যবহার করতে হবে। ভারত ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে মুক্তির মহান লক্ষ্য অর্জন করার জন্য বাংলাদেশের জনগণের সাথে যোগ দিয়েছিল। ভারতের জনগণকে প্রয়োজন হলে এই ভূমিকা আবার নিতে হবে।’
ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও গণমাধ্যমগুলোর বাংলাদেশ নিয়ে সব বক্তব্য একই ধারায় হচ্ছে না। সে দেশের সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত বেসরকারি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সাউথ এশিয়া অ্যানালাইসিস গ্রুপের সাম্প্রতিক দু’টি প্রতিবেদনে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে আরেক দফা ক্ষমতায় নিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রবন্ধে কাউন্টার টেরোরিজম উইংয়ের সাবেক পরিচালক বি রমন বলেছেন, বাংলাদেশে উদারনৈতিক ও সেকুলার ধারাকে জাতীয়তাবাদী বিএনপি ও ইসলামিক ধারার বিপরীতে সহযোগিতা দেয়া উচিত। শাহবাগের কথিত জাগরণকে উদারনৈতিক ও সেকুলার ধারার প্রতিভূ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। বি রমন বলেছেন, ‘উদারপন্থীরা সৌভাগ্যবশত নাটকীয়ভাবে অগ্রসর হয়ে এসেছে। কিন্তু তারা চূড়ান্ত সাফল্য পাবে এমন বিষয়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের সমাজে ইসলামি চরমপন্থীরা এখনো যথেষ্ট শক্তি নিয়ে আছে। উদারপন্থীদের অতি বেশি আস্থা ইসলামি চরমপন্থীদের হাতে তাদের বিপর্যয়ের কারণ হবে। ইসলামিস্টরা আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু পরাভূত হয়নি।’ বি রমন শুধু বাংলাদেশে ইসলামিস্টদের চূড়ান্তভাবে পরাভূত করতে ভারতীয় হস্তক্ষেপের সুপারিশই করেননি, একই সাথে ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাসিদের সমর্থনে মালদ্বীপ উপকূলে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ পাঠানোর জন্যও বলেছেন।
সাউথ এশিয়া অ্যানালাইসিস গ্রুপের আরেক লেখক ড. সুবাস কাপিলা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয় ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনার সক্ষম এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে ইসলামিক পরিচিতি ও মৌলবাদ থেকে একটি আমূল উদারনৈতিক-সেকুলার রূপান্তরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে পারস্পরিক স্বার্থে তার সাথে কার্যকর ও ফলপ্রসূ সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত ভারতের।’
এর বিপরীতে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির একপক্ষীয় নীতির সমালোচনাও হয়েছে দেশটির কোনো কোনো গণমাধ্যমে। টাইমস অব ইন্ডিয়া ও আনন্দবাজারের মতো পত্রিকা প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি যে সময় বাংলাদেশে সফরে এসেছেন সেটির যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধে শাহবাগ চত্বরে যখন তারুণ্যের জাগরণ মঞ্চ আলোড়ন তুলেছে তখন এর বিপরীতে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত এক জামায়াত নেতার ফাঁসির দণ্ডকে কেন্দ্র করে বিপুল প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে, যেটাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় প্রেসিডেন্টের সফরের প্রায় পুরোটা সময় গেছে বিরোধী পক্ষের হরতালের মধ্য দিয়ে। যার ফলে নিরাপত্তার কথা বলে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া প্রণব মুখার্জির সাথে তার সাক্ষাৎকার বাতিল করেছেন। বিরোধীদলীয় নেতার এ সাক্ষাৎকার বাতিলে প্রণবের সফর যে কতটা বর্ণহীন হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতীয় পত্রপত্রিকার মন্তব্যে। আনন্দবাজারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খবরটি শোনার পর ভারতীয় প্রেসিডেন্ট কোনো কথা বলেননি, তবে তার মুখের হাসি আকস্মিকভাবে বিদায় নেয়। ভারতীয় প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরসঙ্গী হয়েছিলেন ভারতের খ্যাতিমান উপদেষ্টা সম্পাদক, লেখক, কলামিস্ট ও রেডিও-টিভি ব্যক্তিত্ব এস এন এম আবদি। তিনি জাম্বো জেটে শাহজালাল অন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর তাদের অনুভূতিটা জানাচ্ছিলেন এভাবেÑ ‘জাম্বো জেটে করে ‘বিগ ব্রাদার’ যখন বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন তখন টারমাকে অবস্থানকারী ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। এ বিষয়ে ফার্স্ট সেক্রেটারি স্পষ্টতই বললেন, যা-ই বলুন বিমানটির আকার কিন্তু একটি ব্যাপার। স্বাগতিকদের কাছে এর মতা সম্পর্কে একটি সঠিক বার্তা পৌঁছে দেয়া গেছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি তখন এতটাই ভীতিবিহ্বল যে, ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাতে যখন তোপধ্বনি করা হয় তখন তার সফরসঙ্গীদের অনেকেই আতঙ্কিত হয়েছিলেন পুলিশ গুলি করছে কি না।’
ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে আউটলুক ইন্ডিয়ার অনলাইন সংস্করণে ‘বাংলাদেশ : জামায়াতে ইসলামী : দ্য মনস্টার ব্রিথস এয়ার’ শীর্ষক লেখায় এস এন এম আবদি বাংলাদেশের রাজনীতি বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ‘এখন জামায়াতের সাথে দৌত্যে যাওয়ার উপযুক্ত সময় ভারতের। তাদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ এখন সুস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের কেবল গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপে শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য পরামর্শ দিয়েছিল ভারত। কিন্তু তাতে কান দেয়নি তারা। ওয়াশিংটন এখন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতের বিচারে অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বলেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ঠিকই দেখতে পাচ্ছে খালেদা জিয়াকে মতায় বসানোর পরিকল্পনায় জামায়াতই মূল খেলোয়াড়, যদিও শেখ হাসিনাকে আরেক দফা মতায় বসানো নিশ্চিত করার কৌশল চূড়ান্ত করেছে ভারত।’ আবদির শেষ মন্তব্যটা বেশ গুরুত্বপূর্র্ণ। তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন, শেখ হাসিনাকে আরেক দফা মতায় বসানো নিশ্চিত করার কৌশল চূড়ান্ত করে ফেললে বিরোধী দলের ভূমিকা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্পূরক কেন হতে যাবে?
জামায়াতকে ভারতের অনেক মিডিয়া যেখানে দেশটির চিরশত্রু সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করছে সেখানে ব্যক্তিজীবনে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত অভিনেত্রী শ্রিলা মজুমদারের স্বামী এস এন এম আবদি লিখেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো তারা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কোনো হিন্দুকে হত্যা করে না। সততার সাথে বলতে হয়, ভারতে হিন্দুত্ববাদী কিছু সংগঠনের হাতে যেভাবে মুসলমানেরা নিয়মিত টার্গেটে পরিণত হচ্ছে সেখানে জামায়াত নিষ্ক্রিয়ই। এ দলটি সম্পর্কে এটিই সরল সোজা সত্য কথা। অবশ্যই ভারত ও পশ্চিমা মিডিয়া এসব বিষয়ে রিপোর্ট ছাপছে না। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা, যুদ্ধাপরাধ আদালতের বিচার, শাহবাগ স্কয়ারের আন্দোলন এবং জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৃশংসতার অভিযোগে ফাঁসির আদেশÑ এসব কিছুতেই ভারতীয় ও পশ্চিমা মিডিয়া জামায়াতকে বেপরোয়া দৈত্যের সাথে তুলনা করছে। বাংলাদেশের সর্বশেষ এ রাজনৈতিক উন্মাতাল পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে কমপে ৮৪ জন নিহত হয়েছেন। এর বেশির ভাগই জামায়াতের সমর্থক। তাদের হত্যা করেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।’
গত এক বছরে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এক ধরনের বিভক্তির বিষয় স্পষ্ট হয় দেশটির গণমাধ্যম ও নীতিনির্দেশকদের লেখা ও মন্তব্যে। বাংলাদেশ যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এক বিরাট গুরুত্ব বহন করে, এ ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য নেই, যদিও এ নিয়ে পূর্বাঞ্চলের আমলা ও রাজনীতিবিদদের মতো অত বেশি গুরুত্ব দিতে চান না দক্ষিণ ও উত্তর-ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও আমলারা। দক্ষিণ-উত্তর ভারতের নীতিনির্ধারকেরা বেশ খানিকটা নিরাসক্তভাবে দেখতে চান দু’দেশের সম্পর্ককে। তারা মনে করেন, বাংলাদেশে ভারতের যে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত স্বার্থ রয়েছে সেটিকে সামনে রেখে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক পক্ষের পরিবর্তে সব রাজনৈতিক দল ও সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে। এ দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসেবে বর্তমান মহাজোট আমলে উল্লেখযোগ্য সময়জুড়ে এ দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাথে সম্পর্ক না রাখার যে কৌশল তা থেকে একপর্যায়ে সরে আসে নয়াদিল্লি। ভাইস প্রেসিডেন্ট হামিদ আনসারি ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিরোধীদলীয় নেতার সাথেও সাক্ষাৎ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব মুখার্জিও দেখা করেন বিরোধীদলীয় নেতার সাথে। এরপর বিরোধী নেত্রীকে নয়াদিল্লি সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে এমন ধারণা দেয়ার চেষ্টা হয় যে, ভারত বাংলাদেশের সব পক্ষের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের ধারণায় বিশ্বাস করেন বলেও মনে হয়। কিন্তু এরপর বাংলাদেশ বিষয়ে উদারপন্থীদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেন কট্টরপন্থীরা। এ ধারার লোকদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থ দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত করতে চাইলে আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এ বক্তব্যে ব্যক্তিগত জীবনে শেখ পরিবারের অকৃত্রিম সুহৃদ প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির সমর্থন ও মদদ রয়েছে বলেও মনে করা হয়। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে নয়াদিল্লির মদদে শাহবাগ আন্দোলনের সৃষ্টি বলে যে বক্তব্য এসেছে, তাতে নয়াদিল্লির বাংলাদেশ নীতির প্রতিফলন রয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রণব মুখার্জির আনুষ্ঠানিকতার বাইরে কার্যকর কোনো ভূমিকা না থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের নেতা হিসেবে ইউপিএ সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী তার মতের বাইরে কোনো কৌশল বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নিতে চান না। ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের আনুষ্ঠানিক ক্ষমতার চেয়ে বেশি ভূমিকা থাকে প্রণবের। প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির সুপারিশে নয়াদিল্লি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে আরেকবার ক্ষমতায় আনার পরিকল্পনা অনুমোদন করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ভারতীয় নীতি ও পদক্ষেপের সমালোচনা সে দেশের মিডিয়াতেও আস্তে আস্তে উচ্চকিত হচ্ছে। একটি বিশেষ গ্রুপকে অতিমাত্রায় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া এবং বৃহত্তর একটি ধারাকে নির্মূল করার কর্মসূচিতে মদদ দিতে গিয়ে যে বৈরিতার ঢেউ দেখা যাচ্ছে তা ভারতীয় স্বার্থকে নানা ক্ষেত্রে বিপদে ফেলতে পারে। অন্য একটি দেশে দলবিশেষকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যখন ভারতের নীতি সব পক্ষের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ছে তখন বিপরীত গ্রুপ যে প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা চেয়েছিল বলেই এ ক্ষেত্রে ভারতের সহায়তা নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সে প্রেক্ষিত আর থাকেনি। ২০১৩ সালের অবস্থাও ৪২ বছরের আগের অবস্থা থেকে অনেকটা ভিন্ন। এ বাস্তবতা নয়াদিল্লির একশ্রেণীর নীতিনির্ধারক এবং এখানে তাদের মতের অনেক ধারক-বাহক আমলে আনতে চাইছে নাÑ যা দুই দেশের কারো স্বার্থকেই শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নেবে না।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারতের প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একতরফা বলে মনে করা হচ্ছিল। এমন ধারণাও ব্যক্ত করা হয় যে, বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র নয়াদিল্লির চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখে থাকে। আমেরিকান নেতারা দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের গুরুত্বের কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন। এমনকি এক সময় দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে ‘মোড়ল’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন বর্তমান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আফগানিস্তানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের নয়াদিল্লির ওপর নির্ভরতাও বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নানা ক্ষেত্রে টানাপড়েনে সেটি আর আছে মনে হয় না। পাকিস্তান ছাড়াও ভারতের চার পাশের অপেক্ষাকৃত ুদ্র রাষ্ট্রগুলোর সাথে ওয়াশিংটনের সরাসরি সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার মত প্রবল হয় ওয়াশিংটনে। মিয়ানমার, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও এটি দেখা গেছে। বাংলাদেশে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমেরিকান স্বার্থের বিপরীত ভূমিকা দেখা গেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে নিয়োজিত আলোচিত সাবেক আমেরিকান রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলামের বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এক সাক্ষাৎকারে নয়াদিল্লির চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে ওয়াশিংটন দেখে থাকে মর্মে ধারণার ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে মাইলাম বলেন, ‘আমি মনে করি এটি ভুল। আমরা বরং বাংলাদেশকে ভিন্ন চোখে দেখি। সেটি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে আশাবাদ রয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য সর্বাধিক অগ্রগতির কথা রয়েছে। বাংলাদেশে কম নিরপেক্ষ কোনো পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান আমি দেখতে চাই না। কারণ এটি বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না; বরং সেটি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্যও ভালো হবে না। আমি মনে করি, এ বিষয়ে আমাদের ভারসাম্য বিরাজ করে। কোনো একটি পক্ষ এই ভারসাম্যকে ধ্বংস করতে চাইলে অন্য পক্ষ চুপচাপ থাকে না।’
বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে ওই সাক্ষাৎকারে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ওই সাবেক প্রভাবশালী কূটনীতিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই দেখতে পাই যে, বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি সাফল্যের উপাখ্যানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে যা এ লক্ষ্যে অবদান রাখছে না। ড. ইউনূসের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া পদক্ষেপ অযৌক্তিক ও ভীতিকরই শুধু নয়, একই সাথে এটা নিষ্ঠুর ও প্রতিশোধপরায়ণও। এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকার দেশে দ্বিতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অস্তিত্বকে হুমকি হিসেবে দেখে থাকতে পারে।’ উগ্রপন্থী দমনে সরকারের সাফল্য দাবি প্রসঙ্গেও মাইলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশের উগ্রপন্থা নিয়ে অনেকে যতটা উদ্বেগ অনুভব করেন তা তার চেয়ে কম উদ্বেগের বিষয়। এ সাফল্যের কথা বলে অনেক অযৌক্তিক পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ। যেমন তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলোপ করেছে যা কি না আমাদের বিবেচনায় বাংলাদেশের একটি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি ও উন্নত গণতান্ত্রিকব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার পথে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল।’
উইলিয়াম বি মাইলাম আমেরিকান চিন্তাভাবনা ও পর্যবেক্ষণকে যতটা খোলামেলাভাবে প্রকাশ করতে পারেন ততটা পারেন না বর্তমান প্রশাসনে কর্মরতরা। তবে ওবামা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের কূটনৈতিক মোড়কের বক্তব্যে মাইলামের কথার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। মাইলাম তার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে বাংলাদেশের অকার্যকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেছেন। এ ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান পূর্ণ সামরিক কর্তৃত্ব গ্রহণে নয় বরং সীমিত ধরনের পদক্ষেপে রাজনৈতিকব্যবস্থাকে গতিশীল করা এবং জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা অধিক গ্রহণীয় হতে পারে এমন এক মডেলের ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার বক্তব্যে।
বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেশের ভেতর-বাইরের অনেকে কিছু নির্ণায়ক বিষয়ের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে অন্য কিছু বিষয়কে উপেক্ষা করেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যেমন এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিভাবে বাংলাদেশ-চীন ও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ। ওআইসিভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণই শুধু নয়, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এক সময় অন্যতম প্রধান নির্ণায়কে পরিণত হতে পারে নানা কারণে। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে এক ধরনের স্থিতি ও ভারসাম্য থাকে। সে ভারমাম্যকে হঠাৎ করে উপড়ে ফেলা যায় না। বাংলাদেশের মতো ১৬ কোটি মানুষের একটি দেশের জনমানসকে শুধু মিডিয়ার উচ্ছ্বাস দিয়ে বিবেচনা করলে যে ভুল হয় সেটি বোঝা যেতে পারে উত্তাল হয়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের ফুটো বেলুনে রূপ নেয়া দেখে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন